শেষ আপডেট: 9th April 2023 01:26
দেশের প্রথম সমকামী যুবরাজ মানবেন্দ্র, ইলেকট্রিক শক দিয়ে 'চিকিৎসা' করেছিল পরিবার
দ্য ওয়াল ব্যুরো: গুজরাতের রাজপিপলার রাজপুত রাজা মহারানা রঘুবীর ও রানি রুক্মিণীদেবীর কোল আলো করে যেদিন এসেছিল মানবেন্দ্র, সেদিন থেকেই ভবিষ্যতের মহারাজা হিসেবে তার ভাগ্যনির্ধারণ হয়ে গেছিল। ১৯৬৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। রাজপুত বংশের আর পাঁচটা ছেলের মতোই মহাধূমধামে উদযাপিত হয়েছিল তার জন্ম। যুবরাজ মানবেন্দ্র সিং গোহিল। গোহিল রাজপুত পরিবারের ৩৯তম বংশধর। বড় হয়ে ঘোড়ায় চড়ে, তরবারি হাঁকিয়ে রাজ্যশাসন করবেন তিনি, সকলে এমনটাই ভেবেছিলেন।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব ছক ভেঙে খানখান করে দেন মানবেন্দ্র। তৈরি করেন এমন এক নজির, যা ইতিহাসের পাতায় স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। আজ থেকে ১৬ বছর আগে সবার সামনে এসে নিজের সমকামী পরিচয়কে মেলে ধরেন। তিনিই দেশের প্রথম সমকামী রাজা (Gay Prince) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। বহু সামাজিক বাধা, ভয়, লজ্জা, অস্বস্তিকে সপাটে উড়িয়ে দেন তিনি। দৃষ্টান্ত গড়েন দেশের তথা গোটা বিশ্বের দরবারে।
কৈশোরেই দেখা হল নিজের সঙ্গে
মানবেন্দ্রর বয়স যখন ১২, তখনই নিজেকে একটু একটু করে চিনতে শুরু করে সে। বুঝতে পারে শরীরে ছেলে হলেও, তার মনের মধ্যে কোথাও বাস করে একটি মেয়ে। বুঝতে পারে, তার আকর্ষণও ছেলেদের প্রতি। যদিও সে সময়ে কাউকেই সে কথা বলতে পারেনি সে। পরিবারের সকলের থেকেই আড়াল করে রেখেছিল নিজের সত্তাকে। উপায়ই বা কী ছিল! আজ থেকে বছর ২৫ আগে সমকামিতা মেনে নেওয়া দূরের কথা, এ নিয়ে সকলে জানতেনই বা কতটুকু!
এভাবেই কাটে কৈশোর, আসে যৌবন। একসময় পরিবারের রীতি মেনে বিয়েও করতে হল তাঁকে। রাজপরিবারেরই এক পরমাসুন্দরী কন্যার সঙ্গে মহা ধূমধামে বিয়ে হল। কিন্তু নিজেকে চিনে ফেলা ও বুঝে ফেলা মানবেন্দ্র বেশিদিন ঠকাতে পারলেন না স্ত্রীকে। ভেঙে দিলেন বিয়ে। ডুবে গেলেন অবসাদে। ততদিনে ধীরে ধীরে পরিবারের কাছেও স্পষ্ট, বিয়ে ভাঙার কারণ।
গোহিল বলেন, "২০০২ সালে আমি বাবা-মার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তাঁদের জানিয়েছিলাম, আমার কথা। বলেছিলাম, আমি মেয়েদের প্রতি আকৃষ্ট নই, পুরুষদের প্রতিই আকৃষ্ট। ওরা ভেবেছিল এটা অসম্ভব একটা কিছু। এত সংস্কৃতিসম্পন্ন, উচ্চবিত্ত পরিবারে কেউ যে এমন হতে পারে, তা ওরা মেনে নিতে পারেনি। পারিবারিক সংস্কৃতির সঙ্গে যে ব্যক্তিগত যৌন পরিচয়ের কোনও সম্পর্ক নেই, তা আমি বোঝাতে পারিনি।"

'সারিয়ে তোলার' নামে শুরু হল অকথ্য নির্যাতন
সত্যিই তো, রাজপুত্র বলে কথা, সে নাকি সমকামী! গোটা বিষয়টি চারদেওয়ালে বন্ধ করে রাখতে চেষ্টার কসুর করেনি পরিবার। সেই সঙ্গেই চলেছিল 'চিকিৎসা'। এমনকি বাদ যায়নি ঝাড়ফুঁকও। গোহলির কথায়, "ওরা ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলে, আমার 'মাথা' ঠিক করে দিতে। আমায় ইলেকট্রিক শকও দেওয়া হয়, 'চিকিৎসা' হিসেবে। যখন কিছুতেই কিছু হল না, তখন আমায় বিভিন্ন ধর্মগুরুর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি ভয়ংকর ভেঙে পড়ি। আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলাম।"
কিন্তু একসময় বিদ্রোহ করেন যুবরাজ মানবেন্দ্র। অবসাদ ঝেড়ে ফেলে ঠিক করেন, প্রকাশ্য আনবেন তাঁর নিজের পরিচয়। ততদিনে গোটা দেশে এলজিবিটিকিউ গোষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে খানিকটা আন্দাজ পেয়েছেন তিনি। বুঝেছেন, সমাজের এত উপরতলার বাসিন্দা হয়েও যদি এমন সমস্যা হয় তাঁর সঙ্গে, তাহলে সাধারণ পরিবারের কেউ সমকামী হলে তাঁর লড়াই ঠিক কতটা কঠিন!

ইতিহাস গড়লেন মানবেন্দ্র, প্রকাশ করলেন নিজেকে (Gay Prince)
এর পরে ২০০৬ সালে প্রথমবার সামনে আসে তাঁর জীবনের গল্প। ৪১ বছর বয়সে বিশ্বের প্রথম সমকামী যুবরাজ বলে নিজেকে ঘোষণা করেন তিনি। রাজপরিবার মেনে নেয়নি কোনওভাবেই। সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে রাজপরিবারের তরফে ঘোষণা করা হয়, মানবেন্দ্র গোহিলের সঙ্গে তাঁদের পরিবারের কোনও সম্পর্ক নেই।
এসবের পরোয়া করেননি মানবেন্দ্র। তিনি সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়েন এলজিবিটিকিউ আন্দোলনের সঙ্গে। শুরু করেন 'লক্ষ্য' ট্রাস্ট, যাঁরা প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের কল্যাণে কাজ করে, কাজ করে এইডস রোগীদের নিয়ে।
পরে একটি সাক্ষাৎকারে মানবেন্দ্র বলেছেন, "আমি যেদিন সত্যিটা সবাইকে জানাই, আমায় নিয়ে গড়ে ওঠা সকলের সমস্ত ধারণা জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায়। আমার বিরুদ্ধে একজোট হয়ে যায় বহু মানুষ। রাস্তাঘাটে চিৎকার করে স্লোগান ওঠে, আমি রাজপরিবারের লজ্জা, আমি ভারতের সংস্কৃতিকে অপমান করেছি। খুনের হুমকি পেতে থাকি। দাবি ওঠে, আমি যেন রাজপরিবারের পদবি ব্যবহার না করি।"

সব কাঁটা পার করে সন্তান, সঙ্গী
এমনটা যে একেবারে আশাতীত ছিল মানবেন্দ্রর কাছে, তা নয়। তিনি জানতেন, তাঁর আশপাশের সমাজ খুবই গোঁড়া এবং দেশে তখনও সমকামী অধিকারের বিষয়টি বিশেষ আলোচিত নয়। সমকামীদের পাগল বলে দাগিয়ে দেওয়ারও প্রবণতা ছিল সমাজে। সেসময়ে দাঁড়িয়ে মানবেন্দ্র মন্তব্য করেছিলেন, "আমি সাধারণ মানুষকে দোষ দিচ্ছি না। এই বিষয়টিকে সমাজ এতটাই ব্রাত্য করে রেখেছে, যে সেখানেই আসল গলদ লুকিয়ে আছে।"
ধীরে ধীরে পরিচিতি বাড়ে তাঁর। দেশের নানা প্রান্তে তো বটেই, বিদেশেও নানা অনুষ্ঠানে ডাক পেতে শুরু করেন। অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়ে এলজিবিটিকিউ গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেছেন। রাজপিপলার যুবরাজের কণ্ঠে জোর পেয়েছে গোটা বিশ্বের সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার চিৎকার। ২০০৮ সালে আরও একবার ছক ভেঙে দেশের প্রথম সমকামী পুরুষ হিসেবে একটি শিশুকে দত্তকও নেন তিনি। ২০১৩ সালে বিয়েও করেন পছন্দের সঙ্গীকে।

এখনও অনেক লড়াই বাকি
২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টে আইনি বৈধতা পায় সমকামিতা। ১৫ একর জায়গা নিয়ে বিশাল এক আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলেন মানবেন্দ্র। জায়গা করে দেন এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের বহু প্রান্তিক মানুষকে। ঘটনাচক্রে, গোহিল রাজপুত পরিবারেরই জমিতে গড়ে ওঠে এই কেন্দ্র, যে পরিবারের সমস্ত অধিকার থেকে একদিন তাঁকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় সমকামিতার 'অপরাধে'।
আজ অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে এলজিবিটিকিউ আন্দোলন। যদিও তার পরেও দেশজুড়ে তৃতীয় লিঙ্গের ও রূপান্তরকামী মানুষদের উপর শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শেষ নেই। এমনকি বহু জায়গায় রমরমিয়ে চলছে 'কনভার্শন থেরাপি', অর্থাৎ যৌনতা বদলে দেওয়ার থেরাপি। কোথাও চলছে ইলেকট্রিক শক, কোথাও বা মারধর।

এসবের মধ্যে এলজিবিটিকিউ-দের মধ্যে প্রতিদিন বাড়ছে অবসাদ, ঘটছে আত্মহত্যা। ৫৮ বছর বয়সি গোহিলের কথায়, "এখনও অনেক লড়াই বাকি। আইনের হাতে সবটা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে হবে না। অধিকার প্রতিষ্ঠার একটা অনন্ত লড়াই এটা। রাজপরিবার হোক বা সাধারণ ঘর— সব জায়গার চিত্রটা কমবেশি একই।"
ঠুকঠুক বিজয় থেকে ‘ভোলেবাবা শঙ্কর’! কী করে এত দ্রুত নিজেকে বদলালেন গুজরাত তারকা