কাকলী দেবনাথ
বিশাখার আজ শ্রাদ্ধ। দেশের দুই প্রান্ত থেকে দুই ছেলে আর সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে মেয়ে উড়ে এসেছে।
মায়ের শ্রাদ্ধে কোনও রকম খামতি রাখতে চায় না ওরা। বিশাল বড় ল্যামিনেশন করা ছবিটা ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে। দামি সার্টিন কাপড়ের প্যান্ডেল
বিশাখার আজ শ্রাদ্ধ। দেশের দুই প্রান্ত থেকে দুই ছেলে আর সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে মেয়ে উড়ে এসেছে।
মায়ের শ্রাদ্ধে কোনও রকম খামতি রাখতে চায় না ওরা। বিশাল বড় ল্যামিনেশন করা ছবিটা ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে। দামি সার্টিন কাপড়ের প্যান্ডেল। সারা প্যান্ডেল জুড়ে সাদা ফুলে ডেকোরেট করা হয়েছে। জায়েন্ট স্ক্রিনে চলছে বিশাখার বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি। পাড়ার অভিজাত ফ্যামেলির মানুষজন একের পর এক আসছেন। নিজেদের ফ্যামিলি স্ট্যাটাস বোঝানোর জন্য কোনওরকম কার্পণ্যই করেননি ওঁরা।
দূরে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে বসে আছেন প্রণবেশ। ফটোতে ফুলের মালা পড়ানোর পরে সবাই একবার করে প্রণবেশের কাছে যাচ্ছে সমবেদনা জানানোর জন্য। ভীষণ ভীষণ ঘুম পাচ্ছে প্রণবেশের। গত তিন বছর ধরে বয়ে নিয়ে চলা একটা বোঝা যদি হঠাৎ করে ঘাড় থেকে নেমে যায় যেমন স্বস্তি লাগে, ঠিক তেমনি লাগছে আজ প্রণবেশের।
পাঁচ বছর আগে ধরা পড়েছিল বিশাখার অসুখটা। প্রথমদিকে সব কিছু ভুলে যেত। কিছুই মনে রাখতে পারত না। বাড়াবাড়ি হল গত তিন বছর থেকে। সবসময় বিছানায় শুয়ে থাকত। কাউকে চিনতে পারত না। শেষের দিকে তো পিঠে বেড সোর হয়ে গেছিল। এই ক'বছর জলের মতো টাকা বেরিয়ে গেছে প্রণবেশের। বিশাখাকে ভালো করে তুলতে সব রকম চেষ্টাই করেছেন প্রণবেশ।
পাটভাঙ্গা ধুতি পাঞ্জাবি পড়ে এইভাবে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না প্রণবেশের। কিন্তু কী করা? নিমন্ত্রিতরা সকলেই প্রণবেশের সঙ্গে দু–একটা কথা বলতে চায়। সেই এক কথা সকলের মুখে মুখে -
“অনেকদিন ধরে কষ্ট পাচ্ছিলেন। তার থেকে...। আপনি তো কম করলেন না। সবই তো চোখের সামনে দেখলাম।”
কেউ বলছে, “ভগবানের উপর তো আর কারও হাত নেই, উনি যা করেন সকলের ভালোর জন্যই করেন।”
প্রণবেশ একটু একা থাকতে চাইছিলেন। আস্তে আস্তে গুটি গুটি পায়ে বিশাখার ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। এই ঘরেও বিশাখার একটা ছবি রাখা হয়েছে, তাতে রজনীগন্ধার মালা, সামনে ধূপ জ্বলছে। মহিলারা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে গল্প করছে। প্রণবেশকে দেখে সবাই চুপ হয়ে গেল। তার মধ্যে থেকে একজন উঠে এসে বলল, “কাকাবাবু কিছু চাই আপনার?”
প্রণবেশ আস্তে করে মাথা নাড়লেন, তারপর একটু যেন অপ্রস্তুত গলায় বললেন,
“আমি একটু ওপরে আমার রুমে যেতে চাই।”
“আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?”
“না, ঠিক শরীর খারাপ নয়, এই একটু।” খুব ক্লান্ত শোনাচ্ছিল প্রণবেশের গলাটা।
মেয়েটি হয়ত প্রণবেশের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক আছে। আপনি যান, আমি সবাইকে বলে দেব।”
প্রণবেশ ধীর পায়ে ওপরে উঠতে থাকলেন। দু'দিন আগেও এই ঘরের পাশ দিয়ে যেতে গেলে প্রণবেশের কেমন অস্বস্তি হতো। সারাক্ষণ স্যালাইন, বেড প্যান, ওষুধের গন্ধ, নার্সের বিরক্তিকর মুখ, সব মিলিয়ে একটা দম বন্ধ করা পরিবেশ। প্রথম দিকে প্রণবেশই শুতেন বিশাখার ঘরে, কিন্তু অন্য খাটে। ভালো লাগত না। অবশ্য উপায়ও তো ছিল না। পরে ছেলেমেয়েরা একরকম জোর করেই নার্সের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। প্রণবেশও খানিকটা হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলেন।
২
কাল মাছ ছোঁয়ানি হয়ে গেল। শ্রাদ্ধের কাজ বাড়িতে হলেও, মাছ ছোঁয়ানির দিন অনুষ্ঠান একটা এসি হল ভাড়া করেই হয়েছিল। মেনুতে ইলিশ, পাবদা থেকে শুরু করে মৌরলা কোনও কিছুই বাদ যায়নি। ছোট ছেলে তো খাসির মাংসের কথাও বলেছিল, নেহাৎ পুরুতঠাকুর বারণ করলেন তাই...।
দু'দিনের ধকলে সবাই আজ ক্লান্ত। ঘুম থেকে উঠতে সবার দেরি হয়েছে। চায়ের টেবিলে বসে ছেলেমেয়েরা একের পর এক প্রণবেশ কে জানাচ্ছে, কাকে, কবে ফিরতে হবে। প্রণবেশ চুপচাপ শুনে যাচ্ছেন ছেলেমেয়েদের কথা। আর মনে মনে ভাবছেন এরপর থেকে তার একাকীত্বের দিন শুরু।
মেয়ে বলল, “বাবা, এখন তো আর তোমার কোনও পিছুটান নেই। চল কিছুদিন আমার কাছে গিয়ে থাকবে। দেখবে তোমার খারাপ লাগবে না।”
প্রণবেশ ম্লান হাসলেন। মেয়ে অভিমান করে গাল ফুলিয়ে বলল, “আগে বলতে, তোর মাকে ছেড়ে যাই কী করে! এখন তো আর সেই পিছুটান নেই।”
পিছুটান? শব্দটা যেন প্রণবেশের বুকে একটা ধাক্কা দিল। আচ্ছা পিছুটান থাকল না বলে কি প্রণবেশ খুব খুশি হলেন? পুরুষ মানুষ তো বাঁধন ছাড়া হয়ে থাকতেই ভালোবাসে কিন্তু মেয়ে পিছুটান নেই বলাতে খারাপ লাগল কেন তাঁর? তাহলে কি পুরুষও বাঁধন চায়?
দুই বৌমাও বলে উঠল, “হ্যাঁ বাবা, এরপর থেকে আপনি আমাদের কাছে ঘুরে ফিরে থাকবেন।”
ছেলেরা বলল, “তুমি আমাদের কাছে থাকলে, আমরাও নিশ্চিন্ত হতে পারি। একা একা এখানে পড়ে থেকেই বা কী করবে?”
প্রণবেশ হ্যাঁ না কিছুই বললেন না। ভেবে দেখি বলে উঠে যাচ্ছিলেন।
মেয়ে একটু ইতস্তত করে বলল, “বাবা আমরা তো সবাই চলে যাব, তার আগে মায়ের আলমারির চাবিটা একটু দিও। ওগুলো দেখভাল করা তো তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমরা যার যেটা ভালো লাগে, নিয়ে যাই।”
প্রণবেশ তাকিয়ে দেখলেন, বৌমাদেরও সেইরকমই ইচ্ছে। শান্ত হয়ে বললেন, “আজ থাক। তোমরা তো আছ এখনও দু'দিন, কাল না হয় দেব চাবি।”
ছোট বৌ বলল, “বাবা, মায়ের গয়নাগুলো কি লকারে আছে ?”
“জানি না বৌমা, বহুদিন তো ওগুলো ব্যবহার হয়নি। তবে বাড়িতেও কিছু আছে মনে হয়। কাল তোমরা আলমারি খুলে সব ভাগ করে নিও। ওগুলো আর আমি রেখেই বা কী করব?” একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল প্রণবেশের বুক থেকে।
৩
এখন গভীর রাত। সারা বাড়িটা কেমন নিঝুম হয়ে আছে। কিন্তু ঐ আলমারির ভেতরের জিনিসগুলো নিয়ে তুমুল আলোড়ন চলছে বাড়ির তিল সদস্যার মনে। বড় বৌ তিয়াষা ভাবছে, সেবার পুজোয় তার স্বামী তমাল মাকে এক লাখ টাকা দিয়ে যে চাঁদেরিটা দিয়েছিল, ওটা তার চাই। তখনও অবশ্য তিয়াষা বৌ হয়ে এ বাড়িতে আসেনি। তমালের সঙ্গে প্রেম করছে। ভাবি শাশুড়িকে খুশি করার জন্য, ঐ শাড়িটা তিয়াষাই পছন্দ করে দিয়েছিল। আর সেই হিরের সেটটা, যেটা পঁচিশ বছরের বিবাহ বার্ষিকীতে বাবা, মাকে দিয়েছিল। মা বলেছিল, ওটা তাকে দেবে।
ছোট ছেলের বৌ পিহু অবশ্য শাড়ি–টারি খুব একটা পড়ে না। তাই শাড়ির প্রতি তেমন কোনও আগ্রহ নেই। শাশুড়ি মায়ের হিরের সেটটা খুব পছন্দের তার। শাশুড়িমা একবার এক বিয়ে বাড়ি যাবার সময় পরতে দিয়েছিল পিহুকে। ফেরত দিতে মন চাইছিল না পিহুর। কিন্তু শাশুড়িমা মিষ্টি করে বলেছিলেন, “আমি মরে গেলে এ সব তো তোমাদেরই থাকবে। ওটা এখন আমার কাছেই থাক।” না, ওটা পিহু কিছুতেই হাতছাড়া করবে না।
আর বিশাখার মেয়ে রুম্পা? সে কী ভাবছে এখন? সে কি মায়ের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ? তার তো অনেক আছে, উপচে পড়ছে। এই সব শাড়ি গয়না কিছুই কি সে চায় না?
মেয়ে রুম্পা ভাবছে, আমি যখন এ বাড়িতে থাকতাম, তখন তো এ বাড়ির এত রমরমা অবস্থা ছিল না। বাবার যা আয় হতো, তিন ভাই বোনের পড়াশুনার পেছনেই খরচ হয়ে যেত। বাবাও তখন অত উঁচু পদে ছিলেন না। তাই তো এম-এ পাশ করতে না করতে, বিয়ে দিয়ে দিল তাকে। বিয়েতে তো গয়নাগাটিও তেমন দেয়নি। তাই মায়ের সব গয়নার ওপর তারই একমাত্র অধিকার। ছেলের বৌ'রা নিলে সব হয়তো বদলে নতুন গয়না করে নেবে। মায়ের স্মৃতির প্রতি পরের বাড়ির মেয়েদের কি কোনও মায়া থাকবে? দুটোই তো উড়নচণ্ডী জুটেছে। তার কাছে থাকলে বরং মায়ের স্মৃতিগুলো থাকবে। বাবাকে এই কথাগুলো ভালো করে বোঝাতে হবে। রুম্পা মনে মনে ভাবল, আর মায়ের শাড়িগুলো ভালো করে ড্রাই ক্লিনিং করে রেখে দিলেই হল। মাঝে মাঝে যখন আসবে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরা যাবে।
৪
প্রণবেশের কিছুতেই ঘুম আসছে না। কেমন যেন এক শূন্যতা চারিদিকে ছেয়ে আছে। খানিকক্ষণ ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। একটা সিগারেট ধরালেন। যদিও ডাক্তার বারণ করেছে তবুও মাঝে মধ্যে এক আধটা সুখটান দিয়েই ফেলেন। কী মনে করে আবার ফিরে এলেন নিজের ঘরে। দরজাটা ভাল করে লক করে দিয়ে ড্রয়ার থেকে চাবিটা বের করলেন। পুরো দেওয়াল জুড়ে বিশাল বড় সেগুন কাঠের ওয়াড্রব। ওয়াড্রব খুলতেই কী যেন একটা টং করে পড়ল, আরে এটা তো সেই আংটিটা যেটা বেশ কয়েকমাস আগে নার্স বিশাখার হাত থেকে খুলে প্রণবেশকে দিয়ে বলেছিল, আংটি পরার অবস্থায় বিশাখার আঙ্গুলগুলো আর নেই। ফ্যালফ্যাল করে বিশাখা চেয়েছিল প্রণবেশের দিকে। প্রণবেশ তাকিয়েছিলেন বিশাখার আঙ্গুলগুলোর দিকে। কেমন বিচ্ছিরি ফুলে গেছে আঙ্গুলগুলো। এটা ওদের এনগেজমেন্টের আংটি। এত বছরে বিশাখা কখনও হাত থেকে খোলেনি আংটিটা। ক্ষয়ে গেলেই আবার রিপেয়ার করে নিত।
প্রণবেশের মনে পড়ে গেল এই আংটি পরানোর সময় সবার অলক্ষ্যে সে বিশাখার হাতের তালুতে সুড়সুড়ি দিয়েছিলেন, আর বিশাখা লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রণবেশ নীচু হয়ে আংটিটা তুলে নিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। লাল, নীল, সবুজ, হাল্কা গোলাপি, গোল্ডেন কত রঙের শাড়ি সারা আলমারি জুড়ে। আস্তে করে হাত বোলালেন শাড়িগুলোর উপর। হঠাৎ হাত পড়ল গাঢ় নীল রংয়ের সিফনটার উপর। হ্যাংগার থেকে স্লিপ করে পিছলে পড়ল পায়ের কাছে শাড়িটা। প্রণবেশ মেঝেতে বসে শাড়িটা তুলতে গিয়ে দেখলেন শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজটাও রয়েছে। ব্লাউজটার উপর হাত দিতেই মনে হল সেই অল্প বয়সের বিশাখা যেন খিলখিল করে হেসে উঠল। “এই, কী হছে এটা?” মুচকি হেসে ভুরু কুঁচকে বিশাখা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।
এই রকম পেছনে ফিতেওয়ালা ব্লাউজগুলো পরলেই বিশাখা সব সময় প্রণবেশকে ডাকত ফিতে বেঁধে দেওয়ার জন্য। ফিতেটা বেঁধে দিয়েই প্রণবেশ আলতো ভাবে বিশাখার ঘাড়ে চুমু খেত। আর বিশাখা খিল খিল করে হেসে উঠত। ঘাড়ে ওর ভীষণ সুড়সুড়ি ছিল। শাড়িটা ভাঁজ করে তুলে রাখতেই প্রণবেশের চোখ পড়ল গোল্ডেন শাড়িটার উপর। শাড়িটা চোখে পড়তেই একটা দুষ্টু হাসি খেলে গেল প্রণবেশের ঠোঁটে। সেবার ছোটমাসির মেয়ের বিয়েতে যাওয়ার দিন বিশাখা পড়েছিল এই শাড়িটা। আর প্রণবেশকে ডেকেছিল ফিতে বেঁধে দেওয়ার জন্য। ফিতে বেঁধে চুমু খেতেই কী যেন হয়ে গেল। প্রণবেশ নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি। বিশাখাও যে রাগ করেছিল তা নয়। বরং প্রচ্ছন্ন অনুমতিই দিয়ে ছিল। পালিশ করা শাড়িটা দুমড়ে মুচড়ে একশা হয়ে গিয়েছিল। পরে শাড়ি পাল্টে অন্য শাড়ি পরেছিল বিশাখা। বিয়ে বাড়িতে দেরিতে পৌঁছনোর জন্য মাসি খুব রাগ করেছিল সেদিন।
আরে ওই তো সবুজ রঙের শাড়িটা। কী শাড়ি এটা? প্রণবেশের পছন্দ করে কিনে দেওয়া প্রথম শাড়ি। বাবু জন্মেছিল দুর্গাপুজোর কয়েকদিন আগে। সেবার পুজোর বাজার করতে বিশাখা যেতে পারেনি। প্রণবেশ একাই গিয়েছিলেন। তখনই কিনে এনেছিলেন শাড়িটা। বিশাখার একদম পছন্দ হয়নি। বলেছিল, “তোমার পছন্দ খুব খারাপ।”
প্রণবেশ হেসে বলেছিলেন, “জানি তো। সেই কারণেই তো তোমায় পছন্দ করেছি।”
নিজের কথার জালে নিজেই জড়িয়ে পড়ায় বিশাখা খুব রেগে গেছিল। পছন্দ না হলেও ওই শাড়িটাই সবচেয়ে বেশি পড়ত বিশাখা। আর বলত, “তোমায় খুব ভালোবাসি বলেই পরি, অন্য কেউ দিলে এই ক্যাটক্যাটে রঙ আমি পরতামই না।”
প্রণবেশ আস্তে আস্তে সব শাড়িগুলোর উপর আলতো করে হাত বোলাতে লাগলেন। এই ভাবে আগে কখনও বিশাখার শাড়িগুলোকে দেখেছেন বলে মনে পড়ে না প্রণবেশের। যে বিশাখা বহুদিন আগে হারিয়ে গিয়েছিল প্রণবেশের কাছ থেকে, আজ এই শাড়িগুলো যেন এক এক করে ফিরিয়ে দিচ্ছে হারিয়ে যাওয়া মানুষটাকে। তিনবছর ধরে তো বিশাখার সেই কঙ্কালসার চেহারা, কোটরে ঢোকা চোখ, টাক পড়া মাথা, কুঁচকে যাওয়া মুখই দেখে আসছেন প্রণবেশ। শেষ কবে বিশাখার মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়েছেন প্রণবেশ? মনে করতে পারেন না। ঘরটাতে শুধু দেখতে ঢুকতেন, ওর প্রাণটা আছে কিনা। কতদিন ঘরে ঢুকে বুকটা ধক্ করে উঠেছে। মনে হয়েছে বিশাখা বুঝি আর নেই, নার্সকে ডাকতে যাবেন এমন সময় হয়ত বুকের চাদরটা হাল্কা নড়ে উঠছে।
ওইভাবে কতক্ষণ বসে আছেন খেয়াল নেই প্রণবেশের। চমক ভাঙল, শাড়ির ভাঁজ থেকে একটা খাম খসে পড়ায়।
আরে এটা কী ?
প্রণবেশ খামটা খুলে দেখলেন প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে নিজের হাতে তৈরি করে বিশাখাকে দেওয়া কার্ডটা। তখন কত অল্প বয়স প্রণবেশের। রঙিন কালি দিয়ে প্রণবেশ লিখেছিলেন- গানের লাইনটা, “ভালো যদি বাস সখী কী দিব গো আর, কবির হৃদয় এই দিব উপহার।” আবার হেসে উঠলেন প্রণবেশ, কী সব পাগলামিই না করেছেন ওরা সে সময়। কত প্রেমের কবিতা যে লিখেছেন সেই সময়। বিশাখাই ছিল তাঁর কবিতার প্রথম পাঠক।
প্রণবেশ শাড়িগুলোকে গুছিয়ে রেখে আস্তে করে আলমারিটা বন্ধ করলেন। শুধু সেই গোল্ডেন শাড়িটা হাতে নিয়ে বিছানায় শুতে গেলেন। আজ বহুদিন বাদে যেন কত শত শতাব্দী পরে প্রণবেশ নিজের শরীরে সেই উত্তেজনা অনুভব করলেন। এই পঁচাত্তর বছর বয়সেও ওর শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরা যেন টান টান হয়ে উঠল। না, প্রণবেশ জীবন্মৃত এক পুরুষ নয়, এখনও তাঁর মধ্যে প্রাণ আছে। ভীষণ ভীষণ ভালো লাগছে আজ প্রণবেশের। তিনি যেন তাঁর বেঁচে থাকার জীয়নকাঠি পেয়ে গেছেন।
প্রণবেশ মনে মনে ভাবেন, না, বিশাখার একটা জিনিসও তিনি কাউকে দিতে পারবেন না। বিশাখার ছোটখাটো প্রতিটি জিনিস এখন তাঁর কাছে বেঁচে থাকার একমাত্র অক্সিজেন। আলমারির চাবিটা নিয়ে কী করবেন বুঝতে পারছেন না প্রণবেশ। কী করবেন তিনি এখন? ছেলে মেয়েকে বলে দেবেন, “চাবি হারিয়ে গেছে ,পাওয়া যাচ্ছে না।” নাকি বলবেন, “ঐ আলমারির মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমার জীয়নকাঠি ওটা তোমরা নিয়ে যেও না।” যাইহোক, কিছু একটা করতেই হবে তাঁকে। প্রণবেশ কথার পর কথা সাজাতে থাকেন।