
তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
“আমার তখন বয়স ১২ বা ১৩। ওরা আমায় চেপে ধরল। জোর করে প্যান্ট খুলে দু’পা ফাঁক করল। আমি চিৎকার করছিলাম, আমার মুখ শক্ত করে চেপে দিল এক জন। তার পরেই তীব্র ব্যথা (Female Genital Mutilation)! ‘ওটা’ কেটে ফেলল ওরা৷ ছবিটা এখনও আমার চোখে ভাসে। আর ওই জায়গাটায় যে তীব্র ব্যথাটা হয়েছিল, সেটাও যেন ফিরে আসে। ওই টেবিলে ও ভাবে শুয়ে থাকা অবস্থাতেই ওখানটা সেলাই করে ওরা। ওখানটা বেঁধে আমার দু’টো পা একসঙ্গে করে দেয়। অনেক দিন পা ফাঁক করতে পারতাম না আমি। টয়লেটের সময়ে চরম কষ্ট। প্রায় মাসখানেক পরে ক্ষত শুকোয়।”
ওপরে লেখা অংশটা কোনও বই থেকে উদ্ধৃত নয়। কারও কোনও কাল্পনিক বক্তব্যও নয়। একথা সাংবাদিকদের সামনেই গোটা গোটা অক্ষরে বলেছিলেন সালাহা পাটওয়ালা নামের এক তরুণী। ইন্টারনেটে পিটিশনও দায়ের করেছিলেন তিনি। মুম্বইয়ের বোরা মুসলিম সমাজের তরুণী সালাহা ‘ওটা’ বলতে বুঝিয়েছিলেন তাঁর যোনি। আর যে দুঃস্বপ্নের মতো পর্বটার কথা সালাহা বলেছেন, সে পর্বের ভাল নাম ‘ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন’ (এফজিএম)। অর্থাৎ মেয়েদের যৌনাঙ্গচ্ছেদ (Female Genital Mutilation)। কোনও কোনও ধর্মীয় অভ্যেসে যে পদ্ধতি ‘খৎনা’ নামেও পরিচিত।
আজ, ৬ ফেব্রুয়ারি ‘জ়িরো টলারেন্স (zero tolerance) ডে এগেন্সট এফজিএম।’ অর্থাৎ ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন সহ্য না করার বার্ষিক দিবস। আর বছরের সেই একটা দিন আসার সঙ্গেই আরও এক বার সামনে এসেছে, সারা বিশ্ব জুড়ে এফজিএম ‘টলারেন্স’-এর সংখ্যা এখনও কতটা বেশি! পরিসংখ্যান বলছে, জার্মানি, সোমালিয়া, সুদান, আফ্রিকা এমনকী ভারতেও বোরা মুসলিম সমাজের মেয়েদের মধ্যে যত এফজিএম হয়, সেটা এই ২০২৩ সালেও আশঙ্কাজনক রকমের বেশি। অঙ্কের হিসেবে, সারা দুনিয়ার প্রতি ২০টি মেয়ের মধ্যে এক জন এই বর্বর প্রথার শিকার হয় নানা বয়সে। আর এর বিরুদ্ধে কোনও শাস্তির বিধানও নেই বিশ্বের কোথাও। নেই কড়া আইনও।
এফজিএম সহ্য না করার বার্তায় যে দিবস নির্ধারিত হয়েছে, সেই দিবসই যেন মনে করিয়ে দেয়, বিশ্ব জুড়ে বাড়ছে এফজিএম সহ্য করে মুখ বুজে থাকা মেয়েদের সংখ্যা! পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সংগঠিত প্রতিবাদও।ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের ২৯টি দেশে ব্যাপক ভাবে এই রীতি চালু রয়েছে আজও। যদিও এদের মধ্যে ২৪টি দেশেই এটি আইনত নিষিদ্ধ। কিন্তু আইন করে কবেই বা দূর করা গিয়েছে সামাজিক অত্যাচার? কোনও আইন কি পেরেছে, ধর্মীয় অত্যাচার থেকে বিশ্বকে মুক্ত করতে?
এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি, যার প্রমাণ পরিসংখ্যানেই রয়েছে। ইউনিসেফের হিসেবে আফ্রিকার একাধিক দেশ, ইন্দোনেশিয়া, ইয়েমেন, ইরাক, কুর্দিস্তান মিলিয়ে প্রায় ২৯টি দেশে এই মুহূর্তে ২০ কোটি মহিলা রয়েছেন যাঁদের পাঁচ থেকে দশ বছর বয়সের মধ্যে খৎনা হয়ে গিয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়ে দিয়েছে, এই পদ্ধতির কোনও স্বাস্থ্যকর দিক তো নেই-ই, বরং এর ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, সিস্ট, ঋতুকালীন সমস্যা, যৌন মিলনে তীব্র যন্ত্রণা বা মিলনে অক্ষমতা, এইচআইভি, সন্তানধারণ ও প্রসবের সময়ে জটিলতার মতো অজস্র সমস্যা মেয়েদের তৈরি হয় সারা জীবন ধরে। মা হওয়ার সময়ে শিশু-মৃত্যুও হয় অনেক।
এর বিরুদ্ধে এখন জোরদার প্রচার চালাচ্ছে বহু সংগঠন। আফ্রিকার গ্যাম্বিয়ায়, ছোটোবেলায় খৎনার শিকার মারিয়ামা জুফ এমনই এক সংগঠনের কর্মী হিসেবে কাজ করছেন এখন। তাঁর কথায়, ‘‘তখন আমি খুব ছোটো, বয়স বছর পাঁচেক হবে। আমাদের কয়েক জনকে একটা বাড়িতে নিয়ে গেল। ওখানে জোরে ড্রাম বাজানো হচ্ছিল আর এক এক জন মেয়েকে টেনে বাথরুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। রক্তাক্ত করা হচ্ছিল ওদের। ড্রামের শব্দে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল চিৎকার। আমাকেও টেনে নিয়ে গেল…. পরের তিন সপ্তাহ একটা পাত্রে জলের মধ্যে ছাগলের গু মিশিয়ে, গরম করে, তার মধ্যে আমাদের বসিয়ে রাখা হতো ব্যথা কমানোর জন্য।’’
সোমালিয়ার মালকো জামা নামে আর এক তরুণীর অভিজ্ঞতাও এমনই ভয়াবহ। ধারালো ছুরি দিয়ে তাঁর যোনির ক্লিটোরিস ও সেই সঙ্গে যোনির বাইরের অংশ, লেবিয়াও কেটে ফেলা হয় ছোটোবেলায়। দড়ি দিয়ে শক্ত করে পা দু’টি বেঁধে দেয় দাইরা। চার দিন ওই ভাবে, রক্তাক্ত অবস্থায়, একই জায়গায় বসে থাকতে হয় তাকে।
নারী অধিকার বিষয়ক সংগঠন ‘ট্যঁর দ্য ফ্যাম’-এর হিসেব বলছে, জার্মানিতে বর্তমানে এমন বোকা মুসলিম মেয়ের সংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার। গত বছরের তুলনায় যা ১২ শতাংশ বেশি! সোমালিয়ার ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি ৯৮ শতাংশ মহিলাই এর শিকার৷বাদ নেই ভারতও। এ দেশের বোরা মুসলিমদের মধ্যে এই এফজিএম বা মেয়েদের খৎনা করানোর প্রথা এখনও ব্যাপক ভাবে প্রচলিত বলে একটি সমীক্ষার রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া অন্তত ৭৫ শতাংশ নারীই এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন বলে স্বীকার করেছেন। রিপোর্টটি প্রস্তুত করেছে ‘উইস্পিকআউট’ নামে যে সংগঠন, তারা ভারতে আইন করে এই প্রথা নিষিদ্ধ করারও দাবি জানিয়েছে। তবে সরকারের বক্তব্য, ভারতে এফজিএমের ঘটনা ঘটছে বলে কোনও প্রমাণ নেই।
উইস্পিকআউটের মাসুমা রানালভি জানাচ্ছেন, “বোকা বানিয়ে বাচ্চা মেয়েদের এই ভয়াবহ পদ্ধতির শিকার বানানো হয়। তাদের মিষ্টি বা চকলেটের লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ‘চেম্বারে’। তার পরে কেটে দেওয়া হয় যৌনাঙ্গের অংশ। শিশুটির প্রচণ্ড ব্যথা তো তখন হয়ই, তার পরে এই মেয়েরা যখন বেড়ে ওঠে, তখন তাদের নানা শারীরিক ও মানসিক অস্বাভাবিকতায় ভুগতে হয়।”তবে সরকার স্বীকার না করলেও, এ দেশে খৎনা নিষিদ্ধ করার দাবিতে দায়ের হয়েছে মামলা। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে সেই মামলার শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, ‘‘কারও শরীরের অংশ থাকা বা না থাকা কী ভাবে ধর্মীয় প্রথার অংশ হতে পারে? কারও যৌনাঙ্গে অন্য কারও নিয়ন্ত্রণ থাকবে কেন?’’
এই মামলার পরে সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা পেশ করে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, ভারতে এফজিএমের অস্তিত্বের কথা ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’-তে নেই। এর জবাবে অ্যাক্টিভিস্টরা বলেছেন, যে-হেতু এফজিএম ভারতে কোনও অপরাধ বলেই স্বীকৃত নয়, তাই মেয়েদের খৎনা করানোর জন্য কাউকে দোষী বলেও চিহ্নিত করা যায় না।দিল্লির যে মহিলা আইনজীবী এই মামলা দায়ের করেছিলেন, সেই সুনীতা তিওয়ারি বলছিলেন, ‘‘একেবারে ছোটবেলায় যখন বোধবুদ্ধি বা প্রতিবাদের ক্ষমতা তৈরি হয় না, তখনই মেয়েদের ‘ক্লিটোরিস’ বা যৌন সুখানুভূতির প্রত্যঙ্গটি কেটে দেওয়া হয়! সমাজে একটা বিশেষ শব্দবন্ধও চালু রয়েছে এই অঙ্গের বিশেষণ হিসেবে— ‘হারাম কি বোটি’। অর্থাৎ অপবিত্র মাংসপিণ্ড। তাই তাকে নাকি শরীর থেকে দূর করাই শ্রেয়। আসলে এ হল পিতৃতন্ত্রের চাপিয়ে দেওয়া লিঙ্গবৈষম্যের এক চরম নিদর্শন। মেয়েদের আবার যৌন আনন্দ কীসের? তার যৌনতা শুধু সন্তান উৎপাদনের জন্য থাকলেই যথেষ্ট। তাই সমাজ এমন ব্যবস্থা করেছে, যাতে মেয়েদের সুখানুভূতির প্রত্যঙ্গটাকেই বাদ দিয়ে দেওয়া যায়!”
ভারতে খৎনা-বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম কর্মী আরিফা জোহরি জানালেন, রাষ্ট্রপুঞ্জের ঘোষণায় মহিলাদের যৌনাঙ্গ বিকৃত করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে। ২০১২ সালেই রাষ্ট্রপুঞ্জ একে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ভারতও তাতে সই করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। বেশ কিছু এলাকায় এখনও দাইমা বা বাড়ির বয়স্ক মহিলারা নিতান্ত অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে এটা করে যাচ্ছেন অ্যানাস্থেসিয়া ছাড়া। ব্যবহৃত হচ্ছে ব্লেড, ছুরি, কাঁচি, ভাঙা টিন, ভাঙা কাচ— সব কিছুই। বাড়ছে সংক্রমণ, হচ্ছে মৃত্যু। অভিযোগ, প্রশাসন চোখে ঠুলি পরে আছে।এই অমানবিকতার বিরুদ্ধেই শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বের মেয়েরা এখন আন্দোলনে একজোট। এ আন্দোলন আর পাঁচটা নারীসুরক্ষা রক্ষার আন্দোলনের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে অনেকেই বলছেন, শুধু আইন প্রনয়ণ নয়, এ প্রথা বন্ধ করার জন্য দরকার শিক্ষা। দরকার ধর্মীয় অন্ধত্ব থেকে মুক্তি। আর এ সব কিছুর জন্যই সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা।
সেই সচেতনতার বার্তা নিয়েই বিশ্ব জুড়ে স্বীকৃত হয়েছে ‘জ়িরো টলারেন্স ডে এগেন্সট এফজিএম’। দাবি একটাই, নির্মূল হোক ধর্মের নামে বর্বরতার অভ্যেস।

এমএইচ ৩৭০: কোথায় হারিয়ে গেল আস্ত একটা বিমান! ন’বছর পরেও গভীর রহস্য