
রূপাঞ্জন গোস্বামী
করাচি, পাকিস্তানের বন্দর শহর। পাকিস্তানের সাবেক রাজধানী এবং বর্তমানের অলিখিত অর্থনৈতিক রাজধানী। পাকিস্তানের সবচেয়ে ঘন জনবসতিপূর্ণ শহর। করাচি শহরের অনেক কিছুই নাকি নিয়ন্ত্রণ করে মাফিয়ারা। ভারতের মোস্ট ওয়ান্টেড দাউদ ইব্রাহিম নাকি শাগরেদ ছোটা শাকিলকে নিয়ে বাস করেন এই শহরের অভিজাত ক্লিফটন এলাকায়।
দ্য ইকোনোমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট-এর ২০১৭ সালে করা এক সমীক্ষায় দাবি করা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক শহর হলো পাকিস্তানের করাচি। আন্ডারওয়ার্ল্ডের গ্যাংওয়ারের জন্য করাচি বিখ্যাত। প্রতিনিয়ত খুনোখুনি লেগেই থাকে।
কিন্তু জানেন কি , এই করাচি শহরে বাস করেন প্রায় ২০ লাখ বাংলাভাষী মানুষ। হ্যাঁ, বাংলা ভাষায় কথা বলেন। আড় মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে জর্দা পান মুখে দেন। তাঁদের কলোনির রাস্তায় হাঁটলে শুনতে পাবেন বাংলাদেশের মুমতাজের হিট গান, ‘খায়রুল লো তোর লম্বা মাথার কেশ’। হ্যাঁ, পাকিস্তানের করাচির বাঙালিদের বাড়িতে বাড়িতে আজও চলে রুনা লায়লা, মুমতাজ, অ্যান্ড্রু কিশোরের সঙ্গে কিশোর কুমার, আশা ভোঁসলের বাংলা গান।
করাচি ইউনিভার্সিটি থেকে বাংলায় মাস্টার্স করা যায়। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ানো হয় রবীন্দ্রনাথের গোরা, নজরুলের অগ্নিবীণা থেকে জসীমউদ্দীনের নক্সী কাঁথার মাঠ। পড়ানো হয় হুমায়ুন আহমেদ, সুনীল, শক্তি, মানিকও। একসময় কওমী-বন্ধন এবং মুক্তি নামে বাংলাভাষার দুটি দৈনিক সংবাদপত্রও বের হতো পাকিস্তানের করাচি থেকে। তাই করাচিকে ‘মিনি বাংলাদেশ’ বলে থাকেন পাকিস্তানের মানুষ। করাচির মাচ্ছি কলোনি, বাঙ্গালী কলোনি, বাংলাবাজার কলোনি, চিটাগং কলোনি, মুসা কলোনি, ইব্রাহিম হায়দারির মতো প্রায় ১৩২টি বাঙালি কলোনি আছে করাচির আশপাশে।
এত বাঙালি করাচিতে এলেন কোথা থেকে!
করাচিতে বাঙালিরা প্রথম আসেন কিন্তু ব্রিটিশ আমলেই। মাছ ধরার কাজে বাঙালির পারদর্শিতার জন্য বর্তমান বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে জেলেদের নিয়ে যান করাচির উর্দুভাষী ব্যবসায়ীরা। সমুদ্রের ধারে জেলেদের কলোনি গড়ে দেন। সময়টা ছিলো বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ। এই বাঙালি মৎসজীবীরা দ্রুত করাচির উর্দুভাষী বাসিন্দাদের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেন।
দ্রুত শিখে নেন উর্দুভাষা, বাংলা ভোলেন না। পরবর্তী সময়ে, ভারতের স্বাধীনতার পর পুর্ব-পাকিস্তান (বাংলাদেশ) থেকে প্রচুর সংখ্যায় বাঙালি করাচিতে আসেন। পাকিস্তানের হাত থেকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পাকিস্তান থেকে বেশ কিছু বাঙালি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। কিন্তু বেশিরভাগই রয়ে যান করাচিতে।
অপর দিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নাকি বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চল থেকে প্রচুর সংখ্যায় রাজাকার পালিয়ে এসে করাচিতে বসবাস শুরু করেন। জীবিকার সন্ধানে প্রচুর বাঙালি নোয়াখালী ও কুমিল্লাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে করাচিতে আসেন ৮০ ও ৯০-এর দশকে । ঐ সময় বাংলাদেশি টাকার তুলনায় পাকিস্তানি টাকার দাম ছিলো প্রায় দ্বিগুণ। এ ছাড়াও বার্মিজ বৌদ্ধদের হাত থেকে বাঁচতে ৫ লক্ষ রোহিঙ্গা সমুদ্রপথে বা চোরাপথে করাচিতে এসে ওঠেন।
১৯৯৫ সালে পাকিস্তানে বাংলাভাষীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫ লাখ। এর মধ্যে করাচিতেই প্রায় ২০ লাখ। ভারত থেকে করাচিতে এসেছেন প্রায় এক কোটি হিন্দী ও উর্দুভাষী মুসলিম। তা ছাড়া করাচিতে আছেন সাড়ে ছয় লাখ আফগানি, হাজার পাঁচেক ইরানি,হাজার কয়েক নেপালি, শ্রীলঙ্কান এবং ফিলিপিনো এবং বার্মা থেকে আসা লাখ পাঁচেক রোহিঙ্গা। সুতরাং জীবিকার তাগিদে, অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে করাচিতে শুরু হয়ে গেলো জায়গা দখলের লড়াই।
সত্যিই কি ভালো আছেন করাচির বাঙালিরা
১৯৭১ সালের আগে করাচির বাঙালিরা তবুও ভালো ছিলেন। ভারত ছেড়ে পাকিস্তানকে আপন করেছিলেন বলে পাকিস্তানও পুরোপুরি না হলেও কিছুটা আপন করে নিয়েছিল বাংলাভাষীদের। কিন্তু ১৯৭১ পাল্টে দিলো সব। ভারতকে সঙ্গে নিয়ে পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালিরা তৈরি করলেন স্বাধীন বাংলাদেশ। কপাল পুড়ল পশ্চিম পাকিস্তানে থাকা বাঙালিদের। সেই থেকে তাঁরা পাকিস্তানে ‘মীরজাফর’ । পাকিস্তানি সমাজের সর্বস্তরে ঘৃণা, বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়ে চলেছেন পাকিস্তানকে আপন ভাবা এই মানুষগুলি ।
এদিকে বেনজির ভুট্টোর শাসনকালে পাকিস্তান ঈশান কোনে মেঘ দেখতে শুরু করলো। ভারত থেকে আগত উর্দুভাষী মোহাজির জনগোষ্ঠীর পরেই জনসংখ্যার দিক থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠছে বাংলাভাষী ‘বাঙ্গালী’ জনগোষ্ঠী। করাচি ক্রমশ ভূমিপুত্রদের হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাই ভুট্টো পাকিস্তান থেকে বাংলাভাষী, আরও স্পষ্ট করে বললে ‘বাংলাদেশি হটাও‘ অভিযান শুরু করেন। বেনজির ভুট্টোর অতি সক্রিয়তার পেছনে আরেকটি কারণ খুঁজে পান অনেকে। সেটি হলো ভোটাধিকার না থাকলেও, করাচির বাংলাভাষীরা বেশিরভাগই পাকিস্তান মুসলিম লীগের সমর্থক। যেটি বেনজির ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির বিরোধী দল।
যাইহোক, বেনজির ভুট্টো সরকার বেনজিরভাবেই পাকিস্তান থেকে বিমান ভর্তি করে বাংলাভাষী মানুষদের পাঠিয়ে দেন বাংলাদেশে । যা নিয়ে বেনজির ভুট্টোর পাকিস্তানের সঙ্গে খালেদা জিয়ার বাংলাদেশের সম্পর্কের চুড়ান্ত অবনতি ঘটে। খালেদা জিয়া, পাকিস্তানের পাঠিয়ে দেওয়া দুই বিমানভর্তি বাংলাভাষী শরণার্থীদের নিতে অস্বীকার করেন। দুটি বিমানকেই পত্রপাঠ ফেরত পাঠান পাকিস্তানে। ইতিমধ্যে পাকিস্তান মুসলিম লিগ ও ধর্মীয় সংস্থাগুলি বেনজির ভুট্টোর এই কাজকে ইসলামবিরোধী বলে আন্দোলনে নেমে পড়েন। ফলে বেনজির ভুট্টোকে পিছিয়ে আসতে হয়। রয়ে যান ২০ লাখ বাঙালি করাচিতেই।
বংশপরম্পরায় পাকিস্তানে থেকেও আজও বাংলাভাষীদের পাকিস্তানের জাতীয় পরিচয়পত্র মেলে না। নাগরিকত্ব দূরের কথা। ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে কাজ করতে হয়। তাও নিতে হয় ঘুরপথে অনেক টাকা ঘুষ দিয়ে। বাস করতে হয় ঘিঞ্জি বস্তিতে। চারদিকে নোংরা জল এবং আবর্জনার মধ্যে। দিনের মধ্যে কুড়ি ঘণ্টা বিদ্যুৎ সংযোগ থাকে না। পানীয় জল আসে দিনে একবার।
এলাকার বাইরে বার হলে পুলিশি ঝামেলা লেগেই থাকে। করাচির মফস্বলে ‘পাকিস্তানি বেঙ্গলি অ্যাকশন কমিটি‘ নামে বাঙালিদের একটি সংগঠন সক্রিয়। তাঁদের কাছ থেকে জানা যায়, জাতীয় পরিচয়পত্র মেলেনা বলে পাকিস্তানের বাঙালিরা উচ্চশিক্ষা এবং সরকারি চাকরি পান না। জমি বাড়ি কিনতে পারেন না। ভাড়া নিয়ে থাকতে হয়।
উচ্চশিক্ষা না থাকার ফলে ছোটোখাটো কাজে লেগে যাচ্ছেন নবীন প্রজন্মের বাঙালিরা। এঁরা কেউ রাস্তার পাশে সব্জি বেচেন, কেউ চায়ের দোকানে বা মুদি দোকানে কাজ করেন, কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যান। বেশির ভাগই কলোনির বাইরে খুব একটা বার হন না। ফলে কলোনির ভেতরেই ‘পাঠান’ আর আফগানিদের ছোটোখাটো ফ্যাক্টরিতে নামমাত্র পয়সায় দিনমজুরের কাজ করতে হয় অধিকাংশ বাঙালিকে।
অথচ করাচির মৎস্যশিল্প দাঁড়িয়ে আছে বাঙালি শ্রমিকদের ওপর। পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা সস্তা শ্রমিক পান। তাই তাঁরা চান না বাঙালিরা পাকিস্তান ছেড়ে চলে যান। কিন্তু বাঙালিদের নাগরিকত্ব বা তাঁদের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়নের জন্য তাঁরা আদৌ চিন্তিত নন।
পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান আসাদ ইকবাল বাট একবার বিবিসিকে বলেছিলেন বাঙালিদের মর্মান্তিক অবস্থার কথা, “একজন অবাঙালি পাকিস্তানি শ্রমিক যেখানে মাসে ১২-১৩ হাজার রুপি মজুরি পান, একজন বাঙালি শ্রমিক পান তার অর্ধেক। বাঙালি মেয়েরা ফ্যাক্টরি এবং লোকের বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে শুধু যে পয়সা কম পান তা নয়, তাঁরা অনবরত যৌনশোষণের শিকারও হচ্ছেন “।
আসাদ সাহেব আরও বলেন, “সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশ সৃষ্টির পর বাঙালিরা পাকিস্তানে ঘৃণার শিকার হয়ে পড়েন। পাকিস্তানে বাঙালিদের ঘৃণার চোখে এবং বিশ্বাসঘাতক হিসাবে দেখা শুরু হয়। খোলাখুলি ভাবেই বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য শুরু হয়”।
পাকিস্তানে বাঙালিদের জীবনযাত্রার মান একশো বছরেও উন্নত না হওয়ার বড় কারণ হলো, বাঙালিরা পাকিস্তানের নাগরিক নন। যেহেতু নাগরিক নন তাই তাঁদের ভোট নেই। যেহেতু ভোট নেই পাকিস্তানের রাজনীতিকদের কাছে বাঙালিদের কোনও দাম নেই।
সম্প্রতি পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অবশ্য বলেছেন, “অনেক আফগান এবং বাঙালি গত চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর ধরে করাচিতে বাস করছেন। এখানে তাঁদের সন্তানরা জন্মেছেন। ইনশাআল্লাহ,আমরা তাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট দেব”। কিন্তু পাকিস্তানের বাঙালি রাজনৈতিক নেতাদের স্তোকবাক্যে আর ভুলতে রাজি নন। তাই করাচির বেশিরভাগ বাঙালি নেমেছেন অধিকার আদায়ের আন্দোলনে।
অমানুষিক বৈষম্য ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে করাচির বেশ কিছু বাঙালি পরিবার বাংলাদেশে ফিরে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। ঠিক যেভাবে পাকিস্তানের হিন্দুরা চেষ্টা করছেন ভারতে ফেরার। প্রতিদিনই শয়ে শয়ে বাঙালি করাচির বাংলাদেশি কনস্যুলেটে গিয়ে বাংলাদেশের ভিসার জন্য আবেদন করছেন।
তাঁরা হয়ত বুঝেছেন এক গাছের ছাল কখনও অন্য গাছে লাগানো যায়না। তাঁরা বুঝেছেন ‘ খাঁটি সোনার চাইতে খাঁটি আমার দেশের মাটি’। কিন্তু বুঝতে অনেক দেরি হয়ে গেল।