শেষ আপডেট: 18th January 2025 13:33
গোলগাল মুখ। কপালের উপর আঁচড়ে তোলা চুল। বয়স কুড়িও পেরোয়নি। পেশায় খুদে সাংবাদিক। নেশায় অনুসন্ধানী। আদ্যোপান্ত অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। সঙ্গী বরফ-সাদা কুকুর। তাকে নিয়ে কখনও কঙ্গো, কখনও তিব্বত—আবিশ্ব ছুটে চলে সে। দু:সাহসী এই কিশোর, টিনটিন যার নাম, তাকে কমিকসের পাতায় এঁকেছিলেন বেলজিয়ামের কার্টুনিস্ট অ্যার্জে।
১৯২৯ সালে ‘ল্য ভাঁতিয়েম সিয়েকল’ নামে এক সংবাদপত্রের ক্রোড়পত্রে ছাপা হয় টিনটিনের রোমাঞ্চকর কিস্যা। প্রথম গল্প ‘সোভিয়েতে টিনটিন’। তারপর দুনিয়াজুড়ে নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে তার দুর্ধর্ষ-দুর্দান্ত কাহিনি।
বাংলায় টিনটিনের আগমন সাতের দশকে। ১৯৭৫ সালে আনন্দমেলা পত্রিকায় আত্মপ্রকাশ করে ‘বোম্বেটে জাহাজ’ ও ‘লাল বোম্বেটের গুপ্তধন’। নেপথ্য-নায়ক পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তাঁর স্বচ্ছ, সাবলীল অনুবাদের গুণে বিদেশি ছাপছোপ মুছে খাঁটি দেশজ জলহাওয়ায় এক অর্থে জন্মান্তর হল টিনটিনের।
এরপর গড়িয়েছে সময়। নতুন মুদ্রণে ছেপে বেরোলেও আর লেখা হয় না টিনটিন। তবু বইপাড়ায় উঁকিঝুঁকি দিলে নজরে আসে, এখনও হটকেকের মতো বিকোচ্ছে অ্যার্জের লেখা, নীরেনবাবুর অনুবাদ করা এই সিরিজ। সোশ্যাল মিডিয়ায় কান পাতলে শোনা যায় বইয়ের দাম প্রায় গুণোত্তর হারে বেড়ে যাওয়া নিয়ে সমবেত দীর্ঘশ্বাস! আলাদা করে প্রতিটি কমিক্স আলমারিতে থাকা সত্ত্বেও সদ্যপ্রকাশিত বক্স-সেট কিনতে তৎপর হয় পাঠক। বয়স-নির্বিশেষে সক্কলে গোগ্রাসে পড়তে চায় টিনটিন। কিন্তু প্রশ্ন উঠবে, কেন? ঠিক কোন যাদুমন্ত্রে পরদেশি খুদে কিশোরকে নিয়ে এখনও বুঁদ হয়ে রয়েছে বাঙালি?
প্রথম কারণ হিসেবে অবশ্যই বলতে হয় কমিক্সের প্রযোজনা (প্রোডাকশন)-র কথা। এর মধ্যে আসবে ছাপা, বাঁধাই, মলাট, প্রচ্ছদ, বইয়ের ভেতরে ছবির গুণমান এমনকী কথা-বেলুন ও ক্যাপশনের মুদ্রণও! টিনটিনের বইয়ে ছবি ও শব্দ মিলেমিশে আছে, একে অন্যের সঙ্গে তালগোল পাকিয়ে যায়নি। পাঠক, বিশেষ করে শিশুদের চোখে এই ছিমছাম (মিনিম্যালিস্ট) সজ্জা বরাবর উপাদেয়। ভারী ভারী, রাশি রাশি পড়ার বইয়ে খুদে ফন্টে ঠাসাঠাসি করে গাঁথা শব্দস্রোত থেকে মুক্তি এনে দেয় টিনটিনের পাতা। তাই হাতে নেওয়া মাত্র তার প্রেমে পড়ে বাঙালি খুদে—সে যুগে, এ যুগে, সব যুগে।
চোখের আস্বাদ ফুরোলে আসে হৃদয়, আসে বুদ্ধি, আসে মন। প্রচ্ছদ পেরিয়ে পাতা ওল্টালেই নজর কাড়ে ভাষা—স্বচ্ছ কিন্তু তরল নয়; নির্মেদ অথচ সারহীন নয়। টিনটিন অনুবাদে এক অদ্ভুত ভাষাভঙ্গির জন্ম দিয়েছিলেন নীরেন্দ্রনাথ।
কখনও গ্রহণ, কখনও বর্জন, কখনও রূপান্তর—প্রয়োজন বুঝে মূল রচনার খোলনলচে নিয়ে নিরীক্ষা চালিয়েছেন তিনি। নীরেন্দ্রনাথের কলমে সাদারঙা ‘স্নোয়ি’ হয়ে গিয়েছে আদুরে ‘কুট্টুস’, ‘ব্রুটাস’ (যে শব্দের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার অনুষঙ্গও জুড়ে!) বনে গিয়েছে পরম অনুগত ‘বাঘা’, জটিল উচ্চারণের থম্পসন-থমসন তুলনায় সহজশ্রাব্য জনসন-রনসন। কলি হিসেবে জুড়ে গিয়েছে মজার বাংলা গান ‘তোমার রূপের তুলনা কোথায়? সুন্দরী লো…’।
পাশাপাশি ইংরেজির অপশব্দ, ধর্মীয় অনুষঙ্গে ভরা বিষয়কে বাদ দিয়েছেন সম্পাদক। ‘স্লেভ ট্রেডার্স’ বদলেছে ‘ছারপোকা’-য়, ‘সোয়াইন’ ছেঁটে ‘উল্লুক’—শুধু বিতর্ক এড়াতে নয়, এই পরিবর্তন আমদানি করে নির্ভেজাল, বিশুদ্ধ মজা-ও! ‘হুঁশিয়ার’, ‘মাণিকজোড়’, ‘কুকুরমশাই’-এর মতো শব্দ ইংরেজি থেকে আক্ষরিক তর্জমায় লেখা সম্ভব নয়। ভাষার এই ছোট ছোট চেহারা-বদল অনুদিত টিনটিনের জনপ্রিয়তাকে কালের ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে।
বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলও টিনটিনকে দু’হাত বাড়িয়ে আত্মস্থ করেছে। সত্যজিৎ রায়ের কথাই ধরা যাক৷ যখন এদেশে পাওয়া যেত না, তখন থেকেই সত্যজিৎ বিদেশ থেকে টিনটিনের ইংরেজি কমিক্স আনাতেন। পুত্র সন্দীপের আগে নিজেই একটানে সেসব পড়ে ফেলতেন।
তাঁর চলচ্চিত্রেও রয়েছে টিনটিনের প্রসঙ্গ। আমাদের মনে থাকবে ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’র কথা। সেখানে তোপসেকে ‘তিব্বতে টিনটিন’ পড়তে দেখা যায়৷ ‘সোনার কেল্লা’-য় তার হাতে থাকে ‘কালো সোনার দেশে’। এমনকী এই ছায়াছবির খলনায়ক নকল ডা. হাজরা (ভবানন্দ)র সঙ্গে মিলে যায় টিনটিনের গল্পের ভিলেন মি: মুলারের মুখ! মুলার যেখানে সাইকোলজিস্ট, হাজরা সেখানে প্যারা সাইকোলজিস্ট। এই ‘মিল’ কি নেহাতই আপতিক? কোনওভাবে ‘হাইলি সাসপিসিয়াস’ নয়?
একদম হাল আমলের ছায়াছবি ‘জগগা জাসুস’-এ রণবীর কাপুরের হেয়ারস্টাইলের কথাও যদি ভাবি, সেখানেও কিন্তু টিনটিনের চুলের আঁচড়ের প্রভাব উঁকি মেরে যায়!
আসলে টিনটিনের কমিক্স ‘কিশোর’ নয়, ‘কৈশোর’-কে উদযাপন করে। এই ‘কৈশোর’ আমরা প্রত্যেকে নিজেদের মনে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। টিনটিন পক্ষ নেয় না। আমরাও চেষ্টা করি নিরপেক্ষ থাকতে। টিনটিন নূতনের পূজারী, সে চিরকালের অনুসন্ধানী। হয়তো সেই কারণেই টিনটিনের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে অনেক মন্তব্যের ভিড়ে একজন বাঙালি লিখে রাখেন-- “টিনটিনের জন্যই আমার মতো মধ্যবিত্ত, ছোট শহরের এক ছেলে সৎ, সাহসী ও উৎসুক বৈজ্ঞানিক হতে পেরেছে… সে এখনও টিনটিন ও তার বন্ধুদের সঙ্গে নতুন অ্যাডেভেঞ্চারে বেরোনোর স্বপ্ন দেখে!”