শেষ আপডেট: 11th March 2025 13:09
বিশ্বের দরবারে জনপ্রিয় ভারতীয় ডিশ কি? প্রশ্নটি করলেই বিশ্ববাসী এক বাক্যে বলবেন 'বিরিয়ানি'(Biryani)। কারণ ভারতীয় বিরিয়ানির (Biryani Stories) প্রাণ কেড়ে নেওয়া সুগন্ধ, চুম্বকের মত তাঁদের টেনে নিয়ে যায় ভারতীয় রেস্তোরাঁগুলিতে। কিন্তু যে বিরিয়ানির জন্য ভারতের বিশ্বজোড়া নাম, তার উৎস হল প্রাচীন পারস্য (Persia)। মালিকানা পারস্যের হলেও, বিরিয়ানিকে ভারতের মাটিতে আকাশছোঁয়া উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন মুঘল সম্রাটরা। তাঁদের হাতেই হয়েছিল বিরিয়ানির ভারতীয়করণ (who brought biriyani to India)। অনুপ্রবেশকারী হলেও, একসময় বিরিয়ানি জয় করে নিয়েছিল ভারতবাসীর মন। এই ভারত থেকেই বেরিয়ে পড়েছিল বিশ্ববিজয়ে। কিন্তু কীভাবে!
অতি সরলভাবে বলতে গেলে, বিরিয়ানি (Biryani) হল মাংস মিশ্রিত ভাত। প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে বিরিয়ানির সমগোত্রীয় খাবারের প্রচলন ছিল। তার মধ্যে পলান্ন বা পোলাওয়ের (Pilaf) কথা আমরা সবাই জানি। পলান্ন শব্দের অর্থ পল (মাংস) মিশ্রিত অন্ন। গিরিশচন্দ্র বেদান্ততীর্থ তাঁর 'প্রাচীন শিল্প পরিচয়' গ্রন্থে লিখেছেন প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে পললৌদন বা পলান্নের প্রচলন ছিল।
পোলাও তৈরি করার জন্য প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহার করা হত চর্বিযুক্ত খাসির মাংস, সুগন্ধী বাসমতী চাল, ঘি, খোয়া ক্ষীর, আদা-পেঁয়াজ-রসুন বাটা, গোটা গরম মশলা, গুঁড়ো লঙ্কা, গোলমরিচ, জায়ফল, জয়িত্রি, লবণ ও চিনি।
প্রথমে খাসির মাংসকে ছোট ছোট টুকরোতে কেটে মাখিয়ে নেওয়া হত আদা-পেঁয়াজ-রসুন বাটা ও গুঁড়ো লঙ্কা। তারপর ধাতব পাত্রে পরিমাণ মত জল ঢেলে সেদ্ধ করা হত মাংস। সেই জলেই ফেলে দেওয়া হত পুঁটলি বাঁধা গোটা গরম মশলা। সেদ্ধ হওয়ার পর পাত্র থেকে মাংস তুলে নেওয়া হলেও, গরম মশলার পুঁটলিটি রেখে দেওয়া হত। মাংস সেদ্ধ করা জলে এরপর ফোটানো হত বাসমতী চাল। নির্দিষ্ট সময় পর, সুসিদ্ধ চালে মেশানো হত সেদ্ধ মাংসের টুকরো, ঘি ও বাকি মশলাগুলি। সব শেষে ভাতের ওপরে ছড়িয়ে দেওয়া হত খোয়া ক্ষীর।
শুধু ভারতই নয় একসময় এই পোলাও বিশ্ব জয় করেছিল। ভারতীয় বণিকদের হাত ধরেই পোলাও ছড়িয়ে পড়েছিল মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া, লাতিন আমেরিকা এবং ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে। এহেন পোলাওকেও হেরে যেতে হয়েছিল বিরিয়ানির কাছে। কম মশলায় রাঁধা পোলাওকে আপন করে নেননি বাদশাহ, নবাবেরা। কারণ তাঁরা ছিলেন মশলাদার খাবারের ভক্ত। তাই তাঁরা ভোট দিয়েছিলেন বিরিয়ানির পক্ষে।
প্রাচীন কাল থেকেই দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত ছিল বিরিয়ানির (Biryani ) সমগোত্রীয় 'ওন সরু' নামের পদটি। তাঁর লেখায় জনপ্রিয় ভারতীয় পদ হিসেবে ওন সরুর কথা উল্লেখ করে গিয়েছিলেন ইরানীয় পণ্ডিত এবং বহুবিদ্যাবিশারদ আল-বিরুনি। এই 'ওন সরু' রাঁধার জন্য লাগত মাংস, শ্রীরাগা সম্ভা চাল, নারকেলের দুধ, ধনে-হলুদ গুঁড়ো, আদা-রসুন বাটা ও গরম মশলা। এছাড়াও লাগত ঘি, ছোট পেঁয়াজ, ধনে পাতা, পুদিনা পাতা, কাঁচা লঙ্কা, গোটা গোলমরিচ, গোটা জিরে ও গোটা দারুচিনি।
রন্ধনশৈলী ছিল একটু ভিন্ন ধরনের। প্রথমে পাত্রে ঘি দিয়ে গোটা গরম মশলা ছেড়ে দেওয়া হত। তারপর পাত্রে দেওয়া হত আদা-রসুন বাটা ও কাঁচা মাংস। মিনিট পাঁচেক পর, গোটা লঙ্কা, গোটা পেঁয়াজ, পুদিনা পাতা, ধনে গুঁড়ো ও গরম মশলা বাটা কড়ায় দিয়ে ভাল করে কষা হত। সুগন্ধ ওঠার পর পাত্রে দেওয়া হত শ্রীরাগা সম্ভা চাল। আবার কিছুক্ষণ ধরে কষার পর পাত্রে ঢেলে দেওয়া হত নারকেলের দুধ, ধনে পাতা বাটা ও লবণ। চাল ও মাংস সুসিদ্ধ হওয়ার পর পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘি মিশিয়ে গরম গরম পরিবেশন করা হত 'ওন সুরু'। এহেন সুস্বাদু ওন সরুকেও হেরে যেতে হয়েছিল বিরিয়ানির কাছে। মশলাদার খাবারের ভক্ত নিজামদের মন ছুঁতে না পারায়।
বিরিয়ানির নাম ইরানে ছিল 'বিরিঞ্জ বিরিয়ান' (Birinj Biryan)। 'বিরিঞ্জ' শব্দের অর্থ হল ভাত এবং 'বিরিয়ান' শব্দটির অর্থ হল 'রান্নার আগে ভেজে নেওয়া"। প্রাচীন পারস্যের খুবই জনপ্রিয় একটি পদ ছিল এই 'বিরিঞ্জ বিরিয়ান'। প্রাচীনকালে পারস্য থেকেই ভারতে আসত দুর্লভ আতর ও অনান্য গন্ধদ্রব্য। ঠিক সেভাবেই পারস্যের ব্যবসায়ীদের হাত ধরেই ভারতে প্রবেশ করেছিল পারস্যের 'বিরিঞ্জ বিরিয়ান'। নাম হয়েছিল 'বিরিয়ানি'(Biryani)।
অনেকে বলেন, চতুর্দশ শতকের মহাপরাক্রমশালী মোঙ্গল সেনাধ্যক্ষ তৈমুর লঙের (Timur Lang) কথা। সিরিয়া থেকে চিনের কাশগড় পর্যন্ত ছিল যাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি। পারস্যের 'বিরিঞ্জ বিরিয়ান' ছিল নাকি তাঁর মনপসন্দ ডিশ। এবং তৈমুরের সেনাদের হাত ধরেই ভারতে প্রবেশ করেছিল বিরিয়ানি (Biryani)। কিন্তু সবথেকে বিশ্বাসযোগ্য মতবাদটি জড়িয়ে আছে মুঘল রাজত্বের সঙ্গে।
মধ্য এশিয়ার তুর্কিস্তানের ফারগানা থেকে ভারতে এসে, জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবর গড়ে তুলেছিলেন সুবিশাল মুঘল সাম্রাজ্য। তাঁর হাত ধরেই নাকি ভারতে প্রবেশ করেছিল পারস্যের 'বিরিঞ্জ বিরিয়ান'। এই মতবাদটি সম্ভবত সত্যি। কারণ মুঘল সম্রাটদের বিরিয়ানি প্রীতি বিশ্ববিদিত। সম্রাট আকবর তো রীতিমত গবেষণা করে, স্বাদ ও গন্ধের দিক থেকে বিরিয়ানিকে নিয়ে গিয়েছিলেন আকাশছোঁয়া উচ্চতায়। আকবরি বিরিয়ানির জন্য বাছাই করা চালের প্রতিটা দানার গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হত 'সিলভার অয়েল'। গুরুপাক বিরিয়ানি হজমে সাহায্য করত এই তেল। সক্রিয় ভূমিকা নিত সম্রাটের যৌনশক্তি বৃদ্ধিতেও।
এছাড়া আকবরি বিরিয়ানির জন্য আফগানিস্তান থেকে আনা হত বিশেষ প্রজাতির মুরগি। দিল্লির প্রাসাদে গড়ে তোলা খামারে মুরগিগুলিকে যত্ন করা হত কয়েক মাস ধরে। মাটিতে ছড়িয়ে নয়, হাতে করে খাওয়ানো হত বাছাই করা দানা। সেই দানাগুলিতে মেশানো থাকত জাফরান। মুরগিগুলিকে পান করানো হত সুগন্ধি গোলাপ জল। এতেই শেষ নয়, রোজ বিকেলে মুরগিগুলির গায়ে মালিশ করা হত কস্তুরি ও চন্দন তেল। ফলে আকবরি বিরিয়ানির মাংসে থাকত না আঁশটে গন্ধ। মাংস হত নরম, সুস্বাদু ও সুগন্ধী।
ভারতে আসার পর, একমাত্র মুঘল সম্রাটদের খাবার টেবিলেই শোভা পেত বাষ্প ওঠা সুরভিত বিরিয়ানি। কিন্তু পরবর্তীকালে একটি অদ্ভুত ঘটনার মাধ্যমে বিরিয়ানি হয়ে গিয়েছিল আমজনতার। একবার সম্রাট শাহজাহানের সঙ্গে রণক্ষেত্র পরিদর্শনে গিয়েছিলেন বেগম মমতাজ মহল (Mumtaz Mahal)। রণক্ষেত্রে গিয়ে মুঘল সম্রাটের সৈন্যদের দেখে আঁতকে উঠেছিলেন মমতাজ।
দিগ্বিজয়ী সম্রাটের সৈন্যদের এ কী অবস্থা! এই জীর্ণ শীর্ণ চেহারার সৈন্যদের নিয়ে যুদ্ধ জেতার আশা করছেন সম্রাট শাহজাহান! পত্রপাঠ মুঘল সেনাদের জন্য পুষ্টিকর বিরিয়ানি রাঁধার আদেশ দিয়েছিলেন মমতাজ। সেই প্রথম বিরিয়ানির স্বর্গীয় স্বাদ পেয়েছিল সাধারণ সৈন্যরা। মমতাজের আদেশে নিয়মিত বিরিয়ানি রাঁধা হতে লাগল মুঘল সৈন্যদের জন্য। প্রথমে এই মুঘল সৈন্য, পরবর্তীকালে ভারতের বিভিন্ন নবাব ও নিজামদের হাত ধরে ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল বিরিয়ানি।
ভারতে প্রধানত দুটি পদ্ধতিতে রাঁধা হয় বিরিয়ানি। পদ্ধতি দু'টির নাম 'কাচ্চি' ও 'পাক্কি'। কাচ্চি বিরিয়ানিতে মাংস ও চাল, একই পাত্রে একসঙ্গে রান্না করা হয়। পাক্কি বিরিয়ানিতে মাংস ও চাল আলাদা আলাদা রান্না করা হয়, কিন্তু পরিবেশন করা হয় এক সঙ্গে। আজ এই 'কাচ্চি' ও 'পাক্কি' রন্ধনশৈলীর ছাতার নিচে আছে প্রায় আশি ধরণের বিরিয়ানি। তবে এগুলির মধ্যে সব থেকে ওপরে আছে হায়দরাবাদী, লক্ষ্ণৌ (অওধি) ও কলকাতা বিরিয়ানি।
হায়দরাবাদের নিজামের রুসুইঘরে উৎকর্ষ লাভ করা হায়দরাবাদী বিরিয়ানিতে ব্যবহার করা হয়, রেওয়াজি খাসির মাংস, ঘি, পেঁয়াজ, লবঙ্গ, দারুচিনি, পেপে বাটা, তেজপাতা, এলাচ, জায়ফল, কেওড়া বীজ, জইত্রি, মৌরি, লাল ও সবুজ লঙ্কা, আদা, রসুন, লেবু, জাফরান, ধনে পাতা ও দই। একবার এই বিরিয়ানির স্বাদ নিলে তা ভোলা কঠিন। তাই অনেক পর্যটক এই বিরিয়ানি খাওয়ার লোভেই হায়দরাবাদকে দক্ষিণ ভারত ট্যুরের মধ্যে জুড়ে নেন।
পিছিয়ে নেই কলকাতা বিরিয়ানিও। নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ, ১৮৫৮ সালে মেটিয়াবুরুজে আসার পর কলকাতায় প্রচলিত হয় 'কলকাতা বিরিয়ানি'। নবাবের বেগমদের হাতে তৈরি এই বিরিয়ানিতেই প্রথম দেখা মিলেছিল ডিম ও আলুর। খরচ কমানোর জন্য মাংসের পরিমাণ কমিয়ে বিরিয়ানিতে যোগ করা হয়েছিল আলু ও ডিম, পুষ্টিমূল্য একই রেখে। এছাড়াও বিরিয়ানিতে প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল মিঠে আতর।
আজ ভারতীয়দের রসনা তৃপ্ত করে বোম্বে বিরিয়ানি, কল্যানী বিরিয়ানি, দিন্দিগাল বিরিয়ানি, অম্বর বিরিয়ানি, সিন্ধি বিরিয়ানি, তেহারি বিরিয়ারি, থালাইসেরি বিরিয়ানিসহ আরও কত বিরিয়ানি। খোদ ইরানেও বুঝি এত ধরণের 'বিরিঞ্জ বিরিয়ান' পাওয়া যায় না। কারণ ভারতবাসীদের মতো বিরিয়ানি নিয়ে এত গবেষণা করেনি ইরানও। তাই বিশ্ব জুড়ে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে ভারতীয় বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা। ইরানের 'বিরিঞ্জ বিরিয়ান' পূর্বসুরী হয়েও, নিজের অজান্তেই হেরে গিয়েছে ভারতের বিরিয়ানির কাছে।