Latest News

তিন বছর অন্তর বাড়ি ফেরে পূর্বপুরুষদের মমি, ঘুরে বেড়ায় গোটা গ্রাম

রূপাঞ্জন গোস্বামী

ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে ভাসছে রহস্যময় দ্বীপরাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া (Indonesia)। দেশটির পাঁচ হাজার দ্বীপে বাস করে প্রায় ১৩৪০ টি উপজাতি। বিচিত্র তাদের সমাজ ও সংস্কৃতি। দ্বীপগুলির প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায়, বেশ কিছু উপজাতি একসময় ছিল নরখাদক। যদিও বর্তমানে নরমাংসে আর রুচি নেই উপজাতিগুলির।

দুর্গম অরণ্য ও পাহাড়গুলির অন্ধকার উপত্যকায়, উপজাতিগুলি লুকিয়ে রেখেছে অজস্র হাড়হিম করে দেওয়া প্রথা। যেগুলির বেশিরভাগই এখনও জানে না সভ্যজগৎ। এরকমই এক গা ছমছমে প্রথা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বুকে আগলে রেখেছে পূর্ব ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপ সুলাওসি (Sulawesi)। আয়তনে দ্বীপটি প্রায় ১৮০৬৮১ বর্গ কিলোমিটার।

Image - তিন বছর অন্তর বাড়ি ফেরে পূর্বপুরুষদের মমি, ঘুরে বেড়ায় গোটা গ্রাম
সুলাওসি দ্বীপ (Indonesia)

কারা বাস করে পাহাড়ে!

দক্ষিণ সুলাওসির পাহাড়ি অঞ্চলে আছে ‘টানা টোরাজা’ এলাকা। দুর্গম পাহাড় ও অরণ্য ঘেরা সবুজ উপত্যকায় বাস করে ‘টোরাজা'(Toraza) উপজাতি। ‘টোরাজা’ শব্দটির অর্থ ‘পাহাড়ের মানুষ’। দুর্গম পাহাড়ের ঢালে ধান, ভুট্টা ও কন্দ জাতীয় ফসল চাষ ও পশুপালনই হল টোরাজাদের জীবীকা।

প্রাচীনকালে টোরাজারা ছিল সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাসী আলুক টো’টোডো ধর্মের অনুসারী। প্রকৃতি ও বহুদেবতার পুজো করত উপজাতিটি । টোরাজারাদের বিশ্বাস, তাদের পূর্বপুরুষকে মর্তে পাঠিয়েছিলেন সৃষ্টিকর্তা পুয়াং মাটুয়া। মানব সমাজ গঠনের প্রয়োজনে এবং মৃত্যুর পর পূর্বপুরুষদের আত্মা ফিরে যায় আকাশে। আত্মাদের স্বর্গে। যার নাম ‘পুইয়া’।

টোরাজা উপজাতি (Indonesia)

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ডাচ মিশনারিদের নজর পড়েছিল টোরাজা উপজাতির ওপর। টানা টোরাজার পাহাড়ে পাহাড়ে ডাচ মিশনারিরা স্থাপন করেছিল স্কুল ও চার্চ। খ্রিস্টান ধর্মকে আপন করে নিয়েছিল বেশিরভাগ টোরাজাই। কিন্তু হৃদয় থেকে মুছে ফেলেনি প্রাচীন ধর্ম আলুক টো’টোডোকে।

বিশ্বের কাছে মৃত্যু হল জীবনের এক আতঙ্কময় পরিসমাপ্তি। কিন্তু টোরাজাদের কাছে মৃত্যু হল এক আতঙ্কহীন গন্তব্য। তাই বুঝি টোরাজারা নির্ভয়ে জীবন কাটায় মৃত প্রিয়জনদের সঙ্গে। সযত্নে আগলে রাখে শিহরণ জাগানো ‘মা’নেনে’ প্রথাকে। যে প্রথার বিবরণ শুনলে আঁতকে উঠতে হয়।

Image - তিন বছর অন্তর বাড়ি ফেরে পূর্বপুরুষদের মমি, ঘুরে বেড়ায় গোটা গ্রাম

মৃতদেহ থাকে বাড়িতেই, মাসের পর মাস

টোরাজা গ্রামে কারও মৃত্যু হলে, মৃতদেহের সৎকার সেই দিনই করে ফেলা হয় না। মৃতদেহটিকে মমি (Mummy) করে সযত্নে রেখে দেওয়া হয় বাড়িতে। মাসের পর মাস। বছরের পর বছর। যতদিন সৎকার না করা হয়, ততদিন প্রিয়জনকে মৃত বলে মেনে নেওয়া হয় না। বলা হয় ‘টু-মাকুলা’ বা অসুস্থ মানুষ।

প্রাচীনকালে মৃতদেহগুলিকে মমি বানানোর সময় ধুয়ে নেওয়া হত চায়ের লিকার দিয়ে। পচন রুখতে মৃতদেহে দেওয়া হত জড়িবুটির প্রলেপ। কিন্তু এখন পদ্ধতি অবলুপ্ত। ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে মৃতদেহে এখন ঢুকিয়ে দেওয়া হয় লিটার তিনেক ফরম্যালডিহাইড (formaldehyde)।

তারপর সুসজ্জিত একটি ঘরের আরামদায়ক বিছানায় শুইয়ে রাখা হয় মমিটিকে। ফম্যালডিহাইডের কটু গন্ধ ঢাকার জন্য, ঘরে রাখা হয় বিভিন্ন সুগন্ধী লতাপাতা।

পরিবারের শিশুদের যেমন যত্ন করা হয়। তেমনই যত্ন করা হয় প্রিয়জনদের মমিগুলিকে। নিয়ম মেনে চার বেলা মমিদের সামনে রাখা হয় খাদ্য ও পানীয়। বদলে দেওয়া হয় পোশাক। রোজ সন্ধ্যায় মমিদের কফিনের পাশে বসে গল্পগুজব করেন পরিবারের লোকজন। এভাবেই কাটে মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর।

পাশাপাশি চলে সৎকারের জন্য অর্থ সঞ্চয় করা। কারণ টোরাজাদের সমাজে সৎকারের খরচ বিয়ের খরচের থেকেও কয়েকগুণ বেশি। সৎকারের সময় প্রচুর টাকা খরচ করে বানানো হয় দামি কাঠের কফিন। বানানো হয় মৃত প্রিয়জনের আদলে গড়া কাঠের পুতুল ‘টাউ টাউ’। এছাড়াও আছে পশুবলি ও বিশাল ভুরিভোজের খরচ।

Image - তিন বছর অন্তর বাড়ি ফেরে পূর্বপুরুষদের মমি, ঘুরে বেড়ায় গোটা গ্রাম
এখনও মৃত নন প্রিয়জন, তিনি অসুস্থ্য

পাহাড় চূড়ায় চিরবিশ্রাম নেন প্রিয়জনেরা

প্রত্যেক টোরাজা পরিবারের নিজস্ব একটি সমাধিক্ষেত্র থাকে। যেগুলিকে বলা হয় ‘পাটানে’। উঁচু উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় বানিয়ে রাখা হয় পারিবারিক সমাধিক্ষেত্র। খাড়া পাথুরে দেওয়াল কেটে বানিয়ে নেওয়া হয় বিভিন্ন আয়তনের কৃত্রিম গুহা।
ছোট গুহাগুলিতে কমপক্ষে পাঁচটি ও বড় গুহাগুলিতে দশটি পর্যন্ত কফিন ধরে যায়। বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে গুহাগুলির কাছে পৌঁছলে, মনে পড়ে যাবে বাংলার দুর্ভেদ্য অরণ্যে থাকা অরণ্যদেবের খুলি গুহার কথা। যেখানে পাথরের কফিনে চিরনিদ্রায় মগ্ন হয়ে আছেন একুশ জন সাবেক অরণ্যদেব।

পাথরের গুহা ছাড়াও, পাহাড়ের চূড়ায় থাকা সমতল জমিতে কখনও কখনও বানানো হয় সমাধিক্ষেত্র। এছাড়া কোনও টোরাজা শিশুর মৃত্যু হলে, তার কফিনটিকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় জীবন্ত গাছের বুকে তৈরি করা কৃত্রিম কোটরে।

টোরাজাদের সমাধিক্ষেত্র

এগিয়ে আসে সৎকারের দিন

বাড়িতে আসেন আলুক টো’টোডো ধর্মের পুরোহিত ‘মিনা’। মৃত প্রিয়জনের ঘরে পুরোহিত প্রবেশ করা মাত্রই কান্নায় ভেঙে পড়েন পরিবারের লোকজন। কারণ আজই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবেন, মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর ধরে বাড়িতে শুয়ে থাকা অসুস্থ প্রিয়জন।

মমিটির পাশে বসে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার পালন করেন আলুক পুরোহিত। এরপর মমির শরীরে জড়িয়ে দেওয়া হয় জীবাণুনাশক লতার নির্যাসে ভেজানো কাপড়। পরিয়ে দেওয়া হয় নতুন পোশাক। শুইয়ে দেওয়া হয় নতুন কফিনে।

পরিবারের সদস্যেরা কফিনে রেখে দেন মৃত মানুষটির প্রিয় জিনিসপত্র। সিগারেট, ওয়াইনের বোতল, ঘড়ি, চশমা, ডায়রি, পেন ,অলঙ্কার, এমনকি প্রিয় মোবাইলটিও রেখে দেওয়া হয় কফিনে। তারপর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলির দিকে এগিয়ে চলে বিশাল শোকযাত্রা।

Image - তিন বছর অন্তর বাড়ি ফেরে পূর্বপুরুষদের মমি, ঘুরে বেড়ায় গোটা গ্রাম
টোরাজাদের শোকযাত্রা

কয়েক ঘণ্টা পর পাহাড় চূড়ায় এসে পৌঁছয় শোকযাত্রা। গুহার নিচে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় বিশাল সিঁড়ি। কফিনটিকে নিয়ে গুহায় উঠে যান গ্রামের তরুণেরা। সযত্নে নামিয়ে রাখেন গুহার মেঝেতে। গুহার বাইরে বসিয়ে দেন ‘টাউ টাউ’ নামের পুতুলটিকে। কারণ পুতুলের চোখ দিয়ে তাঁর প্রিয় গ্রামটিকে দু’চোখ ভরে দেখবেন মৃত প্রিয়জন।

গুহা থেকে তরুণের দল নেমে আসার পর, থেমে যায় কান্না। গ্রামবাসীদের নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন মৃতের পরিবার। কারণ তাঁরা জানেন, আবার হবে দেখা। এ দেখাই শেষ দেখা নয়।

টাউ টাউ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন পরিবারের মৃত পূর্বপু্রুষেরা

শুরু হয় পারলৌকিক আচার

গ্রামে ফিরে আসার পর, তিনদিন ধরে চলে বিভিন্ন পারলৌকিক আচার। সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল মহিষ বলি। মৃত প্রিয়জনকে উৎসর্গ করা হয় বারোটি মহিষ। টোরাজারা বিশ্বাস করে, মৃত্যুর পর প্রিয়জনদের পাড়ি দিতে হয় অনেক দূরের পথ। তাই মহিষের পিঠে করে পুইয়াতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

পারলৌকিক ক্রিয়ায়, সবার চোখ খুঁজে বেড়ায় রাজকীয় মহিষ সালেপোকে। মহিষটির গায়ের রঙ হবে গোলাপি। চোখ হবে আকাশি নীল। যে দামে একটি সালেপো বিক্রি করা হয়, তা দিয়ে সহজে কেনা যায় একটি চার চাকা গাড়ি।

গ্রামের সবুজ মাঠে, তিনদিন ধরে চলে পশুবলি। প্রত্যেকটি পশুকে বলি দেওয়ার পর, রক্ত ছড়িয়ে দেওয়া হয় কৃষিক্ষেত্রে। রক্তে ভেজা মাটি হবে উর্বর। গোলা উপচে পড়বে ফসলে। তারপর বলি দেওয়া পশুর মাংস রান্না করে খাওয়ানো হয় গ্রামবাসী ও বহিরাগত আত্মীয় স্বজনদের। চাঁদোয়ার নীচে চলে নাচ ও গান। সারাদিন সারারাত।

Image - তিন বছর অন্তর বাড়ি ফেরে পূর্বপুরুষদের মমি, ঘুরে বেড়ায় গোটা গ্রাম
গোলাপি মহিষ সালেপো

তিন বছর অন্তর গ্রামে ফেরে মমিরা

দেখতে দেখতে কেটে যায় তিন বছর। ফসল গোলায় উঠে যাওয়ার পর আগস্ট মাসে শুরু হয় ‘মা’নেনে’ উৎসব। মা’নেনে (Ma’nene) কথাটির অর্থ হল ‘পূর্বপুরুষদের যত্ন’। এই উৎসবে যোগ দেয় গোটা গ্রাম ও বাইরে থাকা আত্মীয় স্বজনেরা। নির্দিষ্ট দিনে টোরাজারা দলবেঁধে হাঁটতে থাকেন পাহাড়গুলির দিকে।

যে যার পরিবার ও আত্মীয় স্বজন নিয়ে পৌঁছে যান পারিবারিক সমাধিক্ষেত্রে। গুহা থেকে সন্তর্পনে নামিয়ে আনা হয় প্রিয়জনের কফিন। খোলা হয় কফিনের ঢাকনা। তিন বছর পর প্রিয়জনকে দেখতে পেয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পরিবারের লোকজনের মুখ।

গুহা থেকে নামিয়ে আনা হচ্ছে কফিন

দ্রুত সার্জিকাল মাস্ক পরে নেন সবাই। খুলে নেওয়া হয় মমির পোশাক। অভিজ্ঞ হাতগুলি সরিয়ে দেয়, মমির শরীর জড়িয়ে ধরা কাপড়ের পট্টি। নরম তুলি দিয়ে পরিস্কার করা হয়, মমির ওপরে জমে ওঠা ধুলো। তারপর মমিটিকে রৌদ্রস্নান করানো হয় ঘণ্টা খানেক ধরে। তিন বছর পর দু’চোখ ভরে আকাশ দেখে মমি। দেখে আপনজনদের।

টোরাজাদের বিশ্বাস, এই দিনে জীবন্ত হয়ে ওঠেন মৃত মানুষটি। তাই প্রিয়জনের নিথর মমির সঙ্গে খোস গল্পে মেতে ওঠে টোরাজা পরিবার। মমিকে পরানো হয় নতুন পোশাক। আঁচড়ে দেওয়া হয় চুল। মুখে লাগিয়ে দেওয়া হয় পাউডার। কোনও মমির ঠোঁটে গুঁজে দেওয়া হয় জ্বলন্ত সিগারেট। কোনও মমির চোখে পরিয়ে দেওয়া হয় চশমা বা সানগ্লাস।কোনও মমির মাথায় পরিয়ে দেওয়া হয় রঙচঙে টুপি।

Image - তিন বছর অন্তর বাড়ি ফেরে পূর্বপুরুষদের মমি, ঘুরে বেড়ায় গোটা গ্রাম
তিন বছর পর গ্রামে ফিরছে প্রিয়জনের মমি

নির্দিষ্ট সময়ে প্রিয়জনদের মমি নিয়ে পাহাড়ের নীচে পৌঁছয় গ্রামের বিভিন্ন পরিবার। এরপর শোভাযাত্রা সহকারে মমিগুলিকে নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামে। চক্রাকার পথে গোটা গ্রাম ঘোরে শোভাযাত্রাটি। প্রিয়জনদের কোলে চেপে মমিরা ঘুরে বেড়ায় সেই সমস্ত জায়গায়, জীবদ্দশায় যেখানে কেটেছে তাদের শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্য।

সারা গ্রাম ঘুরিয়ে দেখানোর পর, প্রিয়জনের মমি নিয়ে আসা হয় বাড়িতে। আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে গোটা পরিবার। মমি হয়ে যাওয়া প্রিয়জনকে ঘিরে ধরেন আত্মীয়স্বজনেরা। ছবি তোলেন প্রিয় মানুষটির সঙ্গে। পূর্বপুরুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় এই তিন বছরের মধ্যে জন্ম নেওয়া শিশুটির।

মমিদের সঙ্গে ছবি তোলেন প্রিয়জনেরা

মৃত প্রিয়জনের পছন্দের খাবারগুলি সাজিয়ে রাখা হয় মমিটির সামনে। শুরু হয় গান বাজনা ও খাওয়া দাওয়া। তিনদিন ধরে পরিবারটি মেতে ওঠে পুনর্মিলন উৎসবে। মমিরা ঘুরে বেড়ায় গ্রামের আনাচে কানাচে, এই তিনদিন ধরে।

ছেলে তার বাবাকে কোলে করে নিয়ে যায় পারিবারিক কৃষিক্ষেত্রে। কেউ মায়ের মমি নিয়ে ঘুরে আসেন ঝর্নার ধারে। যেখানে রোজ কাপড় কাচতে যেতেন মা। কেউ মৃত সন্তানকে বুকে জাপটে ধরে ঘরের দরজা বন্ধ করেন। চুমোয় চুমোয় ভিজিয়ে দেন মমি হয়ে যাওয়া সন্তানের শুখনো ঠোঁট।

এইভাবে কেটে যায় মা’নেনে উৎসবের তিনদিন। তারপর আবার মমিদের সাজিয়ে গুজিয়ে্‌ নতুন কফিনে শুইয়ে রেখে আসা হয় পারিবারিক সমাধিক্ষেত্রে। আবার শুরু হয় দিন গোনা।

Image - তিন বছর অন্তর বাড়ি ফেরে পূর্বপুরুষদের মমি, ঘুরে বেড়ায় গোটা গ্রাম
মৃত ঠাকুমাকে পারিবারিক কৃষিক্ষেত্রে নিয়ে যাচ্ছে নাতি

কবে শুরু হয়েছিল মা’নেনে!

টোরাজা লোকগাথা শোনায় ‘পং রুমাসেক’ নামে এক শিকারির কাহিনি। হাজার বছর আগের কথা। তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। সূর্যের অস্বাভাবিক তেজে ঝলসে যেতে বসেছিল পাহাড়, উপত্যকা ও গ্রামগুলি। দেখা দিয়েছিল প্রবল খরা। পরিবার বেশ কয়েকদিন ধরে অনাহারে থাকায়, প্রবীণ যোদ্ধা ‘পং রুমাসেক’ একলাই প্রবেশ করেছিলেন বিপদসংকুল অরণ্যে। পশু শিকারের আশায়।

আরও পড়ুন: কেন জরুরি অবস্থার সময় এই দুর্গে সেনা পাঠিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী

ঘণ্টা পাঁচেক ঘুরেও মেলেনি কোনও পশু বা পাখির দেখা। মাথা নীচু করে ধরেছিলেন গ্রামে ফেরার পথ। হঠাৎ তাঁর নজরে পড়েছিল, পাথরের ওপর পড়ে থাকা এক উলঙ্গ মৃতদেহের ওপর। সম্ভবত অনাহারে মারা গিয়েছিলেন প্রবীণ মানুষটি।

মৃত মানুষটিকে দেখে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল রুমাসেকের। নিজের পোশাক খুলে মৃত মানুষটির সম্মান রক্ষা করেছিলেন। তারপর শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া মৃতদেহটিকে নিয়ে উঠে গিয়েছিলেন উঁচু পাহাড়ের এক গুহায়। সযত্নে গুহার মেঝেতে শুইয়ে দিয়েছিলেন মানুষটিকে। শুখনো লতাপাতা দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিলেন গুহার মুখ।

সেই রাতেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল উপত্যকায়। সজল হয়ে উঠেছিল শুকিয়ে কাঠ হওয়া ধরিত্রীর বুক। দলবেঁধে জমিতে নেমে পড়েছিলেন গ্রামবাসীরা। সে বছর প্রতিটি গ্রামবাসীর গোলায় উপচে পড়েছিল ফসল। সব থেকে বেশি ফসল ফলেছিল পং রুমসেকের জমিতে। পাহাড়ের গুহায় শুয়ে থাকা অপরিচিত মানুষটি হয়ে উঠেছিলেন সৌভাগ্যের প্রতীক। সেই থেকে টোরাজা সমাজে শুরু হয়েছিল, প্রিয়জনদের মৃতদেহগুলিকে মমি করে গুহায় রাখার প্রথা।

মর্তের ভগবান

আজও টোরাজারা মনে করে পূর্বপুরুষদের মমিগুলিই মর্তের ভগবান। তাই তো মানবুক গ্রামের হেকটরের মেয়ে, ন’বছরের মেয়ে টিল্লি, বেনী দুলিয়ে স্কুলে যাওয়ার আগে রোজ ঢোকে সেই ঘরে। যেখানে কফিনে শুয়ে আছেন টিল্লির ঠাকুর্দা ট্রোজা এবং ঠাকুমা ফ্রিজিট। সৎকারের অপেক্ষায়।

ঠাকুর্দা ও ঠাকুমাকে হাতজোড় করে প্রণাম করার পর টিল্লি বলে ওঠে, “ওমা, ওপা, আমি স্কুলে যাচ্ছি গো। বিকেলে এসে কথা বলব। তার আগে যেন কফি খেয়ে নিও না। একসঙ্গে খাবো কেমন?”

টিল্লির কাণ্ড দেখে অবাক হয় সভ্য সমাজ। কিন্তু অবাক হয় না টিল্লি। ছোটবেলা থেকে মৃত্যুকে সাথী করে বাঁচতে শিখে গেছে সে। মৃত্যু তার কাছে ঘরের চৌকাঠ এপার ওপার করার মতোই সহজ। মৃত্যু তার কাছে জীবনের অপর নাম।

Image - তিন বছর অন্তর বাড়ি ফেরে পূর্বপুরুষদের মমি, ঘুরে বেড়ায় গোটা গ্রাম

পড়ুন দ্য ওয়ালের অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা ‘সুখপাঠ’

You might also like