
প্রায় বারোশো বছর ধরে চলছে এই বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এক মুসলিম নারী
The oldest functioning university founded by Fatima al-Fihri.
Fatima al-Fihri
রূপাঞ্জন গোস্বামী
উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিশিয়া। সে দেশের এক ঐতিহাসিক শহর ‘কাইরৌয়ান’। ৬৭০ খ্রিস্টাব্দে, আরবের উমিয়াদ সাম্রাজ্যের সময়, পত্তন হয়েছিল এই অসাধারণ সুন্দর শহরটির। ঘন অরণ্য ঘেরা শহরে বসতি স্থাপন করেছিল আরবেরা। কিন্তু ৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে, শহরটির দখল নিয়েছিল উত্তর আফ্রিকার ভূমিপুত্র আমাজিঘ বা বার্বার উপজাতি। শুরু হয়েছিল আরবদের সঙ্গে আমাজিঘদের লড়াই। নয়নাভিরাম বাগিচা ও সুরম্য প্রাসাদের শহর কাইরৌয়ান, হয়ে গিয়েছিল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ময়দান। অষ্টম শতকের শেষে ইফ্রিকিয়ার (বর্তমান তিউনিশিয়া ও আলজেরিয়া) আঘলাবিদ রাজবংশের ইবন আল-আঘলেব (ইব্রাহিম) দখল করে নিয়েছিলেন ‘কাইরৌয়ান’ শহর।
জন্ম হয়েছিল এক মহিয়সীর
ঐতিহাসিক কাইরৌয়ান শহরের একপ্রান্তে, ৮০০ খ্রিস্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন আরবের কুরাইশি বংশদ্ভুত ফতিমা আল-ফিহরি। বাবা মহম্মদ আল-ফিহরি ছিলেন ব্যবসায়ী। দুই মেয়ে ফতিমা ও মরিয়মকে ছোট থেকেই শিক্ষার আলোকে আলোকিত করার চেষ্টা করেছিলেন মহম্মদ আল-ফিহরি। কারণ তিনি মনে করতেন, সবার আগে নারীদের শিক্ষা দেওয়া উচিত। তবেই সঠিক মানুষ হবে পরবর্তী প্রজন্ম।
সে যুগে মুসলিম বিশ্বের কাছে শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র ছিল ‘কাইরৌয়ান’। শহরেই বাস করতেন প্রথিতযশা শিক্ষকেরা। তাঁদেরই কয়েকজনকে দুই মেয়ের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন মহম্মদ আল-ফিহরি। মনের মতোই বড়ো করে তুলছিলেন ফতিমা ও মরিয়মকে। কিন্তু আরব-আমাজিঘ বিবাদ একসময় ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। তাই পরিবার নিয়ে দেশই ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মহম্মদ আল-ফিহরি।
শহরের নাম ‘ফেজ’
উত্তর-পশ্চিম মরোক্কোর সবুজ পাহাড় ও অরণ্য দিয়ে ঘেরা অঞ্চলে বয়ে চলেছে জওহর নদী। ৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে, ইদ্রিসিদ সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট ইদ্রিস ইবন আবদুল্লা (প্রথম ইদ্রিস) জওহর নদীর তীরে পত্তন করেছিলেন ‘ফেজ’ শহর। বার্বার বা আমাজিঘ উপজাতির মানুষেরা ছিল শহরের আদিবাসিন্দা। কিন্তু পত্তনের কয়েক দশক পরেই শহরে পা রেখেছিল আরব যোদ্ধারা। তারা এসেছিল ইদ্রিসিদ সাম্রাজ্যের হয়ে লড়ার জন্য।
এরপর ফেজ শহর দেখেছিল আরব শরণার্থীদের দুটো বিশাল ঢেউ। ৮১৭ খ্রিস্টাব্দে আন্দোলুসিয়া (স্পেন ও পর্তুগাল) থেকে ফেজ শহরে এসেছিল বিতাড়িত আরবেরা। এরপর ৮২৫ খ্রিস্টাব্দে এসেছিল, তিউনিশিয়ার কাইরৌয়ান শহরের আরব শরণার্থীরা। এই দুটি আরব ঢেউয়ের আঘাতে আফ্রিকার ফেজ শহরে সংখ্যাগুরু হয়ে গিয়েছিল আরবেরা। জওহর নদীর দুই তীরে তৈরি হয়েছিল, পৃথক দুটি আবাসিক এলাকা। আদওয়াত আল-কারাউইন ও আদওয়াত আল-আন্দালাস।
ফেজ শহরে ফতিমা
ফেজ শহরে আছড়ে পড়া দ্বিতীয় আরব ঢেউয়ে ছিলেন, মহম্মদ আল-ফিহরি ও তাঁর পরিবার। অসুস্থ স্ত্রী, দুই কন্যা ফতিমা ও মরিয়মকে নিয়ে, আলজেরিয়ার ভয়ঙ্কর সাহারা মরুভূমি পেরিয়ে মহম্মদ আল-ফিহরি পৌঁছে গিয়েছিলেন মরোক্কোর ঐতিহাসিক শহর ফেজ-এ। সম্পুর্ণ অপরিচিত এক শহরে নতুন করে শুরু করেছিলেন জীবন সংগ্রাম।
মহম্মদ আল-ফিহরির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর দুই বিদুষী কন্যা। কালক্রমে ব্যবসায়ী মহম্মদ আল-ফিহরি হয়ে উঠেছিলেন অগাধ ধনসম্পদের অধিকারী। ঘটা করে দিয়েছিলেন দুই মেয়ের বিয়ে। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না ফতিমার। বিয়ের কিছু বছরের মধ্যেই হারিয়ে ফেলেছিলেন বাবা ও স্বামীকে। বাবা মহম্মদ আল-ফিহরির বিশাল সম্পত্তি ভাগ হয়ে গিয়েছিল দুই মেয়ের মধ্যে।
যাত্রা শুরু করেছিল আল-কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়
ফেজ শহরের সেই আদওয়াত আল-কারাউইন অঞ্চলে ফতিমা বাস করতেন। সেখানে বসবাসকারী তিউনিশিয়ার আরবদের উচ্চশিক্ষার প্রতি সামান্যতম আগ্রহও ছিল না। যা ভীষণ কষ্ট দিত ফতিমাকে। কারণ তিনি মনে করতেন, বিদেশের মাটিতে সংগ্রামের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হল উচ্চশিক্ষা।
তাই অগাধ সম্পদের মালিক ফতিমা, ৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে কিনে নিয়েছিলেন একটি জরাজীর্ণ মসজিদ ও সংলগ্ন কয়েক একর জমি। সেই স্থানে ফতিমা নির্মাণ করেছিলেন সুবিশাল আল-কারাউইন মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তিনি জানতেন, ধর্মের টানে আরবেরা মসজিদে আসবেই। তখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি দেখে তাদের মনে জন্মাবে উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহ।
আরও পড়ুন: ইন্দোনেশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধার করেছিলেন ভারতের এই মুখ্যমন্ত্রী, নিজেই বিমান চালিয়ে
মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি নির্মাণের সময় অকাতরে অর্থ খরচ করেছিলেন ফতিমা। দেশ বিদেশের জাহাজ আটলান্টিক সাগর পথে বয়ে আনত দামি পাথর, ধাতু ও কাঠ। প্রায় ১৪ বছর ধরে, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নির্মাণকার্যের তদারকি করেছিলেন ফতিমা।
আল-কাওয়ারাইন মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করেছিল ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে। ঠিক একই সময়, জওহর নদীর অন্য তীরে আল-আন্দোলুসাইন মসজিদ স্থাপন করেছিলেন বোন মরিয়ম। আন্দোলুসিয়া থেকে আসা আরবদের জন্য।
তখনও আগমন হয়নি ইউনিভার্সিটি শব্দটির। তাই ফতিমার গড়া উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি পরিচিত ছিল আল-কারাউইন মাদ্রাসা নামেই। আফ্রিকা ও আরব মুলুকের সেরা সেরা অধ্যাপককে নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে এসেছিলেন ফতিমা। উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন্য নিজের প্রতিষ্ঠা করা মাদ্রাসাতেও ভর্তি হয়েছিলেন মধ্যবয়স্কা ফতিমা।
এহেন মহিয়সী নারীর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। কোনও শিল্পী এঁকে রাখেননি তাঁর ছবি। তাঁর সম্পর্কে যেটুকু তথ্য জানা যায়, তা পাওয়া গিয়েছে ইবন আবি জারের, ১৩২০ খ্রিস্টাব্দে লেখা ‘রাওদ আল-কিরতাস’ বইটি থেকে। জানা গিয়েছিল দানশীলা মহিয়সী ফতিমা আল-ফিহরির মৃত্যু হয়েছিল ৮৮০ খ্রিস্টাব্দে। ৮০ বছর বয়সে।
বিশ্ববিখ্যাত হয়েছিল আল-কাওয়ারাইন বিশ্ববিদ্যালয়
ইদ্রিসিদ শাসনের পর, ফেজ শহর নানা সময় চলে গিয়েছিল আলমোরাভিদ, আলমোহাদ, মারিনিদ, ওয়াট্টাসিদ, সাদি, দিল্লাউই ও আলাউইট সাম্রাজ্যের অধীনে। প্রত্যেকটি সাম্রাজ্যের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছিল আল-কারাউইন মাদ্রাসা।
আল-কারাউইনই হল বিশ্বের প্রথম ডিগ্রি প্রদানকারী বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে উচ্চশিক্ষা নিতে আসত আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপের ছাত্ররা। আক্ষরিক অর্থেই আল-কারাউইন মাদ্রাসা হয়ে উঠেছিল বিশ্ববিদ্যালয়। ইসলামীয় দর্শন ছাড়াও যেখানে পড়ানো হত ব্যাকারণ, অলঙ্কারশাস্ত্র, পাশ্চাত্য দর্শন, চিকিৎসাবিদ্যা, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভূগোল। ছিল না কোনও ধর্মীয় বাধানিষেধ, মুসলিম ছাত্রদের সঙ্গেই পড়াশুনা করতেন খ্রিস্টান ও ইহুদি ছাত্ররা।
এখানেই আছে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থাগার
এই বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থাগার। মারিনিদ সুলতান আবু ইবন ফারিস ১৩৪৯ খ্রিস্টাব্দে তৈরি করেছিলেন গ্রন্থাগার। যেখানে আছে, আফ্রিকা, মধ্য প্রাচ্য, আন্দোলুসিয়া, গ্রানাডা, আলমেইরা, কর্ডোবা, সেভিলে থেকে সংগ্রহ করা প্রায় ৪০০০ দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি ও লক্ষাধিক বই।
আছে নবম শতাব্দীর কোরান, যা লেখা হয়েছিল ফিনফিনে করে তোলা হরিণের চামড়ায়। আছে বিশ্বের সব থেকে প্রাচীন মেডিক্যাল ডিগ্রি। হরিণের চামড়ায় লেখা এই ‘ইজাজাহ’ শংসাপত্র, যেটি দেওয়া হয়েছিল আবদেল্লাহ বেন সালেহ আল -কউতামি নামের এক ছাত্রকে। একজন বিচারকের উপস্থিতিতে, ১২০৭ খ্রিস্টাব্দে, ছাত্রটির হাতে শংসাপত্রটি তুলে দিয়েছিলেন চিকিৎসাবিদ্যার তিন অধ্যাপক।
প্রাক্তনীদের নামও ভূবনবিদিত
আল-কাওয়ারাইন বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন যুগে পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে বেশকিছু বিশ্ববিখ্যাত ছাত্রকে। এঁদের মধ্যে আছেন আল-ইদ্রিসি (ভূতত্ত্ববিদ) ইবন আল-আরবি (সুফি দার্শনিক) রুশাইদ আল-সাবতি ( বিচারপতি ও লেখক ), ইবন খালিদুন ( ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক) আল্লাল আল-হিল্লালি (অনুবাদক), মাইমনিডেস (ইহুদি দার্শনিক), নিকোলাস ক্লেনায়ের্টস ( খ্রিস্টান ভূ-পর্যটক ও ব্যাকরণবিদ), লিও আফ্রিকানাস(লেখক), গোলিয়াস(ডাচ পণ্ডিত), জোস ক্রিস্টোভিচ (রাশিয়ার দার্শনিক)। কথিত আছে, পোপ দ্বিতীয় সিলভেস্টারও উচ্চশিক্ষা লাভ করেছিলেন আল-কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
স্বাধীনতা আন্দোলনেরও আঁতুড়ঘর এই বিশ্ববিদ্যালয়
১৯১২ সালে মরোক্কো দখল করেছিল ফ্রান্স। ফেজ শহরের বাইরেই ফরাসিরা গড়েছিল এক আধুনিক শহর ‘দ্য ভিলে নউভেল’। আল-কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব কমিয়ে দেবার জন্য গড়ে তুলেছিল পাশ্চাত্য ভাবধারার অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ঠিক তখনই স্বাধীনতা আন্দোলনের আঁতুড়ঘর হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছিল আল-কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়। মরোক্কোর স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকেরা। ফলশ্রুতিতে, ১৯৫৬ সালে মরোক্কো পেয়েছিল স্বাধীনতার আস্বাদ।
স্বাধীন হওয়ার পর মরোক্কোতে স্থাপিত হয়েছিল বহু বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু তখনও ‘মাদ্রাসা’ নাম নিয়েই শিক্ষার আলো ছড়িয়ে চলেছিল আল-কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়। অবশেষে ১৯৬৩ সালে, আল আল-কারাউইন মাদ্রাসাকে অধিগ্রহণ করেছিল মরোক্কো সরকার। নাম হয়েছিল ‘ইউনিভার্সিটি অফ আল-কাওয়ারাইন’।
আজও হাঁটছে আল-কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়
ফতিমা আল-ফিহরির হাত ধরে ১১৬৩ বছর আগে হাঁটা শুরু করা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি, হেঁটে চলছে আজও। পৃথিবীতে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সবথেকে বেশি সময় ধরে চলা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাকে স্বীকৃতি দিয়েছে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড। হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে UNESCO।
বর্তমানে আল-কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়েন দেশ বিদেশ থেকে আসা ১০০০০ ছাত্র। পড়ান ৯০০ জনের মতো অধ্যাপক। প্রায় সব বিষয়েই উচ্চশিক্ষা লাভ করা যায় এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিষয়গুলি পড়ানো হয় আরবি, স্থানীয় তামাহক ও ফরাসি ভাষায়। কিন্তু একটা তথ্য বিশ্ববাসীকে আজও স্তম্ভিত করে। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল এক নারীর হাত ধরে, ১৯৪০ সালের আগে সেখানে নারীদের প্রবেশাধিকার ছিল না। অথচ আজও বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সযত্নে রেখে দিয়েছে, কাঠের ওপর খোদাই করা ফতিমা আল- ফিহরির ডিপ্লোমা সার্টিকিকেট।