সুকুমার রায়
শেষ আপডেট: 10th March 2025 19:05
সেবার নাটক লিখলেন উপেন্দ্রকিশোর। ‘কেনারাম বেচারাম’। প্রকাশিত হল ‘মুকুল’ পত্রিকায়। কৌতুকনাট্য। ছোটদের জন্য লেখা। কিন্তু একবার পড়া শুরু করলে আট থেকে আশি—সব্বাই হেসে কুটিপাটি যাবে।
রায় পরিবারের দুষ্টু ছেলের দল অনেক দিন পর এমন উপহার পেয়ে যথারীতি আনন্দে আত্মহারা। কিন্তু নাটক পড়ে যত না সুখ, অভিনয় করে তার চেয়ে দ্বিগুণ মজা। তাই ঠিক হল, সীমিত সামর্থ্যে, কুড়িয়ে-বাড়িয়ে যা কিছু জোটে, তাই দিয়ে ‘কেনারাম বেচারাম’ মঞ্চস্থ করা হবে।
এই প্ল্যান-প্রোগ্রামের শিরোমণি ছিলেন সুকুমার। সকলের আদরের ‘তাতা’। হইচই করে সবাইকে মাতিয়ে তুললেন। পুরোনো কাপড়চোপড় জোগাড় করে ড্রেস বানানো, সিন তৈরি হল৷ এর তার কাছে পয়সা চেয়ে দাড়ি, গোঁফ, পরচুলা পর্যন্ত কিনে আনলেন তিনি। একটা ইয়া লম্বা দাড়ি পরে নিজে সাজলেন বেঁটে বামুন। একদিন গণকঠাকুরের সাজ ধরে হানা দিলেন বন্ধুর বাড়ি। বন্ধুর মা তাঁকে দেখে চিনতে না পেরে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম পর্যন্ত করলেন।
মোট কথা সুকুমার নিজে মাতলেন, অন্যকেও মাতিয়ে তুললেন। আর এই ছোট্ট অভিনয়ের সূত্রে খুলে গেল নতুন দোর। নতুন ভোর-ও বলা যেতে পারে! মজার ছড়া লিখিয়ে সুকুমার রায়ের নাটককার হিসেবে হাতেখড়িও ঘটল এই সময়, ১৯০৬ সালে। বাড়ির উঠোনে আটপৌরে সাজসজ্জার নাটকে নেমে এতটাই দিলখুশ হল তাঁর যে, নিজেই লিখে ফেললেন আস্ত নাটক—‘রামধন বধ’। তারপর একে একে ‘ঝালা-পালা’, ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’। বাবার লেখা একটি হাসির নাটক এভাবেই সুকুমার রায়ের লেখকজীবনে অন্য মাত্রা যোগ করল।
তবে এখানেই শেষ নয়। ‘কেনারাম বেচারামে’র অভিনয়কে ঘিরে তাঁর চরিত্রের আরও একটি দিক পূর্ণতা লাভ করে। হুল্লোড়ে মেজাজ বরাবরই ছিল। কিন্তু এতদিন তা রোজকার স্রোতে বয়ে যেত, আকার পেত না। আর কে না জানে আনন্দ-উল্লাস একটা অবয়ব পায়, তার একটা গড়ন জোটে আলোচনা চক্রে, আড্ডার মজলিশে। যে কারণে সুকুমার ঠিক করলেন বাড়ির ছেলেপুলে আর বন্ধুদের নিয়ে যে ঘরোয়া আয়োজনটি বসে, তাকে কিঞ্চিৎ সংঘবদ্ধ করা যেতে পারে।
ভাবতেই যা দেরি। ‘ননসেন্স ভার্স’-লিখিয়ে বানিয়ে ফেললেন ‘ননসেন্স ক্লাব’। ততদিনে সুকুমার কিন্তু বাচ্চাটি নেই। সিটি স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। সমাজ ও সময় নিয়ে সচেতন এক যুবক। বায়োস্কোপের তীব্র বিরোধী এক শিক্ষককে জোর করে ‘লে মিজেরাবল’ দেখিয়ে মুগ্ধ করেছেন, সাম্প্রদায়িক কাগজে শিক্ষিত মেয়েদের নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদে সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে লিখিত আকারে ক্ষমা পর্যন্ত চাইতে বাধ্য করেছেন, স্বপ্ন বিদেশ যাওয়ার, বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কার নিয়ে সদা উৎসুক তাঁর মন—অথচ এসবের অন্তরালে বয়ে চলেছে এক অন্য হৃদয়স্রোত। যার ধারা অনাবিল, স্বচ্ছ, চিরকালীন বিস্ময়ে ভরা।
এই বৈপরীত্যই সুকুমার অভিজ্ঞান। আর এই অভিজ্ঞানকেই তিনি ধরতে চাইলেন ননসেন্স ক্লাবে। সংঘ হলে মুখপত্রও জরুরি। সেই কারণে প্রকাশ করলেন হাতে লেখা কাগজ। নাম ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’। এখানেও মজা! সে আমলে বত্রিশ রকমের সুখাদ্যকে মিলিয়ে-জুলিয়ে স্ন্যাক্স গোছের পদ বানানো হত। উপরে শোভা পেত আধখানা শুকনো লঙ্কা ভাজা। ক্লাবের নামই যখন ‘ননসেন্স’ তখন তার মুখপত্র ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা'র চাইতে যুতসই আর কিছু হতে পারে কি?
সেই পত্রিকায় সুকুমার নিজের হাতে লিখতেন মজার মজার গল্প, কবিতা, নাটক। পাশাপাশি আঁকতেন রংচঙে ছবি। রেখায় আর রেখায় মিলে সেজে উঠত ক্লাবের মুখপত্র৷ কিন্তু স্রেফ হাসিখুশি বিনোদন নয়, গুরুগম্ভীর আলোচনাও ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’র পাতায় ঠাঁই পেত। লেখা হত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুভিত্তিক সম্পাদকীয়। যেটা ছোটদের বদলে পড়বে বড়রা। এই কলামের নামটি মোক্ষম বেছেছিলেন সুকুমার: ‘পঞ্চ-তিক্ত পাচন’। শুনে মনে হয় রাশভারি, গ্রাম্ভারি সম্পাদকীয়। অথচ শক্তপোক্ত বিষয় লেখা হল লঘু চালে, সুন্দর লয়ে, সহজ ভাষায়। নামে তিতকুটে অথচ পড়তে মজা—এই চিন্তা, এমন কাণ্ড সুকুমার ছাড়া আর কে-ই বা করবেন!
ক্লাবের কাজকর্ম শুধুই পত্রিকার পাতায় আটকে রাখেননি সুকুমার। অভিনয় চলছিল আগের মতো, হয়তো আগের চেয়ে কিছুটা দ্রুতলয়েই। ২২ নং সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে ততদিনে উঠে এসেছেন উপেন্দ্রকিশোর। জ্ঞাতিপরিবার সমেত। সেখানেই বসত আসর, চলত মহড়া। যার সুরম্য বিবরণ ধরা আছে সুকুমারের মেজো বোন পুণ্যলতার লেখা ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’-তে: ‘ননসেন্স ক্লাবের অভিনয় এমন চমৎকার হত, যারা নিজের চোখে দেখেছে তারাই জানে। মুখে বর্ণনা করে তার বিশেষত্ব ঠিক বোঝানো যায় না। বাঁধা স্টেজ নেই, সিন নেই, সাজসজ্জা ও মেক আপ বিশেষ কিছুই নেই৷ শুধু কথায় সুরে ভাবে ভঙ্গীতে তাদের বাহাদুরি ফুটত।’
আর এই অভিনয়ে স্বয়ং সুকুমার ঠিক কোন ভূমিকা নিতেন? পুণ্যলতা লিখছেন: ‘দাদা নাটক লিখত, অভিনয় শেখাত আর প্রধান পার্টটা সাধারণত সে নিজেই নিত। প্রধান মানে সব চেয়ে বোকা আনাড়ির পার্ট। হাঁদারামের অভিনয় করতে দাদার জুড়ি কেউ ছিল না।’
এটাই সুকুমার। এখানেই তিনি সকলের চেয়ে আলাদা… বিলকুল আলাদা। সমাজ-নির্দিষ্ট অসঙ্গতি, বৈপরীত্যকে তিনি একপঙক্তিতে মিলিয়েছেন। কবিতায়, ছড়ায়, নাটকে তো বটেই… জীবনেও। ‘হাঁস ছিল সজারু’ এটুকু বলেই ক্ষান্ত নন তিনি। এরপর প্রথম বন্ধনীতে স্পষ্ট ভাষায় লিখে দেন: ‘ব্যাকরণ মানি না’। এই সামাজিক নীতিনির্দেশ না-মানার প্রতিস্পর্ধায় সুকুমার অনন্য। আর যেহেতু নিয়ম না মানার রসের রসিক, পথের পথিক তিনি, তাই দুইয়ে মিলে কীভাবে, কোন রসায়নে ‘হাঁসজারু’র আকৃতি ধারণ করল, তার রহস্য বোঝার কিংবা বোঝানোর দায়ও তাঁর নেই। প্রথম পঙক্তির প্রতিবাদের কাঠিন্যকে পরের পঙক্তিতেই হাস্যরসে দ্রব করে তুললেন সুকুমার। পরিবারের সবচেয়ে চৌখশ মানুষটি হাঁদারামের পার্ট করতে উদগ্রীব—যেমন রচনায়, তেমনই জীবনে—সামাজিক ‘নর্ম'-কে, ‘ট্যাবু’কে পদে পদে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গেছেন সুকুমার রায়।
আর এই বৈচিত্র্যকে দেহে-মনে ধারণ করতেন বলেই তাঁকে ঘিরে জমত জটলা, জুটত দঙ্গল৷ ছেলেবেলার বন্ধু বিমলাংশুপ্রকাশ রায় ১৯৬৬ সালে ‘তত্ত্ব-কৌমুদী’-তে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছিলেন: ‘এসো আমরা একটা দল পাকাই বলে সুকুমার কোনওদিন তাঁর দল গড়ে তোলেননি। তাঁর দল গড়ে উঠেছিল অতি সহজ স্বাভাবিক ভাবে, যেমন করে জলাশয়ের মধ্যকার একটা খুঁটিকে আশ্রয় করে ভাসমান পানার দল গিয়ে জমাট বাঁধে… তার স্নিগ্ধ শান্ত উদার চোখ দুটির মধ্যে একটা সম্মোহনী শক্তি ছিল।’
আর এই সম্মোহনের টানেই ননসেন্স ক্লাবের আড্ডা ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে গলিতে, রকে ছড়িয়ে পড়েছিল। কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের পাশের গলিতে বসত আসর। এর ওর বাড়ির রক-ই হয়ে উঠত আলোচনার মঞ্চ। সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, শিক্ষা নিয়ে তুমুল তর্কাতর্কি, বাকবিতণ্ডা। যোগ দিতেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় থেকে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিবারের ছেলেরা। একদিকে নিয়মতান্ত্রিক ব্রাহ্ম সমাজের আরাধনা। তার ঢিলছোড়া দূরে ননসেন্সের উৎসার! এও এক বৈপরীত্য। আপতিক, কিন্তু লক্ষ্য করার মতো।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে চর্চাও যে মনোরম, দিলদার মেজাজে করা যেতে পারে, তার নকশা এঁকে দিয়েছিলেন সুকুমার। পাড়ার কেউ বিরক্ত, কেউ বা উৎসুক। শোনা যায় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের পিতৃদেব ননসেন্স বাহিনীর হইহল্লায় তিতিবিরক্ত হয়ে তাঁর বাড়ির বাইরে থাকা রকবারান্দাটি মিস্তিরি ডেকে ভেঙে দেন৷ কিন্তু এতকিছুর পরেও আসর দমানো যায়নি।
আর এই অফুরান স্ফূর্তি দেখে চমকিত সুকুমার ঠিক করেন তরতাজা, প্রাণবান যুবকদের কাজে লাগাতে হবে। ততদিনে ব্রাহ্মসমাজের যুবশাখাটি নামেই চলছিল। কাজের কাজ কিছুই হত না। সুকুমার ভাবলেন, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে একে নতুন করে ঢেলে সাজাবেন। ভাবা মাত্র গড়ে তুললেন ‘ব্রাহ্ম যুবসমিতি’। ননসেন্স ক্লাব থেকেই জন্ম নিল নতুন এক সংঘ। সাপ্তাহিক আলোচনা, মাসিক চড়ুইভাতির আবডালে চর্চা শুরু হল উন্নয়নের ভাবনা, আত্মোন্নতির চিন্তা নিয়ে। দেশের-দশের কাজে নিজেদের মেলে ধরল তারা। আসর বসল কখনও বালিগঞ্জে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুবিশাল বাগানবাড়িতে, কখনও বা মথুর গাঙ্গুলির ছেলে সুধাংশু গাঙ্গুলির দালানে। ১৯১০ সালে প্রকাশিত হল সমিতির মুখপত্র আলোক। ব্রাহ্ম মিশন প্রেস তা ছেপে বের করে। নিলাম আয়োজিত হয়। দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের পুত্র১০ টাকায় প্রথম সংখ্যাটি কিনে নেন।
ঠিক সেই সময় সুকুমারের মনে বহুদিনের সুপ্ত ইচ্ছেটি নতুন করে জেগে ওঠে। ফটোগ্রাফি আর প্রিন্টিং টেকনোলজি শেখার ইচ্ছে। শিখতেই হবে। হাতেকলমে। তার জন্য যেতে হবে বিদেশ। আর অদ্ভুতভাবে, পরের বছর, ১৯১১ সালে সুকুমার রায় লাভ করবেন গুরুপ্রসন্ন বৃত্তি। বিলেত যাওয়ার রাস্তা এবার পাকা। সে বছর অক্টোবর পাসে জাহাজে করে লন্ডন যাত্রা করেন সুকুমার। রেখে যান ননসেন্স ক্লাব আর সাড়ে বত্রিশভাজার আসর।
‘এক দশকে সংঘ ভেঙে যায়’। লিখেছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। ননসেন্সের সংঘ কিন্তু ভাঙেনি। দু'বছর পর দেশে ফিরে নতুন করে জাঁকিয়ে বসবেন সুকুমার। নতুন নামে, নতুন রূপে। ‘ননসেন্স’ বদলে যাবে ‘মান্ডে’ সেখান থেকে ‘মন্ডা’য়। সাড়ে বত্রিশভাজা কিন্তু রয়ে যাবে স্বনামে, স্বরূপে।
কবে, কীভাবে—সে গল্প অন্য একদিন।