শেষ আপডেট: 2nd October 2024 12:00
'ও দিদি চলো তোমায় দিয়ে আসি। চিনি তোমার বাড়ি...' রোজকার অফিস ফিরতি রুটে এই আওয়াজ আগে কখনও কানে আসেনি। মাথা ঘুরিয়ে পিছন ফিরে যার দর্শন পাওয়া গেল, তাঁকে দেখে রীতিমতো অবাক। কারণ রিক্সা চালকের সিটে একজন মহিলা। এও সম্ভব! ভাবতেই ভাবতেই বাড়ি পৌঁছে দিলেন মিঠু।
ওঁর নাম মিঠু পণ্ডিত। একজন 'মহিলা রিক্সাচালক'। আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তার সঙ্গে এ শহরের বুকেই কাজ করে চলেছেন দিন রাত। যে শহর তিলোত্তমার জন্য লড়ছে, সেই শহরের উপকণ্ঠেই একটা নিদারুণ লড়াইয়ের সাক্ষী হল 'দ্য ওয়াল।'
ছোটবেলা থেকেই নিত্যসঙ্গী অভাব। সুখ বা স্বাচ্ছন্দ্য দূরের কথা, দু'বেলা ভাতের নিশ্চয়তাও কখনও আসেনি ঘরে। বাড়ি বাড়ি পরিচারিকার কাজ করে কেটেছে দিন। মিঠুকে নিয়ে তাঁরা তিন বোন। সকলের মুখে হাসি ফোটানোর জীবিকা নিজের ঘাড়ে নিয়ে নেওয়া ছোট্ট বয়স থেকেই।
সুখ খুঁজতে বিয়ে করলেও কপাল খুব একটা সাথ দেয়নি। বরের সঙ্গেই ঘরে এসেছিল মারধর, নেশা, অত্যাচার। মেয়ে তাই বলে চুপ থাকবেন? মারধর সহ্য না করে রুখে দাঁড়ালেন। কোলের দুই সন্তানকে নিয়ে শুরু করলেন লড়াই।
স্বামী যে শুধুই নেশা করে মারধর করত এমন না, মিঠু জানালেন, স্বামী কাজও করতে চাইত না। স্বামীর জন্য রিক্সা ভাড়া নেন প্রথমে। কিন্তু গাড়ি চালক স্বামী না গাড়ি চালায় না রিক্সা। ২ দিন চালায় ৩ দিন বসে থাকে। এই করে কোনওভাবেই সংসার চলছিল না। ছেলে-মেয়ের খাবার জোগাড়ে নাভিশ্বাস ওঠে মিঠুর।
বাধ্য হয়ে ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়েন সবজি বিক্রি করতে। মহিলা সবজি বিক্রেতা। ভুরু কোঁচকান অনেকে। তাতে কী! মিঠু যে একজন 'মা'। তাঁর লড়াই থামায় কার সাধ্যি।
এদিকে ভাড়ার রিক্সা, অর্ধেক দিন নেশা করে পড়ে থাকত স্বামী। রিক্সার ভাড়া দিতে পারতেন না মিঠু। অবশেষে সেই রিক্সা নিয়েই বেরিয়ে পড়া। এই কথা বলতে বলতে ২০১৬-র এক সকালে ফিরে গেলেন তিনি।
কাঁপা গলায় বললেন, 'কেউ সেদিন মহিলা বলে আমাকে রিক্সার লাইনে ঢুকতেই দেয়নি। কিন্তু বাড়িতে বাচ্চাদের মুখগুলো মনে পড়ে যেত তাই ফিরেও যায়নি।' কৃতজ্ঞতার সুরে ধন্যবাদ জানালেন এক সাংবাদিককে। কারণ সেই সাংবাদিকের হাত ধরেই জীবন বদলে যায় তাঁর। বলেন, 'এক সাংবাদিক আমার খবর তাঁর পেপারে ছাপেন। তিনি কে, আজ সত্যি মনে নেই।'
সাংবাদিকের কলমের জোরেই মিঠু পান নতুন জীবন। যে লাইনে তাঁকে ঢুকতে দিত না তথাকথিত সমাজের রক্ষক 'পুরুষ'-রা। যেখানে তাঁর রিক্সায় উঠতে চাইত না সাধারণ মানুষও। সেই মহিলাকেই ডেকে রিক্সার লাইনে সুযোগ দেন ১২৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রাজীব দাস।
তারপর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ভাড়ার রিক্সার বদলে এসেছে নতুন রিক্সা। সকাল থেকে রাত রিক্সা নিয়ে হাসি মুখে দক্ষিণ কলকাতার পোড়া অশ্বত্থতলা এলাকায় মানুষকে পরিষেবা দিচ্ছেন।
তবু কি সব সমস্যা মেটে? না। সমাজ মিটতে দেয় না। কারণ মিঠুর শক্তি, ক্ষমতা, দক্ষতা যতই বাড়ুক, সমাজে আজও মিঠু একজন মহিলা এবং রিক্সা চালানো কেবলই 'পুরুষের কাজ'। তাই বাঁকা চোখ, কটু মন্তব্য, অস্ফূট খোঁটা-- আজও ভেসে আসে কানে। তবে আট বছর ধরে শুনতে শুনতে এসবে আর মোটেও পাত্তা দেন না মিঠু। বরং জোরে... আরও জোরে চাপ দেন প্যাডেলে, উড়িয়ে নিয়ে যান রিক্সা। স্বাধীনতার পথে, স্বাবলম্বনের পথে।
রিক্সা চালিয়ে সত্যিই আজ অনেকটাই সাবলম্বী মিঠু। ছেলেমেয়েদের বড় করছেন। মেয়েকে দিয়েছেন জোকার কাছে একটি হস্টেলে। যে দুঃখ তিনি করেছেন, শিক্ষার সান্নিধ্যই পাননি, সেই কষ্ট, লড়াইয়ের আঁচ ছেলে-মেয়ের কাছে ঘেঁষতে দেবেন না, এই প্রতিজ্ঞাই করেছিলেন। তাতে পাশ করেছেন মিঠু।
ঘর বদলেছে, পরিস্থিতি বদলেছে, কিন্তু পেশা বদলায়নি। আজও রিক্সাই সব। তাই এখনও প্রতিদিন নিরলসভাবে এই কাজ করে যাচ্ছেন। কারণ বিভিন্ন টিভি শো, ক্লাব, পুজো তাঁকে সংবর্ধনা দিলেও, আদতে তাতে তাঁর কষ্ট দূর হয়নি বলেই আক্ষেপ করেন। মেয়ের খরচ, বাড়ি ভাড়া সবই তাঁর উপর। তাই আজ বাড়িতে তিনি স্বাধীন। স্বামীও বদলেছে। মারধর করার আগে আজ দু'বার ভাবে, জানালেন মিঠু।
কলকাতার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এই লড়াকু মহিলার কথা, 'মহিলাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। কেন সহ্য করবেন বলুন তো। মানুষ তো, সহ্যের তো সীমা আছে! দিনে কাজ করবেন, রাতেও কাজ করবেন, আপনারও তো অধিকার আছে। আর কাউকে ভয় পেলে হবে না। মহিলা মানেই ভয় পাওয়া নয়।'
শুধু তাই নয়, রাতের শহরে তাঁর মতো মহিলা চালকরা থাকলে যে অনেক বেশি নিরাপত্তা থাকবে মহিলাদেরই, এ কথাও শেষে যোগ করে দেন তিনি।
পুজো এসে গেছে, আগমনী বাজল বলে। মা দুগ্গা চারটে দিনের জন্য মর্ত্যে আসবেন। কিন্তু বাকি প্রতিটা দিন জুড়ে লড়াই, জেদ, সাহসের দৃষ্টান্ত হয়ে থেকে যাবেন মিঠুর মতো এই দুগ্গারাই!