শেষ আপডেট: 1st March 2025 14:02
অন্ধ্রপ্রদেশের মচ্ছিপত্তনম শহর থেকে কিছু দূরে আছে হতদরিদ্র গ্রাম সীতারামপুরম। সেই গ্রামের গরিব কৃষক দামোদর বোল্লার স্ত্রী ভেঙ্কটাম্মা, ১৯৯১ সালের ৭ জুলাই জন্ম দিয়েছিলেন শিশুপুত্র শ্রীকান্তের (Srikanth Bolla)। জন্মের পরই চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, পৃথিবীর আলো দেখতে পাবে না এই শিশু। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল গরীব কৃষক দম্পতির। গ্রামবাসীরা বলেছিলেন, শিশুটিকে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে। কারণ এ ছেলে পৃথিবীর বোঝা। রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ঠাকুমা। গ্রামবাসীদের বলেছিলেন, "সমস্যা আমাদের। আমরাই বুঝে নেব।"
কুসংস্কারাচ্ছন্ন সীতারামপুরমের মাটিতে লড়াই শুরু করেছিল দৃষ্টিহীন শিশু 'শ্রীকান্ত বোল্লা'। ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যেই বন্দি থাকত শ্রীকান্ত। তার সঙ্গে গ্রামের কেউ কথা বলত না। জানলার ধারে সারাদিন বসে থাকত সে। কান পেতে শুনত গ্রামের বাচ্চাদের হুটোপাটির শব্দ। মন চাইত ছুটে যেতে। কিন্তু কী করে যাবে, সে যে চোখে দেখতে পায় না।
শ্রীকান্তের বয়স যখন চার, ঠাকুমা অনেক লড়াই করে শ্রীকান্তকে ভর্তি করেছিলেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে নিদারুণ লাঞ্ছনা ও বৈষম্যের শিকার হয়েছিল শ্রীকান্ত। ক্লাসের শেষ বেঞ্চে তাকে বসিয়ে রাখা হত। সহপাঠীরা তাকে খেলায় নিত না। চুল টেনে পালিয়ে যেত। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিত। ছোট্ট শ্রীকান্তের দিকে ফিরেও তাকাতেন না শিক্ষকেরা। তবুও একলব্য হয়ে গ্রামের স্কুলে তিন বছর কাটিয়ে ফেলেছিল শ্রীকান্ত।
সাত বছর বয়সে শ্রীকান্তকে ভর্তি করা হয়েছিল হায়দ্রাবাদ শহরের একটি স্কুলে। গ্রাম থেকে ৩৪১ কিলোমিটার দূরে থাকা দেবনার স্কুল ফর দ্য ব্লাইন্ড-এর হস্টেলে এসে উঠেছিল শ্রীকান্ত। মা ও ঠাকুমার জন্য মন কাঁদত তার। পালাবার চেষ্টা করত স্কুল থেকে। ঠিক সেই সময়, ছোট্ট শ্রীকান্তকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন ইংরেজির শিক্ষিকা স্বর্ণলতা টাক্কালিপতি। তাঁর মধ্যে শ্রীকান্ত খুঁজে পেয়েছিল মা আর ঠাকুমার ভালবাসা। তাই সবসময় স্বর্ণলতা ম্যাডামের পিছন পিছন ঘুরে বেড়াত ছোট্ট শ্রীকান্ত।
নিজের হাতে শ্রীকান্তকে তৈরি করতে শুরু করেছিলেন স্বর্ণলতা। স্কুল শেষ হয়ে যাওয়ার পর, শুধু শ্রীকান্তের জন্যেই স্কুলে থেকে যেতেন রাত অবধি। কয়েক বছরের মধ্যেই, নিজের শ্রেণিতে প্রথম স্থানটি দখল করে নিয়েছিল শ্রীকান্ত। একই সঙ্গে ছিনিয়ে নিতে শুরু করেছিল বিতর্ক, গল্প লেখা, দাবা, ক্রিকেট ও সাঁতার প্রতিযোগিতার পুরস্কারগুলি। পদক আনতে শুরু করেছিল বিশেষভাবে সক্ষমদের (differently abled) জন্য অনুষ্ঠিত রাজ্য ও জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতাগুলি থেকেও।
ভারতের একাদশ রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম, লিড ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন ২০০৬ সালের ৬ আগস্ট। ২০২০ সালের মধ্যে ভারতকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। দেশের কোটি কোটি কিশোর কিশোরীকে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তৈরি করে দিতে চেয়েছিলেন।
ভাষণের মাঝখানে ডঃ কালাম ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন করেছিলেন, " বড় হয়ে কী হতে চাও তোমরা?" কেউ বলেছিল, বড় হয়ে সে হবে ডাক্তার। কেউ বিজ্ঞানী। কেউ গবেষক। কেউ বা অধ্যাপক। শ্রীকান্ত বলেছিল, "আমি ভারতের প্রথম দৃষ্টিহীন রাষ্ট্রপতি হতে চাই।" হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন সবাই, কিন্তু শিশুর মত হাততালি দিয়ে উঠেছিলেন ডঃ কালাম। আলাদা করে শ্রীকান্তকে ডেকে নিয়েছিলেন অনুষ্ঠানের শেষে। একান্তে বলেছিলেন কথা। এক নিবিড় বন্ধুত্বের সুত্রপাত হয়েছিল সেইদিন। যা অটুট ছিল কালামের মৃত্যু অবধি।
২০০৭ সালে, দশম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায় 'স্টার' পেয়ে পাশ করেছিল শ্রীকান্ত। বিজ্ঞান নিয়ে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন ছিল মনে। ফর্ম তুলতে গিয়েছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কারণ দশম শ্রেণির পর ভারতে দৃষ্টিহীনরা বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে পারে না। তাই শ্রীকান্তকে কলা বিভাগে ভর্তির পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কান্নায় ভেঙে পড়েছিল শ্রীকান্ত। পিঠে ভরসার হাত রেখেছিলেন সেই স্বর্ণলতা। পরামর্শ দিয়েছিলেন, আইনের পথ ধরার। উকিলের খরচ যোগাবেন তিনিই।
আইনি লড়াই শুরু করার পর, শ্রীকান্ত জেনেছিল, 'চিন্ময়া' নামের এক বেসরকারি বিদ্যালয়, একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে দৃষ্টিহীনদের ভর্তি করে। তবে বোর্ড আলাদা। একবুক আশা নিয়ে সেই বিদ্যালয়ে ছুটে গিয়েছিল শ্রীকান্ত। তার সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষিকা। বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি নিয়ে নিয়েছিলেন শ্রীকান্তকে। বিদ্যালয়টির শিক্ষক শিক্ষিকারা জানতেন, কীভাবে বিশেষভাবে নির্মিত মডেল ও দ্বিমাত্রিক ডায়াগ্রামের সাহায্যে দৃষ্টিহীনদের উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া যায়।
ছ'মাস পর মামলায় জিতে গিয়েছিল শ্রীকান্ত। অন্ধ্রপ্রদেশের সমস্ত সরকারি বিদ্যালয়ে, একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে, দৃষ্টিহীন ছাত্রদের ভর্তি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন মহামান্য আদালত। শ্রীকান্ত চলে গিয়েছিল সরকারি স্কুলে। ২০০৯ সালে, দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায়, ৯৩ শতাংশ নম্বর পেয়ে রাজ্যকে অবাক করে দিয়েছিল শ্রীকান্ত। তবে নিজে অবাক হয়নি, কারণ সে দেখছিল আরও বড় স্বপ্ন ছিল। দেশের প্রথম দৃষ্টিহীন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন। তাই সে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে বিটেক পড়বে আইআইটিতে।
প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য নামকরা কোচিং সেন্টারগুলিতে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করেছিল শ্রীকান্ত। দৃষ্টিহীন বলে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল কোচিং সেন্টারগুলি। কোচিং ছাড়াই প্রবেশিকা পরীক্ষার ফর্ম ভরেছিল শ্রীকান্ত। কিন্তু তাকে দেওয়া হয়নি পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড। জেদি শ্রীকান্ত বদলে ফেলেছিলেন পথের অভিমুখ। বিজনেস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়ার জন্য আবেদন করেছিলেন আমেরিকার কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে ছিল স্ট্যানফোর্ড, বার্কলে ও কার্নেগি মেলনের মত বিশ্ববিদ্যালয়।
আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে। বিশ্ববিখ্যাত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান বিশ্বের সেরা সেরা ছাত্ররাই। সবাইকে অবাক করে, অবহেলিত শ্রীকান্তকে ডেকে নিয়েছিল ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির (MIT) 'স্লোয়ান স্কুল অফ ম্যানেজমেন্ট'। শ্রীকান্তকে দেওয়া হয়েছিল মোটা অঙ্কের স্কলারশিপ। শ্রীকান্তই ছিলেন এমআইটির ইতিহাসের প্রথম বিদেশি দৃষ্টিহীন ছাত্র।
২০১১ সালে, নজরকাড়া রেজাল্ট করে এমআইটির বিজনেস স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন শ্রীকান্ত। নিয়োগপত্র হাতে নিয়ে দুয়ারে ছুটে এসেছিল বিশ্ববিখ্যাত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি। সবিনয়ে সব প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন শ্রীকান্ত। কারণ তিনি চাকরি করবেন না, তিনি বহু মানুষকে চাকরি দেবেন। শ্রীকান্ত চাকরি দেবেন বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের। লড়াই করবেন তাদের প্রতি সমাজের অন্যায় ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে। তাই বস্টন এয়ারপোর্ট থেকে শ্রীকান্ত ধরেছিলেন ভারতেগামী বিমান।
দেশে ফিরে হায়দ্রাবাদ শহরের এক ভাড়াবাড়িতে শ্রীকান্ত শুরু করেছিলেন 'সমন্বয়' ( Samanvai) নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। কম্পিউটার শেখাতে শুরু করেছিলেন, দৃষ্টিহীন ও বহু প্রতিবন্ধকতা (Multiple disabilities) যুক্ত ছাত্রছাত্রীদের। অর্থ সাহায্য করেছিল MIT। কিছুদিনের মধ্যেই শ্রীকান্ত শুরু করেছিলেন ডিজিটাল লাইব্রেরি, ব্রেল প্রিন্টিং প্রেস ও অবৈতনিক কোচিং সেন্টার।
তবুও রাতের পর রাত জেগে থাকতেন শ্রীকান্ত। তাঁকে কুরে কুরে খেত একটাই চিন্তা। যাঁদের শিক্ষা দিতে পারবেন না, তাঁদের কী হবে! আমেরিকায় গিয়ে শ্রীকান্ত দেখেছিলেন, সবাই বিভিন্নভাবে পরিবেশকে বাঁচাতে চাইছে। কাগজের তৈরি কাপ, প্লেট, চামচ ব্যবহার করছে প্লাস্টিকের বদলে। কোম্পানিগুলি এই সামান্য পণ্য উৎপাদন করে উপার্জন করছে লক্ষ লক্ষ ডলার। শ্রীকান্ত বুঝেছিলেন ভারতেও একদিন পণ্যগুলির চাহিদা হবে আকাশ ছোঁয়া।
এরপর ২০১২ সালে, হায়দ্রাবাদ শহরের নিকটবর্তী নাচারাম এলাকায় জন্ম নিয়েছিল শ্রীকান্ত বোল্লার কোম্পানি বোল্লান্ট ইন্ড্রাস্ট্রিজ। দরমার বেড়া দেওয়া একফালি ঘর, মাথায় টালির চাল। মাত্র পাঁচজন বিশেষভাবে সক্ষম কর্মী নিয়ে, কাগজের কাপ, প্লেট, টিফিন বক্স ও ট্রে উৎপাদন করতে শুরু করেছিলেন একুশ বছরের দৃষ্টিহীন যুবক। নিজের পণ্য দোকানে দোকানে নিজেই দিয়ে আসতেন এমআইটির গ্র্যাজুয়েট শ্রীকান্ত বোল্লা।
এক বন্ধুর সুত্রে শ্রীকান্তের আলাপ হয়েছিল লেখক ও বিনিয়োগ কুশলী রবি মান্থার সঙ্গে। রবি গিয়েছিলেন শ্রীকান্তের কারখানায়। মান্থাকে কারখানা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন শ্রীকান্ত। তারপর হঠাৎই দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন একটি মেশিনের সামনে। মাথা নেড়ে বলেছিলেন শ্রীকান্ত বলেছিলেন, "মেশিনটা ঠিক মত কাজ করছে না।" মেকানিক এসে বলেছিলেন শ্রীকান্তের অনুমান সঠিক। এরপর আর এক মুহূর্তও দেরি করেননি রবি মান্থা। কয়েক লাখ টাকার চেক তুলে দিয়েছিলেন শ্রীকান্তের হাতে। সেই প্রথম বিনিয়োগ এসেছিল শ্রীকান্তের কোম্পানিতে।
ক্রমশ আড়ে বহরে বাড়তে শুরু করেছিল বোল্লান্ট ইন্ডাস্ট্রিজ। ফেলে দেওয়া কৃষিজ বর্জ্য, পান, সুপারি , নারকেল পাতা দিয়ে টেকসই কাপ, প্লেট ও ট্রে তৈরি করতে শুরু করেছিলেন শ্রীকান্ত। মিউনিসিপ্যালিটির ফেলে দেওয়া বর্জ্য দিয়ে তৈরি করতে শুরু করেছিলেন পরিবেশ বান্ধব কাগজ। যা কিনতে শুরু করেছিল ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের প্যাকেজিং ইন্ড্রাস্ট্রি।
হায়দ্রাবাদকে ২০১৪ সালে নবনির্মিত তেলেঙ্গানা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। একই সঙ্গে অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানায় ব্যবসা বাড়াতে চেয়েছিলেন শ্রীকান্ত। তাই পনেরো কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার জন্য গিয়েছিলেন ব্যাঙ্কে। কিন্তু এক্ষেত্রেও দৃষ্টিহীন বলে শ্রীকান্তকে ফিরিয়ে দিয়েছিল ব্যাঙ্কগুলি। ক্ষুব্ধ শ্রীকান্ত অফিসারদের বলেছিলেন," আমি জানি আপনারা তাদেরই ঋণ দেন, যারা ঋণ শোধ করে না এবং দেশকে ঠকায়।"
এরপর আর কোনওদিন ঋণের জন্য ব্যাঙ্কে পা রাখেননি শ্রীকান্ত। কারণ একে একে শ্রীকান্তের কোম্পানিতে লগ্নি করতে এসেছিলেন এস পি রেড্ডি (enGenius), শ্রীনি রাজু( Peepul Capital and ILabs), সতীশ রেড্ডি( Dr Reddy's Labs) কিরণ গ্রন্ধি (GMR Group), অরুণ আলাগাপন (TI Cycles) ও অনিল চালামালাশেট্টির (Greenko) মত শিল্পপতিরা।
তবে কোম্পানির সবথেকে বড় বিনিয়োগটি এসেছিল ২০১৬ সালে। কালামের ভাবশিষ্য শ্রীকান্তের সঙ্গে আলাপচারিতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন টাটা সাম্রাজ্যের অধীশ্বর রতন টাটা। শ্রীকান্তের মধ্যে আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখেছিলেন তিনি। শ্রীকান্তের পিঠে হাত রেখে রতন টাটা বলেছিলেন, "পাশে আছি"। এরপরই তিনি মোটা অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন শ্রীকান্তের কোম্পানিতে।
আজ দৃষ্টিহীন শ্রীকান্ত বোল্লার কোম্পানির মোট সম্পদ ৫০০ কোটি টাকা। উৎপাদিত পণ্যের ১৫ শতাংশ শ্রীকান্ত রপ্তানি করেন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানিতে। ২০২৫ সালের মধ্যেই ১০০০ কোটি টাকার ইউনিকর্ন কোম্পানিতে পরিণত হতে চলেছে বোল্লান্ট ইন্ড্রাট্রিজ। আর মাত্র তিন বছরের মধ্যেই পৃথিবীর সেরা সেরা স্টক এক্সচেঞ্জে নথিভুক্ত হয়ে যাবে শ্রীকান্তের কোম্পানির নাম।
বোল্লান্ট ইন্ড্রাট্রিজ ভারতের সেই মুষ্টিমেয় কোম্পানিগুলির মধ্যে একটি, যে কোম্পানির কারখানা থেকে কোনও বর্জ্য বের হয় না। কারণ বর্জ্যগুলির ১০০ শতাংশই উৎপাদনের কাজে লাগিয়ে দেন পরিবেশ বন্ধু শ্রীকান্ত। বিদ্যুতের পিছনে শ্রীকান্তের খরচ নামমাত্র, কারণ তাঁর কারখানাগুলি চলে সৌরশক্তির সাহায্যে।
শ্রীকান্তের হাতে আজ দশটি কারখানা। কর্মী সংখ্যা প্রায় ৬৫০। কারখানার বাইরেও শ্রীকান্তের ওপর নির্ভরশীল প্রায় ২৫০০ পরিবার। বোল্লান্টের ৩৬ শতাংশ কর্মীই বিশেষভাবে সক্ষম'। যে রেকর্ড ভারতের কেন, বিশ্বের অন্য কোনও কোম্পানির নেই। বাকি কর্মীদের বেশিরভাগই দুঃস্থ মহিলা। নিজের খরচে যাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সম্মানজনকভাবে বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছেন শ্রীকান্ত।
তাই কর্মীরা বলেন, "বোল্লার মত 'বস' হয় না। তাঁর ঘরের দরজা সবসময় আমাদের জন্য খোলা থাকে।" আসলে শ্রীকান্তের মনের কথা লুকিয়ে আছে কোম্পানির ট্যাগ লাইনে। সেটি হল “Where everyone counts.” সমাজ প্রান্তিক মানুষদের মূল্যহীন ও বোঝা মনে করলেও, বোল্লান্ট ইন্ড্রাট্রিজ কখনও কাউকে মূল্যহীন ভাবে না। প্রত্যেককেই সম্পদ বলে মনে করা হয়।
সমন্বয় ও বোল্লান্টের পাশাপাশি, ২০১৬ সালে শ্রীকান্ত গড়ে তুলেছেন সার্জ ইমপ্যাক্ট ফাউন্ডেশন। কালামের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত শ্রীকান্ত, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে উপহার দিতে চলেছেন নবীন প্রজন্মের কয়েকশো উদ্যোগপতি। যাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই বিশেষভাবে সক্ষম যুবক যুবতী, যাঁদেরকে আমরা তাচ্ছিল্য সহকারে বলে থাকি 'প্রতিবন্ধী'।
একত্রিশ বছরের শ্রীকান্ত পেয়েছেন অজস্র জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার। শ্রীকান্তের দাঁত চাপা লড়াই ও রূপকথার মত উত্থান নিয়ে ছবি বানাতে চলেছেন বলিউডের অভিনেতা রাজকুমার রাও। আজ শ্রীকান্তকে অনুপ্রেরণামূলক ভাষণ দেওয়ার জন্য ডাকে বিশ্বের নানা দেশ। সাফল্যের এভারেস্টে আরোহণ করার পরেও কিন্তু শ্রীকান্ত মনে করেন, তাঁর জীবনের সেরা পুরষ্কারের নাম এপিজে আব্দুল কালাম।
ডঃ কালামই শ্রীকান্তের আদর্শপুরুষ। অন্যদিকে বিভিন্ন ভাষণে শ্রীকান্তের নাম উল্লেখ করতেন ডঃ কালাম। বিনয়ী মানুষটি বলতেন, "আমার রোল মডেল হল শ্রীকান্ত বোল্লা। সেই আমার হিরো।" জহুরী কালাম তাঁর ঐশ্বরিক অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ঠিক খুঁজে নিয়েছিলেন, পাথর ভেবে অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলা, ধুলো মাখা হিরের টুকরোকে।
ঠাকুমা আজ প্রয়াত। মা বাবাকে কিনে দিয়েছেন বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও গাড়ি। ২০২২ সালের ২৩ এপ্রিল, বিয়ে করেছেন ভিরা স্বাথীকে। এতকিছুর পরেও শ্রীকান্ত কিন্তু ভোলেননি ইংরেজির দিদিমনি স্বর্ণলতা টাক্কালিপতিকে। যাঁর ঋণ কোনওদিনই শোধ করতে পারবেন না শ্রীকান্ত। দিদিমনি স্বর্ণলতা আজ বোল্লান্ট ইন্ড্রাট্রিজের ম্যানেজিং ডিরেক্টর।
হারতে থাকা বাজি একের পর এক জিতে নিয়ে আজ শ্রীকান্ত প্রমাণ করে দিয়েছেন তিনিই বাস্তবের 'বাজিগর'। প্রমাণ করে দিয়েছেন, দৃষ্টি হারিয়ে গেলেও অন্তদৃষ্টি হারায় না। তাই তো শ্রীকান্ত তাঁর ভাষণে বলে থাকেন, "চোখ দিয়ে অবশ্যই দেখুন। তবে দৃষ্টি কিন্তু চোখে দেখার থেকেও অনেক দূরের বস্তু। যার বাস মানুষের মনে। আমি চোখের সাহায্য না পেয়ে, মন ও জেদকে সম্বল করে, সমস্ত প্রতিকূলতাকে হারিয়ে, বাজি জিতে নিয়েছি। সমাজকে দেখিয়ে দিয়েছি, দৃষ্টিহীন মানেই সমাজের বোঝা নয়। দৃষ্টিহীনরাও পারে দেশকে নেতৃত্ব দিতে।"
শ্রীকান্ত বোল্লা সত্যিই আজ 'লাইটহাউস'। হতাশার সমুদ্রে হারিয়ে যেতে বসা নবীন প্রজন্মকে সাফল্যের তীরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নেমেছেন নতুন এক সংগ্রামে। সেই শ্রীকান্ত বোল্লা, যাঁকে একসময় বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল সমাজ।