
রূপাঞ্জন গোস্বামী
আরব সাগরের তীরে আছে গুজরাতের চোরওয়াদ গ্রাম। জুনাগড় জেলার এই উপকূলবর্তী গ্রামে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিরাজ করছেন জাগ্রত দেবী চোরওয়াদি ভবানী মাতা। তাল, নারকেল, খেজুর ও সুপারি গাছে ঘেরা গ্রামে বাস করেন ‘মধ’ সম্প্রদায়। যে সম্প্রদায় থেকে উঠে এসেছিলেন জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী (Mahatma Gandhi) ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi)। এই গ্রামেই একসময় বাস করতেন বেনিয়া-মধ সম্প্রদায়ের হিরাচাঁদ আম্বানি ও তাঁর স্ত্রী যমুনাবেন। তাঁদের চার সন্তান রামনিকলাল, ধীরজলাল, সৌরভ ও ত্রিলোচনাবেনকে নিয়ে।
হিরাচাঁদের দ্বিতীয় পুত্র ধীরজলালের জন্ম হয়েছিল ১৯৩২ সালের ২৮ ডিসেম্বর। গ্রামের লোকেরা ধীরজলালকে ডাকতেন ধীরুভাই (Dhirubhai Ambani) নামে। ছোট্ট বেলা থেকেই ধীরুভাই অনুভব করতেন, তাঁরা ধনী নন। শিক্ষক বাবা তাঁর সামান্য বেতন দিয়ে কোনও মতে সংসার চালানোর চেষ্টা করছেন। তাই বাবাকে কখনও কিছু কিনে দেওয়ার জন্য বলতেন না ধীরুভাই। বাবার কাছে প্রাথমিক পাঠ নেওয়ার পর, ধীরুভাইকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল, জুনাগড়ের নবাবদের প্রতিষ্ঠা করা বাহাদুর খানজি হাইস্কুলে।

স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন বটে, তবে পড়াশুনায় মন ছিল না ধীরুভাইয়ের। স্বাধীনতা আন্দোলন ও সাংসারিক অভাবই ছিল এর কারণ। কয়েক যুগ আগে থেকেই ভারতের বিভিন্ন জায়গায়, ব্রিটিশ, স্থানীয় শাসক ও জমিদারদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল ‘প্রজা মণ্ডল আন্দোলন’। যার আঁচ এসে পড়েছিল জুনাগড়েও। সেই সময় জুনাগড়ের নবাব পাকিস্তানের মানচিত্রে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন জুনাগড়কে। কিশোর ধীরুভাই সহপাঠীদের নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন প্রজা মণ্ডল আন্দোলনে। ধীরুভাইয়ের মধ্যে ভবিষ্যতের জননেতাকে দেখেছিল জুনাগড়।
কিন্তু সেই সময় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বাবা হিরাচাঁদ। দুষ্কর হয়ে উঠেছিল সংসার চালানো। ম্যাট্রিকের পর তাই পড়াশুনায় ইতি টানতে বাধ্য হয়েছিলেন ধীরুভাই। হিন্দু ও জৈনদের পবিত্র তীর্থ গিরনার পর্বতের পাদদেশে, তীর্থযাত্রীদের কাছে চা ও পকোড়া বেচতে শুরু করেছিলেন শনি ও রবিবার। সামান্য টাকা আয় হতো বাঁশের চালার দোকানটি থেকে।

ধীরুভাইয়ের দাদা রামনিকলাল আম্বানি, ভাগ্যের খোঁজে চলে গিয়েছিলেন পশ্চিম এশিয়ার ব্রিটিশ কলোনি ও বন্দর শহর এডেনে (বর্তমানে ইয়েমেনের অংশ)। ১৯৪৮ সালে দাদার কাছে চলে গিয়েছিলেন ষোল বছরের ধীরুভাই। বিত্তবান ফরাসি ব্যবসায়ী অ্যান্তোনিন বেসের কোম্পানিতে (A. Besse and Co) ক্লার্কের কাজে যোগ দিয়েছিলেন। মাসিক ৩০০ টাকা বেতনে।
অফিসে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে, প্রবীন কর্মাচারীদের কাছ থেকে ধীরুভাই জেনে নিতে শুরু করেছিলেন আমদানী ও রফতানি ব্যবসার খুঁটিনাটি। তাঁদের কোম্পানি শেল (Shell) সংস্থার একটি তৈল শোধনাগার পরিচালনা করত। কয়েক বছরের মধ্যেই ধীরুভাই নিজের কর্ম দক্ষতায় হয়ে গিয়েছিলেন তেলের ডিপোর সেলস ম্যানেজার। বেতন মাসে ১১০০ টাকা।
ব্যবসার কারণে ধীরুভাইকে কথা বলতে হত এডেনে আসা বিভিন্ন দেশের ক্রেতাদের সঙ্গে। নিজের চেষ্টায় শিখে নিয়েছিলেন ইংরেজি ও আরবী ভাষা। সেই সময় কোম্পানির কর্মীরা পঁচিশ পয়সায় এক কাপ চা পেতেন। কিন্তু ধীরুভাই চা খেতে যেতেন নির্দিষ্ট একটি রেস্টুরেন্টে। যেখানে চায়ের দাম এক টাকা। কারণ সেই রেস্টুরেন্টে আসতেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধনী ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন কোম্পানির এজেন্টেরা। তাঁদের সঙ্গে যেচে আলাপ করে, ধীরুভাই জেনে নিতেন বিভিন্ন ব্যবসার নাড়ি নক্ষত্র।

ধীরুভাইয়ের বয়স তখন তেইশ। তাঁর জীবনে এসেছিলেন জামনগরের কোকিলাবেন। বিয়ে হয়েছিল চোরওয়াদের গ্রামের বাড়িতেই। তখনও গ্রামে আসেনি বিদ্যুৎ। যাতায়াত করতে হত গরুর গাড়িতে। বিয়ের পর কোকিলাবেনকে পানীয় জল আনতে হত গ্রামের কুয়ো থেকে। কিছুদিন চোরওয়াদে কাটিয়ে ধীরুভাই ফিরে গিয়েছিলেন এডেনে। বছর খানেক পরে কোকিলাবেনকে চিঠি লিখেছিলেন ধীরুভাই। চিঠিতে লেখা ছিল, “তোমাকে এডেন আসতে হবে । আমি একটা গাড়ি কিনেছি। বলোতো গাড়ির রঙটা কী?” প্রশ্নের উত্তর পরের লাইনেই দিয়েছিলেন ধীরুভাই। রসিক ধীরুভাই লিখেছিলেন,”গাড়ির রঙ কিন্তু আমার মত কালো।”
এডেন চলে গিয়েছিলেন কোকিলাবেন। পাহাড় ঘেরা বন্দর শহরে পেতেছিলেন সংসার। ১৯৫৭ সালের ১৯ এপ্রিল, এডেনের হাসপাতালে জন্ম নিয়েছি্লেন ধীরুভাইয়ের প্রথম সন্তান মুকেশ (Mukesh Ambani)। ছোট্ট সংসারে যখন খুশির ঢেউ, এডেন জুড়ে শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার যুদ্ধ। ১৯৫৮ সালে, প্রায় শুন্য হাতে ভারতে ফিরে এসেছিলেন ধীরুভাই। লজ্জায় নিজের গ্রামে ফিরতে পারেননি। পরিবার নিয়ে উঠেছিলেন, দক্ষিণ মুম্বাইয়ের ভুলেশ্বর এলাকার জয় হিন্দ এস্টেটের এক কামরার একটি ফ্ল্যাটে।

অচেনা মুম্বাই শহরে ব্যবসা শুরু করেছিলেন ধীরুভাই। খুড়তুতো ভাই চম্পকলাল দামানির সঙ্গে। নিজের শেষ সম্বল পনেরো হাজার টাকা লাগিয়ে দিয়েছিলেন ব্যবসায়। এডেন থেকে আমদানী করতেন পলিয়েস্টারের সুতো। ভারত থেকে এডেনে রফতানি করতেন মসলা। দক্ষিণ মুম্বাইয়ের মসজিদ বান্দর এলাকার ২৪০ নং নারসি নাথ স্ট্রিটে, ৫০০ বর্গ ফুটের একটি ফ্ল্যাট ছিল ধীরুভাইয়ের অফিস। অফিসে ছিল তিনটি চেয়ার, একটি টেবিল ও একটি টেলিফোন। যাত্রা শুরু করেছিল রিলায়েন্স কমার্শিয়াল কর্পোরেশন। মাত্র দুজন কর্মী নিয়ে। ১৯৫৯ সালের ৪ জুন, জন্ম নিয়েছিলেন ধীরুভাইয়ের দ্বিতীয় পুত্র অনিল (Anil Ambani)। আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় মসলা ও ভারতের বাজারে পলিয়েস্টার সুতোর চাহিদা থাকায় জমে উঠেছিল ধীরুভাইয়ের ব্যবসা।

ধীরুভাইয়ের তখন ভরা সংসার। জন্ম নিয়েছিলেন দুই কন্যা নীনা ও দীপ্তি। কিনে ফেলেছিলেন একটি ফিয়াট গাড়িও। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরও সংসারকে সময় দিতেন ধীরুভাই। পরিবার নিয়ে ঘুরতে যেতেন বিভিন্ন সৈকতে। একই সঙ্গে ছেলে মেয়েদের মধ্যে লড়াই করার মানসিকতা তৈরি করার চেষ্টা করতেন। ছেলে মেয়েরা কেউ কিছুই চাইলে ধীরুভাই বলতেন, “আগে আমার সঙ্গে পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফেরো। তবেই পাবে তোমার জিনিস।” তিনি সন্তানদের বোঝাতে চাইতেন বিনা পরিশ্রমে এই পৃথিবীতে কিছু পাওয়া যায় না।
ধীরুভাই ও তাঁর পার্টনার চম্পকলালের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল ১৯৬৪ সালে। চম্পকলাল কোনও ঝুঁকি নিতে চাইতেন না। কিন্তু ধীরুভাই বলতেন, ঝুঁকি না নিলে ব্যবসা বাড়ানো সম্ভব নয়। ১৯৬৫ সালে দুজনের পথ হয়ে গিয়েছিল আলাদা। ১৯৬৬ সালে যাত্রা শুরু করেছিল ধীরুভাইয়ের রিলায়েন্স টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার্স প্রাইভেট লিমিটেড। গুজরাটের নারদায় ধীরুভাই স্থাপন করেছিলেন পলিয়েস্টার সুতো তৈরির একটি মিল। মাসের পর মাস মিলে পড়ে থাকতেন ধীরুভাই। কর্মীদের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন ব্যাক্তিগত সম্পর্ক। সঙ্গী হয়ে গিয়েছিলেন তাদের সুখ দুঃখের। খাবার খেতেন কর্মীদের সঙ্গেই। তাই কর্মীরাও কাজের মাধ্যমে ধীরুভাইয়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন।
পরের বছরেই উচ্চমানের পলিয়েস্টার সুতো বাজারে এনেছিলেন ধীরুভাই। কিন্তু ক্রেতা ছিল না। খুচরো ব্যবসায়ীদের আড়তে নিজে গিয়ে সুতো বিক্রি করতে শুরু করেছিলেন নাছোড়বান্দা ধীরুভাই। বাজারের থেকে কম দামে। বিশ্বব্যাঙ্কের পরিদর্শকেরা এসেছিলেন নারদা মিল দেখতে। তাঁরা বলেছিলেন ধীরুভাইয়ের পলিয়েস্টার সুতো বিশ্বমানের। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি ধীরুভাইকে। তাঁর কোম্পানির পলিয়েস্টার সুতো বাজার দখল করে ফেলেছিল। ১৯৭৩ সালের ৮ মে কোম্পানির নাম বদলে ফেলে, ধীরুভাই রেখেছিলেন ‘রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ’ (Reliance Industries)। কোম্পানির মোট সম্পদ পৌঁছে গিয়েছিল ২০ কোটিতে।

ধীরুভাই তাতেও খুশি নন। তাঁর স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়ার। তার জন্য দরকার আরও মূলধন। ব্যাঙ্কের দ্বারস্থ হয়েছিলেন ধীরুভাই। ফিরিয়ে দিয়েছিল ব্যাঙ্ক। ধীরুভাই নিয়েছিলেন এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। সে যুগে শেয়ার বাজার ছিল প্রভাবশালী ধনীদের হাতে। দূরে ছিলেন মধ্যবিত্তেরা। ১৯৭৫ সালে রিলায়েন্সকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করে দিয়েছিলেন ধীরুভাই । ১৯৭৭ সালে বাজারে ছেড়েছিলেন ২৮ লক্ষ শেয়ার। বেশিরভাগ শেয়ার কিনেছিলেন মধ্যবিত্তেরা। বাজার থেকে ধীরুভাই তুলে নিয়েছিলেন ১৪ কোটি টাকা। উচ্চহারে লভ্যাংশ ফেরত দিতে শুরু করেছিলেন শেয়ার হোল্ডারদের। এক সময় শেয়ার বাজারের ‘সূর্য’ হয়ে উঠেছিলেন ধীরুভাই আম্বানি।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ভালোবাসতেন ধীরুভাই। তাই ১৯৭৩ সালে নিয়ে এসেছিলেন রিলায়েন্সের নিজস্ব কাপড়ের ব্র্যান্ড বিমল(VIMAL)। বড় ভাই রামনিকলালের ছেলে বিমলের নামে, রেখেছিলেন ব্র্যান্ডটির নাম। প্রায় অলৌকিক বিপণন ক্ষমতা ছিল ধীরুভাইয়ের। বিমলের বিজ্ঞাপনের কাজে লাগিয়েছিলেন নামী চিত্রতারকা, মডেল ও ক্রিকেটারদের। ভারত জুড়ে ঝড় তুলেছিল মাত্র দুটি শব্দ, “ওনলি বিমল“। পিছিয়ে পড়েছিল কপিল মেহরার ‘ওরকে মিলস’ ও নেসলি ওয়াদিয়ার ‘বোম্বে ডাইং’। ধীরুভাইয়ের নাম হয়ে গিয়েছিল ‘পলিয়েস্টার কিং‘।

আমেরিকা থেকে এমবিএ করার পর, ১৯৮১ সালে বড় ছেলে মুকেশকে ব্যবসায় নিয়ে এসেছিলেন ধীরুভাই। কারণ অতিরিক্ত পরিশ্রমে ক্রমশ ভেঙে যাচ্ছিল শরীর। মুকেশকে দিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের পাতালগঙ্গা ফ্যাক্টরির দায়িত্ব। ১৯৮৩ সালে ব্যবসায় এনেছিলেন ছোট ছেলে অনিলকেও। তাঁকে দিয়েছিলেন নারদা প্ল্যান্টের দায়িত্ব। ১৯৮৫ সালের মধ্যেই রিলায়েন্সের সম্পদ ছুঁয়েছিল ১০০০ কোটির মাইলস্টোন।
কিন্তু ১৯৮৬ সালে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন ধীরুভাই। ধাক্কা সামলে উঠলেও, পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল ধীরুভাইয়ের ডান হাত। বিচক্ষণ ধীরুভাই সেই বছরেই, কোম্পানির অংশীদার করে নিয়েছিলেন পুত্র মুকেশ ও অনিলকে। দুই পুত্রের হাতে ছাড়তে শুরু করেছিলেন দায়িত্ব। তবে মুকেশের ওপর নির্ভর করতেন বেশি। কারণ বাবার মতই ঠাণ্ডা মাথা ছিল মুকেশের।

অসুস্থ হয়েও, এডেনে দেখা যৌবনের এক স্বপ্নকে সফল করেছিলেন ধীরুভাই। ১৯৮৭ সালে পেট্রোলিয়াম ব্যবসায় প্রবেশ করেছিল ধীরুভাইয়ের রিলায়েন্স। গড়ে তুলেছিলেন সুরাটের হাজিরা পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্স। আসাম সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে গড়ে তুলেছিলেন “রিলায়েন্স আসাম পেট্রোকেমিক্যাল লিমিটেড’। ১৯৯৯ সালের ১৪ জুলাই গুজরাটের জামনগরে যাত্রা শুরু করেছিল ধীরুভাইয়ের ‘জামনগর রিফাইনারি’। বিশ্বের বৃহত্তম তৈলশোধনাগার।
স্ত্রী কোকিলাবেন ছাড়া কোনও অনুষ্ঠানে যেতেন না ধীরুভাই। কারণ স্ত্রী কোকিলাই তাঁর ভাগ্যলক্ষ্মী। নতুন প্রজেক্ট শুরু করার আগে স্ত্রী কোকিলার সঙ্গে আলোচনা করতেন ধীরুভাই। স্ত্রী কোকিলাবেন ইংরেজি জানতেন না। ছেলেমেয়েদের ইংরেজি শেখাতে বাড়িতে আসতেন শিক্ষক। ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই স্ত্রীকে ইংরেজি শিখতে বসিয়ে দিয়েছিলেন ধীরুভাই। স্বামীর আদেশ মেনে নিয়েছিলেন কোকিলা। নিজের চোখে কোকিলা তখন দেখছিলেন রিলায়েন্স সাম্রাজ্যের উত্থান। ফিয়াট গাড়ি আর চড়তে হয় না তাঁকে। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে অগুণতি বিদেশি গাড়ি। তাঁকে দেশে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকে, ধীরুভাইয়ের ব্যক্তিগত হেলিকপ্টার ও জেট বিমান।

হিসেবী ছিলেন, তবে কৃপণ ছিলেন না ধীরুভাই। মাঝে মধ্যেই নিজের বন্ধুদের নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন শখের বিমান যাত্রায়। কোকিলাকেও বলতেন, বিমান বা হেলিকপ্টার করে তাঁর বন্ধুদের ঘুরিয়ে আনতে। আসলে কুবেরের সম্পদ একা ভোগ করার অভ্যেস ছিল না ধীরুভাইয়ের। সকলের অজান্তে দান করতেন। অনেক সময় প্রাপক জানতেনই না, বিপদের দিনে টাকা পাঠিয়েছেন স্বয়ং ধীরুভাই।
১৯৯৫ সালে পরিবারের সবাইকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন চোরওয়াদি গ্রামের পৈত্রিক ভিটেতে। প্রায় চল্লিশ হাজার গ্রামবাসীকে খাইয়েছিলেন রাজকীয় ভোজ। দিয়েছিলেন সাধ্যমত উপহার। গ্রামের উন্নয়নে দিয়েছিলেন বিশাল অঙ্কের অর্থ। তবে প্রত্যেক নতুন প্রজেক্ট শুরু হওয়ার আগে, বাধ্যতামূলকভাবেই চোরওয়াদি ভবানী মাতার আশীর্বাদ নিতে যেতেন ধীরুভাই ও কোকিলা। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করতেন দেবী ভবানীর আশীর্বাদেই মা লক্ষ্মী অচলা হয়ে আছেন আম্বানি পরিবারে।

উল্কাগতিতে বেড়ে চলেছিল রিলায়েন্স সাম্রাজ্য। ভাঙছিল ধীরুভাইয়ের শরীর। হাঁটাচলা করতেও কষ্ট হত। তবুও উপস্থিত থাকতেন কোম্পানির সব মিটিংয়ে। তাঁকে বসতে উঠতে সাহায্য করতেন ছায়াসঙ্গী মুকেশ। কিন্তু ২০০২ সালের ২৪ জুন আবার স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন ধীরুভাই। ভর্তি করা হয়েছিল মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে কোমায় চলে গিয়েছিলেন ধীরুভাই। ২০০২ সালের ৬ জুলাই, ৬৯ বছর বয়সে, নিজের গড়ে তোলা সাম্রাজ্য ছেড়ে বিদায় নিয়েছিলেন, স্বাধীনতার পরবর্তী ভারতের সবচেয়ে চর্চিত, বিতর্কিত ও সফল শিল্পপতি ধীরুভাই আম্বানি। এডেনে জমানো ১৫,০০০ টাকা তখন পৌঁছে গিয়েছিল ৬৫,০০০ কোটিতে। কীভাবে তা ছেলেদের বলে গিয়েছিলেন ধীরুভাই।

তিনি মুকেশ ও অনিলকে বলতেন, সুযোগ আসবেই। সেই সুযোগ অন্য কেউ ছিনিয়ে নেওয়ার আগেই তোমরা ছিনিয়ে নাও। পথে চলতে গেলে এগিয়ে আসবে সারমেয়র দল। পাথর তুলে তাদের ঢিল মারতে মারতে এগিও না। নষ্ট হবে সময়। পকেটে বিস্কুট রাখো, এগিয়ে চলো নির্বিঘ্নে। একটা কথা জানবে। সাফল্যের জন্য অর্থের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতার। নিজের স্বপ্ন নিজে সফল করো। না হলে অন্য কেউ তোমাকে ভাড়া করে পৌঁছে যাবে তার স্বপ্নে। তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনেছিলেন মুকেশ। ধীরুভাইয়ের ফর্মুলাতেই, ১৫,০০০ টাকার রিলায়েন্সকে আজ তিনি পৌঁছে দিয়েছেন ১৮ লক্ষ কোটিতে।
