পুরুলিয়া অস্ত্রবর্ষণের তিন দশক। গ্রাফিক্স - শুভ্র শর্ভিন
শেষ আপডেট: 26th December 2024 14:17
চলতি মাসের গোড়ায় মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জির আকাশে বেশ কিছু সামরিক ড্রোন উড়তে দেখা যায়। মেঘালয়ের উপ-মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশ মন্ত্রী প্রেসটোন তিনসং বলেছেন, রাজ্য পুলিশ এবং অন্য এজেন্সিগুলি নিশ্চিত ড্রোনগুলি বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর। মেঘালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের ৪৪৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। এই সীমান্তের বিস্তীর্ণ এলাকাই পাহাড়, ঘন জঙ্গল এবং নদী। সীমান্তে নজরদারি চালানো বেশ কষ্ঠসাধ্য।
ভারতের নিরাপত্তা এজেন্সিগুলি বাংলাদেশে ড্রোন নিয়ে আপাতত মুখ খুলছে না। মনে করা হচ্ছে এটা তাদের কৌশলি সিদ্ধান্ত। যদিও সীমান্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি গোয়েন্দা সংস্থা তাদের মতো করে অনুসন্ধান চালাচ্ছে এবং ড্রোনগুলি থেকে অস্ত্র বা কোনও বিপজ্জনক বস্তু ফেলা হয়েছে কিনা, তা জানতে মেঘালয়-বাংলাদেশ সীমান্তে তদন্তের জাল বিছানো হয়েছে। ভারতীয় সরকারের কাছে আগে থেকেই গোয়েন্দা তথ্য আছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তুরস্কের তৈরি বায়রাক্টার টিবি টু মডেলের ড্রোন কিনেছে। সেগুলি যুদ্ধাস্ত্র বহন এবং নিক্ষেপে সক্ষম।
সমাজমাধ্যমে কেউ কেউ এমন অকল্পনীয়, অবাস্তব সম্ভাবনার কথা প্রচার করলেও সরকারি পদাধিকারীরা তা আমলে নিচ্ছেন না। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারের পতন এবং ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকারের উপর জামায়াতে ইসলামি এবং বিএনপি-র প্রভাবের কথা বিবেচনায় রেখে ভারতীয় নিরাপত্তা এজেন্সিগুলি মেঘালয় সীমান্তে ড্রোনের রহস্য উড়ানের খুঁটিনাটি জানতে জোরদার তদন্ত চালাচ্ছে। তারা বুঝতে চাইছে, বাংলাদেশে সেনা বাহিনী ড্রোন দিয়ে ভারতে উত্তর-পূর্বের জঙ্গি সংগঠনগুলিকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে কিনা। আর সেই সেই সম্ভাবনা নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে গোয়েন্দা কর্তারা এখন তিন দশক আগের এক ভয়াবহ অস্ত্র বর্ষণের ঘটনা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছেন। নথিপত্র ঘেঁটে বের করেছেন, ‘পুরুলিয়া ফাইলস’, যার একটি অধ্যায় হল, বিএনপি জমানায় ভারতে উত্তর-পূর্বের জঙ্গি সংগঠনগুলির সঙ্গে বাংলাদেশের সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই-এর যোগ।
১৯৯৫-এর ১৮ ডিসেম্বরের সকাল। প্রায় তিন দশক আগে সেই দিনটিতে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ার ঝালদার ঘাটাঙ্গা, বেলামু, মারামু গ্রামের মানুষ আবিষ্কার করেছিলেন, চাষের খেতে ছড়িয়ে অসংখ্য অস্ত্র, যা তারা তো দূরের কথা, থানার পুলিশ, এমনকী পদস্থ কর্তারাও অনেকে চোখে দেখেননি। ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীগুলি মধ্যে তখন একে-৪৭ রাইফেল ব্যবহার করত শুধু প্রধানমন্ত্রী-সহ হাতে গোনা কয়েকজন ভিভিআইপির নিরাপত্তার নিয়োজিত স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটা গার্ডের কমান্ডোরা।
যদিও পুরুলিয়ার সেই অস্ত্রের বেশিরভাগটাই ছিল যুদ্ধাস্ত্র। মাঠ থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছিল, ২৫০০টি একে-৪৭ রাইফেল, ১৫ লাখ বুলেট, বিপুল গোলা-বারুদ, এমনকী রকেট লঞ্চার। তবে পুলিশ পৌঁছানোর আগেই গ্রামবাসীদের একাংশ বহু অস্ত্র লোপাট করে দেয়। পরবর্তীকালে পুরুলিয়া-সহ জঙ্গলমহল এবং ঝাড়খণ্ড ও বিহারের বহু রাজনৈতিক সংঘর্ষ এবং খুনের ঘটনায় ওই জাতীয় আধুনিক অস্ত্র ব্যবহারের নজির মিলেছিল।
অস্ত্র ফেলা হয়েছিল লাতভিয়ার একটি অ্যান্টো নোভ-২৬ বিমান থেকে। অস্ত্রবোঝাই বিমানটিতে যাত্রী ছিলেন সাতজন। পাইলট এবং টেকনিশিয়ান-সহ পাঁচজন ছিলেন লাতভিয় নাগরিক। অস্ত্র সংক্রান্ত অ্যাসাইনমেন্টের কাজে যুক্ত ছিল ব্রিটিশ নাগরিক পিটার ব্লিচ এবং ডেনমার্কের বাসিন্দা কিম ডেভি। ডেনমার্কের নথিপত্র অনুযায়ী অবশ্য তার নাম উয়েস নিলস ক্রিশ্চিয়ান নেলসন।
ডেভি ছাড়া বাকি ছ'জনকে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী গ্রেফতার করেছিল। ন'বছর কলকাতার আলিপুর জেলে বন্দি থাকার পর ব্লিচকে ভারত সরকার ক্ষমা করে দেয়। কলকাতার ব্রিটিশ উপদূতাবাসের সহায়তায় সে দেশে ফিরে যায়। জানা যায় সে ছিল ব্রিটিশ সেনা গোয়েন্দা সংস্থা এমআই ফাইভের সদস্য। তাই ব্রিটিশ সরকার বিশেষ আর্জি জানিয়েছিল ব্লিচকে মুক্তি দিতে। সরকারের কথায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ব্লিচকে ক্ষমা করে দেন।
পাঁচ লাতভিয় নাগরিককে আগেই মুক্তি দেওয়া হয় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অনুরোধে। অন্যদিকে, থাইল্যান্ড থেকে চেন্নাই-মুম্বই-দিল্লি-নেপাল হয়ে কিম ডেমি ডেনমার্কে ফিরে যায়। ভারত সরকার নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েও তাকে এ দেশে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারেনি। এ বছর অগস্টেও ডেনমার্কের আদালত ডেভিকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার অনুমতি দিতে ফের অস্বীকার করেছে। এ ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতে সর্বোচ্চ সাজা হিসাবে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকার বিধান। ডেভির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ রয়েছে তাতে ভারতীয় আইনে মৃত্যুদণ্ড অনিবার্য। যেমন, মুম্বই হামলার ঘটনায় একমাত্র ধৃত পাকিস্তানি জঙ্গি আফজল কাসভকে ভারত সরকার বিচার শেষে ফাঁসি দিয়েছে।
চেরাপুঞ্জিতে মেঘালয় সীমান্তে বাংলাদেশি ড্রোন উড়তে দেখে কেন ভারতীয় নিরাপত্তা এজেন্সির কর্তারা ‘পুরুলিয়া ফাইলস’ খুঁটিয়ে পড়ছেন? আসলে ২৯ বছর আগে পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামের মাঠে যে অস্ত্র বোঝাই বাক্স উদ্ধার (Purulia Arms Drop) করা হয়েছিল সেগুলির গায়ে লেখা ছিল—রাজেন্দ্রনগর, বাংলাদেশ।
রাজেন্দ্রনগর হল ঢাকার অদূরে গাজিপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি ক্যান্টনমেন্ট। কলকাতা হাই কোর্টে সিবিআই পুরুলিয়ায় ফেলা অস্ত্র কেনার জন্য বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর সার্টিফিকেটের কপি জমা করেছিল। যা বুলগেরিয়ার অস্ত্র সরবরাহকারী এজেন্টকে দেওয়া হয়েছিল। এই জাতীয় সার্টফিকেটে ক্রেতা দেশকে জানাতে হয় ওই অস্ত্র তারা নিজেদের প্রয়োজনেই শুধু ব্যবহার করবে। অন্য কোনও দেশ বা গোষ্ঠীকে তা হস্তান্তর এবং প্রতিরক্ষা ভিন্ন অপর কোনও কাজে তা ব্যবহার করা হবে না।
ওই সার্টিফিকেটে শাবির আলি ভুঁইয়া নামে বাংলাদেশের এক সেনা কর্তার সই ছিল। সিবিআই ওই নথি সংগ্রহ করেছিল পুরুলিয়ায় অস্ত্র বর্ষণকারী বিমান থেকে। ওই সেনা কর্তা ছিলেন, বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার চিফ স্টাফ। যাঁর কাজ ছিল প্রধানমন্ত্রীর অফিসের হয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা এবং প্রধানমন্ত্রীকে সেনার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া।
সিবিআই অভিযোগ করে, বাংলাদেশের বেগম খালেদা জিয়ার সরকার উত্তর-পূর্ব ভারতের জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলিকে সাহায্য করতে ওই অস্ত্র আনিয়েছিল। অসম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, ত্রিপুরা, মেঘালয়ে তখন বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির জঙ্গিপনায় অতিষ্ঠ জনজীবন। সেনা-সহ নিরাপত্তা বাহিনীগুলির সঙ্গে সংঘর্ষ লেগেই ছিল। জঙ্গিরা প্রায়ই গ্রামে ঢুকে হত্যালীলা চালিয়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিল। তখনই একে-৪৭-এর মতো আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করত জঙ্গি সংগঠনগুলি।
বেগম জিয়ার সরকার এবং সেনা কর্তা শাবির আলি ভুইঞাঁ পুরুলিয়া অস্ত্রকাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করলেও কয়েক বছরের মাথায় চট্টগ্রামে দশ ট্রাক বোঝাই অস্ত্র বাজেয়াপ্ত হওয়ার পরে ভারতীয় গোয়েন্দারা জানতে পারেন, চিনের তৈরি অস্ত্রগুলি জাহাজ বোঝাই করে পাঠিয়েছিল পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই।
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের উদ্যোগে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে অস্ত্র নামিয়ে ট্রাক বোঝাই করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল সেগুলি পার্বত্য চট্টগ্রাম দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে পাঠানো। কিন্তু পুলিশের কাছে সেনা গোয়েন্দার ষড়যন্ত্রের খবর না থাকায় তারা ট্রাকগুলি আটক করে তড়িঘড়ি কৃতিত্ব দাবি করতে সংবাদমাধ্যমকে সব জানিয়ে দেয়। খালেদা জিয়ার সরকার ও তাঁর দল বিএনপি-র সঙ্গে সেই থেকে ভারতের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি।
বাংলাদেশের এজেন্সিগুলি অবশ্য দাবি করে পুরুলিয়ার ওই অস্ত্র মায়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী কাচিন লিবারেশন আর্মির জন্য পাঠানো হয়েছিল। পাইলট ভুল করে পুরুলিয়ায় অস্ত্র ফেলেছে। আবার শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা এজেন্সিগুলি দাবি করে ওই অস্ত্র বাংলাদেশ হয়ে তাদের দেশে পাঠানো হচ্ছিল তামিল জঙ্গি সংগঠন এলটিটিই-র জন্য। তামিল অধ্যুষিত জাফনাকে মুক্ত করতে প্রভাকরণের নেতৃত্বে এলটিটিই তখন শ্রীলঙ্কার সেনা বাহিনীর সঙ্গে মরণপণ লড়াই চালাচ্ছিল।
পুরুলিয়ায় অস্ত্র বর্ষণের ঘটনার দশ দিনের মাথায় জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সিবিআইয়ের হাতে তদন্তভার তুলে দেয়। জ্যোতি বসু বলেছিলেন, এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক চক্র জড়িত এবং দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। তাই কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্সিরই তদন্ত করা উচিত।
যদিও কিম ডেভি ডেনমার্ক ও ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ওই অস্ত্র আধ্যাত্মিক সংগঠন আনন্দমার্গ এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের ইচ্ছায় আনানো হয়েছিল। রাওয়ের উদ্দেশ্য ছিল বাংলায় সিপিএমের বিরুদ্ধে আনন্দমার্গীদের দিয়ে সশস্ত্র লড়াই শুরু করানো। যাতে আইন-শৃঙ্খলার অবনতির অভিযোগে কেন্দ্রীয় সরকার বাংলায় ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে রাজ্য সরকারকে বরখাস্ত করতে পারে। সেই কারণেই আনন্দমার্গীদের সরবরাহ করতে রাতের অন্ধকারে বিমান থেকে অস্ত্র ফেলা হয়েছিল। যদিও রাতে বিমানের পাইলট ওই সংগঠনের সদর দফতর আনন্দনগরের পরিবর্তে অন্য জায়গায় অস্ত্র ফেলে। আনন্দমার্গ ওই অভিযোগ অস্বীকার করে।
রাও সরকারের পতনের উদ্দেশে সিপিএম-সহ বামদলগুলি তখন জ্যোতি বসু, হরকিষেন সিং সুরজিৎদের সামনে রেখে তৃতীয় ফ্রন্টের সরকার গড়ার তোড়জোড় করছিল। ১৯৯৬-এর ভোটে রাও সরকারের পতন ঘটে। তারপরও এই প্রশ্ন উড়িয়ে দেওয়ার নয় যে সিপিএম সরকারকে উৎখাত করতে রকেট লঞ্চারের প্রয়োজন ছিল কি না।
আনন্দমার্গ বা আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘ হল একটি আধ্যাত্মিক সংগঠন। বিহারের জামালপুরে প্রভাতরঞ্জন সরকার ওরফে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্তি ১৯৫৫ সালে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূমের গ্রামে এই সংগঠনের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির বিবাদ গোড়া থেকে। সিপিএম ওই সংগঠনের বিরুদ্ধে শিশু পাচারের অভিযোগ তোলে। দু'পক্ষের সংঘাত খুনোখুনি পর্যন্ত গড়ায়। ১৯৮২-র ৩০ এপ্রিল বিজন সেতুর ঘটনা গোটা দেশে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। বালিগঞ্জ স্টেশন লাগোয়া বিজয় সেতুর উপর আনন্দমার্গের ১৬জন সাধুকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনায় সিপিএমের দিকে আঙুল ওঠে। সাধু হত্যার বদলা নিতেই আনন্দমার্গীরা অস্ত্র আনিয়েছিল বলে প্রচার হলেও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, জ্যোতি বসুর সরকার এবং তাঁর পার্টি কখনও নরসিংহ রাওয়ের বিরুদ্ধে পুরুলিয়ার অস্ত্র কাণ্ড নিয়ে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেনি।
দিনটি ছিল, ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৯৫। লাতভিয়ার এএন-২৬ বিমানটি দুপুরে করাচি থেকে উড়ে সন্ধ্যায় বারাণসীর বাবদপুর বিমানবন্দরে অবতরণ করে। সেখানে তেল ভরে বেশি রাতে ওড়ে বিমানটি। গয়ার কাছে মুখ ঘুরিয়ে সেটি পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ার উপর পৌঁছয় ভোর রাতে। সেখানে অস্ত্র ফেলে বিমানটি দমদম বিমানবন্দরে এসে তেল ভরে চলে যায় থাইল্যান্ডের ফুকেটে। যদিও তদন্তে জানা যায়, বিমানটির মায়ানমারের তৎকালীন রাজধানী ইয়াঙ্গনে যাওয়ার কথা ছিল। একদিন থাইল্যান্ডে থাকার পর ১৯ ডিসেম্বর সেটি চেন্নাইয়ে নেমে তেল নিয়ে করাচির উদ্দেশে রওনা হয়। বিমানটি আকাশে থাকাকালে ভারতের নিরাপত্তা এজেন্সিগুলির কাছে খবর আসে সেটি থেকেই পুরুলিয়ায় অস্ত্র বর্ষণ করা হয়। গুজরাত থেকে ভারতীয় বায়ু সেনার দুটি মিগ-২০ বিমান কিম ডেভি, পিটার ব্লিচদের বিমানটি ধাওয়া করে সেটিকে মুম্বই বিমান বন্দরে নামতে বাধ্য করে।
এর পরে মুম্বই বিমানবন্দরের ঘটনাবলি রহস্যে ঘেরা। জানা যায়, লাতভিয়ার বিমানটিকে গোড়ায় কোনও ভারতীয় এজেন্সি তল্লাশির উদ্যোগ নেয়নি। মনে করা হয়, উপর মহল থেকে তেমনই নির্দেশ ছিল। বিমানবন্দরের ম্যানেজারও বিমানটির থেকে ল্যান্ডিং মানি নিয়ে সেটিকে ওড়ার অনুমতি দিতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এই ফাঁকে কিম ডেমি মুম্বই বিমানবন্দর থেকে পালায়। পুলিশ পিটার ব্লিচ ও পাঁচ লাতভিয় নাগরিককে গ্রেফতার করে।
নিজের দেশ ডেনমার্কে ফিরে গিয়ে ডেভি একাধিক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, মুম্বই বিমানবন্দরের বাইরে তাঁর জন্য এক এমপি-র ঠিক করে দেওয়া গাড়ি অপেক্ষা করছিল। সেটিতে চেপে সে প্রথমে পুণে চলে যায়। পরদিন সেখান থেকে ট্রেনে দিল্লি। সেই ব্যবস্থাও করে দেন ওইএমপি। দিল্লিতে গিয়ে এমপি-র সরকারি বাসভবনে গিয়ে ওঠেন। পরদিন দিল্লিতে থেকে কিছুটা ট্রেনে, বাকি পথ গাড়িতে করে নেপাল পৌঁছে যান। নেপাল সীমান্ত পর্যন্ত তাঁর সঙ্গী ছিল স্টেনগানধারী চার সরকারি নিরাপত্তারক্ষী।
কাঠমাণ্ডু থেকে ডেভি ফিরে যান নিজের দেশ ডেনমার্কে। ডেভির দাবি, সেই এমপি হলেন বিহারের পূর্ণিয়ার তৎকালীন সাংসদ পাপ্পু যাদব, যিনি আনন্দমার্গের সদস্য। পাপ্পু অবশ্য বারেবারেই ডেভির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ডেভির দাবি, প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের ব্যবস্থাপনায় পাপ্পু যাদব পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম সরকারকে উৎখাত করার জন্য আনন্দমার্গীদের জন্য ওই অস্ত্র সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিল। অস্ত্রের টাকা কে বা কোন সংস্থা দিয়েছিল সে রহস্য সিবিআই উদ্ঘাটন করতে পারেনি, অনেকের মতে করেনি। সরকারের তেমনই নির্দেশ ছিল।
আলিপুর জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার আগে পিটার ব্লিচ একাধিকবার দাবি করেন, কিম ডেভির অস্ত্র কারবারে যুক্ত থাকলেও সে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৫-কে গোটা অপারেশনের কথা আগাম জানিয়েছিল। পুরুলিয়ায় অস্ত্র ফেলার আগেই ব্রিটিশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ভারত সরকারকে জানিয়েছিল ডেভির অভিযানের কথা। তদন্তে জানা যায়, ব্রিটেনের সতর্কবার্তাকে আমল দেয়নি ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। সম্ভাব্য অস্ত্র অভিযানের কথা জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সতর্ক করতে সাধারণ ডাকে চিঠি পাঠায়। দুই রাজ্য সরকারই ১৭ ডিসেম্বরের পরে সেই চিঠি হাতে পায়।
আরও একটি বিষয় রহস্যে ঘেরা। লাতভিয়ার বিমানটি করাচি থেকে উড়ে ভারতের দীর্ঘপথ পরিক্রমা করলেও দেশের সামরিক-বেসামরিক কোনও র্যাডারে সেটির গতিবিধি ধরা পড়েনি। ভারতের আকাশ সীমায় একটি বিদেশি বিমানের অবাধে উড়তে পারার ঘটনা জানাজানি হতে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। সেই প্রশ্নেরও জবাব মেলেনি। মাঝ আকাশে দু’বার বিমানটি যাত্রা পথ বদল করে। সঙ্গে সঙ্গে তা র্যাডারে ধরা পড়ার কথা ছিল। তদন্তে জানা যায় যাত্রাপথে একটি সামরিক বিমান ঘাঁটির র্যাডার সেদিনই বন্ধ ছিল।