শেষ আপডেট: 24 November 2023 11:50
সম্প্রতি ভারতের রাজনৈতিক পরিসরে এমন কিছু শব্দ জাঁকিয়ে বসেছে যা গত শতকের সাত বা আটের দশকে প্রায় কল্পনার অতীত ছিল। যেমন দেবদেবীর জন্মস্থান-কর্মস্থান, মন্দির-মসজিদ, গরু-হনুমান ইত্যাদি। এই শব্দগুলো শুধুমাত্র আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ নেই, রাজনৈতিক পালাবদলে রীতিমত নির্নায়ক শক্তি হয়ে উঠেছে। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে এই গোত্রের শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। গত দুদিন আগেই এই বিভাগে আরও একটি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটল। কারণ, বিশ্বকাপ ক্রিকেট ফাইনালে ভারতের পরাজয়। ‘কজ অ্যান্ড এফেক্ট’-এর এমন উদাহরণ যে কোনও দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেই বিরল।
ভাষার চলমানতার সূত্রেই কিছু শব্দ হারিয়ে যায়, কিছু নতুন শব্দের নির্মাণ ঘটে এবং কিছু শব্দের পুনরুত্থান ঘটে। যেমন গো-মূত্র শব্দটি সচরাচর কোনও বঙ্গভাষী ব্যবহার করতেন না, ওটা ছিল পুরোহিতের ভাষা। যদিও বিষয়টি অপরিচিত ছিল না মোটেও কিন্তু দৈনন্দিন আলাপচারিতায় ওই শব্দের কোনও জায়গা ছিল না। কিন্তু কোভিডকালে বস্তুটির চমৎকারিত্ব প্রমাণ করার একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা শব্দটিকে একেবারে হেঁশেলে প্রবেশ করিয়ে দিল। এভাবেই শব্দটির পুনর্জন্ম ঘটল। ঠিক একই পদ্ধতিতে না হলেও ‘অপয়া’ শব্দটি এবার চলে এল রাজনৈতিক ডিসকোর্সে।
একটু নজর করলেই বোঝা যায়, যে কোনও শব্দের পুনরুত্থানই একই ধরনের অভিঘাত তৈরি করে না। সেই শব্দগুলোই প্রবল পরাক্রমী হয়ে ওঠে যাদের ভিত থাকে মানুষের মনের গভীরে। যে শব্দগুলোকে বা বলা ভালো সেই শব্দের ভাবটিকে আমরা লালন করি সচেতন বা অচেতনভাবে। অনেক সময়ই সামাজিক কারণে, পারিপার্শ্বিক চাপে, নিজের ভাবমূর্তি বজায় রাখতে সচরাচর হয়তো শব্দটির ব্যবহার এড়িয়ে চলি, কিন্তু আমাদের চেতনায় তার স্পষ্ট ছাপ থেকে যায়। সময় সুযোগ পেলেই সেই শব্দটি তার সম্পূর্ণ অবয়ব নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। ‘অপয়া’ তেমনই একটি শব্দ।
বিশ শতকের ছয়-সাত এমনকী আটের দশকে কলকাতা বা মফস্সলের যাপনচিত্রে ‘অপয়া’ ছিল একটি অতি বাস্তব অস্তিত্ব। লিঙ্গ-ধর্ম-জাতি নির্বিশেষে অপয়ারা থাকতেন প্রায় প্রতিটি পাড়ায়-গ্রামে। ‘মিথ’ যেভাবে নির্মিত হয়, এই অপয়াদের খ্যাতি বা অখ্যাতি সেভাবেই গড়ে উঠত। সাধারণত কোনও শুভকাজে যাত্রার সময় এই মানুষদের মুখ দেখা ছিল একশ শতাংশ ব্যর্থতার নিশ্চয়তা। বিবিধ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এবং গণভোটে তাঁদের মধ্যে কেউ হয়ে উঠতেন সময়ভিত্তিক অপয়া, অর্থাৎ সকালে প্রথমে যার মুখ দেখলে দিন খারাপ যেত, কারও জন্য বরাদ্দ ছিল সারাটা দিন, কেউ ছিলেন বারবেলার অপয়া। তবে এই ‘কনফার্মড’ অপয়াদের কদরও ছিল একটু অন্যভাবে। প্রতিবেশী বা আত্মীয়ের সাফল্য দেখে যাঁরা লুচির মতো ফুলতেন, তাঁদের গাত্রদাহ প্রশমনে অনেকসময়ই ‘গ্যারান্টিড’ অপয়াদের নিয়োগ করা হত। এক্ষেত্রে তাঁদের কাজ ছিল ঈর্ষা উদ্রেককারী ব্যক্তিকে কোনও শুভকাজে যাওয়ার সময় একবারটি নিজের মুখ দেখিয়ে দেওয়া।
এই অপয়াদের ব্যক্তি জীবনের বিপন্নতা, তাঁদের পারিবারিক জীবন কেমন হতো সেটা খুব স্পষ্ট নয়, কিন্তু তাঁদের মধ্যে কেউ হয়তো গোটা বিষয়টিকে বেশ উপভোগই করতেন। ‘পাতালঘর’ সিনেমার মনু মুখোপাধ্যায়ের অনবদ্য লিপে সেই অসাধারণ গানটি আজও অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। ‘তুমি কাশী যেতে পারো যেতে পারো গয়া, পাবে না এমন দ্বিতীয় অপয়া।‘ দেবতার জন্মের মতই এই অপয়ারাও উদ্ভাবিত হন। কখনও তার উপলক্ষ্য হয় কাক তার বর্জ্য পদার্থ মাথায় ফেলে, কখনও অতিযোগ্য পুত্রের পিতা সম্ভাব্য পাত্রীকে নাকচ করায়, কখনও কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব খেলার মাঠে প্রবেশ করে।
বস্তুত বেঁচে থাকার জন্য, আমাদের ব্যর্থতাকে যুক্তিগ্রাহ্য করার জন্য, কাউকে অপাঙতেয় করার জন্য আমাদের একটি অপয়াকে খুঁজে নিতেই হয়।