শেষ আপডেট: 24th November 2023 11:52
অপয়া অর্থাৎ যা পয়মন্ত নয়। শুভচিহ্নের অভাব খুঁজে বাংলা শব্দ ভাণ্ডারের এই শব্দটি দিয়ে ব্যক্তিবিশেষকে চিহ্নিত করার ধারা নতুন নয়। তবে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ক্রিকেট বিশ্বকাপের পরে নতুন করে ধূমকেতুর গতিতে যেন আছড়ে পড়েছে এই ‘অপয়া’ শব্দটি। এবং তার অভিঘাত এতটাই যে সমাজ-সংসারের সীমাবদ্ধ ক্ষেত্র পেরিয়ে তা ঝড় তুলেছে জাতীয় রাজনীতির বৃহত্তর প্রেক্ষাপটেও। শব্দটি নিয়ে নতুন করে নাড়াচাড়াও সেই পরিসরেই। দেশ-কালের সীমানা অতিক্রম করে সাহিত্যই ধরে রাখে জীবনের ইতিহাস। বাংলা সাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয়। সেখানেই এবার অপয়ার খোঁজ!
“সকালে অফিসের পথে এর মুখ দেখলে নির্ঘাত ট্রেন ফেল বা বসের ঝাড়! একটা শুভকাজে যাচ্ছি, ঠিক এসময়েই ওকে এ পথে ঘুরঘুর করতে হল- অপয়া একটা”- ৪০ বা ৫০ বছর আগেও এভাবে ভাবা হত। পাড়ায় পাড়ায় ছিলেন ‘অপয়া’ হিসেবে চিহ্নিত অনেকেই। তাঁদের নিয়ে মুখে মুখে ছড়াত শুধুমাত্র মুখ দেখিয়ে পাকা ধানে মই দেওয়ার অনেক গল্প। কিন্তু এখন হয়তো আর এভাবে ভাবা হয় না। অন্তত শহুরে জীবনে। অনেক ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র কৌতুকে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে এই শব্দের উপস্থিতি। এই যেমন ‘লুডুতে হলুদ গুটি নেব না কিছুতেই। ওটা আমার অপয়া।’ বা ‘খেলা দেখতে ওর পাশে বসলেই হারব।’ আর ঘটমান বর্তমানই যেহেতু উঠে আসে সাহিত্যে, তাই সেখানেও আর বিশেষ নজরে আসে না অপয়া শব্দটা।
অথচ গত একশো বছরের বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার খুঁজে দেখলে অপয়া শব্দের দেখা মিলবে বারবার। এবং সমাজ-সংসারে যেহেতু মেয়েরাই বারবার অপয়া হয়েছে, ছাপার অক্ষরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রবীন্দ্র ও শরৎ সাহিত্যে সমাজের যে ছবি ধরা পড়েছে সেখানেও দেখা মিলেছে ‘অপয়া’ হিসেবে দেগে দেওয়া অভাগিনীদের। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলিতে ধরা রয়েছে একটা বিস্তীর্ণ সময়কালের ছবি। যার অনেকটা কালোত্তীর্ণ। শরৎচন্দ্রের আঁকা পল্লীসমাজও পুরোপুরি ব্রাত্য হয়নি আজ। তবুও নতুন প্রজন্ম কিন্তু আর সেভাবে চিহ্নিত করতে পারে না ‘অপয়া’ শব্দটিকে। হয়তো আধুনিক শিক্ষা আর বিজ্ঞানমনস্কতার মিশেলে ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে অনেক। সাহিত্যেও তারই প্রতিফলন ঘটেছে।
লেখক অরিন্দম বসু মনে করেন, এই পরিবর্তনটা এসেছে গত ৪০-৫০ বছরেই। আশাপূর্ণাদেবীর পরবর্তী সময়ের লেখকদের সৃষ্টিতে অপয়ার মতো শব্দগুলিকে আর সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না। অরিন্দমের কথায়, “অপয়া শব্দটা আসলে একেবারেই সাংসারিক একটা শব্দ। এবং বেশিরভাগে ক্ষেত্রেই মহিলাদের ঘিরেই যেন এর ডালপালা বিস্তার। মেয়েরা অপয়া হত। ছেলেরা নয়। আমি তো মনেই করতে পারছি না সাহিত্যে কোনও ছেলেকে অপয়া হিসেবে দেগে দেওয়া হয়েছে। এখন অবশ্য কৌতুক হিসেবে সাহিত্যে আসে অপয়া শব্দটা। তার বেশি নয়।”
সহমত বর্তমানের আরেক লেখক শমীক ঘোষ। শমিকের কথায়, “একেবারে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এই শব্দগুলি নেই। যেটুকু ব্যবহার হয়েছে তা শীর্ষেন্দুবাবু (মুখোপাধ্যায়) করেছেন, তাও একেবারে কৌতুক অর্থে। আমরা যাঁরা এখন লেখালেখি করি তারা জানি আজকের প্রেক্ষিতে কাউকে পয়া-অপয়া বলাটা খুব ভাল নয়। আমরা যারা বাংলা ভাষায় লেখালেখি করছি তাদের কাছে এই শব্দগুলির গ্রহণযোগ্যতা নেই বললেই চলে। আবার এটাও ঠিক কুসংস্কারতো পুরোপুরি যায়নি, কিন্তু আমরা বাঙালিরা এই বিষয়গুলিকে একটু ক্লোজেটে রাখতে ভালবাসি। তাই প্রকাশ্যে ব্যবহার করি না। আর সমাজতো বদলাচ্ছে। তাই অপয়ার মতো শব্দগুলি যে সাহিত্যে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, সেটাই তো স্বাভাবিক।”
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘নেই’ গল্পটার কথা মনে পড়ে। ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে এক চড়া এক কেরানীর স্বগতোক্তি, “চাকরি যায়নি অথচ ছুটি পাওয়া গেল। বছরটাই পয়া। শুরু হতে হতেই বড় বড় সব লোক পটাপট মরছে। ঘন ঘন হাফ ডে।” বড় বড় লোকেদের মৃত্যুর জন্য আমজনতার কাছে একটা বছরই কেমন পয়া হয়ে যায়। এও তো সাহিত্যে উঠে আসা জীবনেরই ছবি। সেখানে ব্যক্তি মানুষের ক্ষুদ্র আবর্ত থেকে পয়া-অপয়ার ধারণা চিরকালীন সময়কে ছুঁয়ে ফেলে। আধুনিক-যুক্তিবাদী মনের এই বিকাশটাই বোধহয় পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়া একমাত্র স্বস্তি।