Date : 15th May, 2025 | Call 1800 452 567 | [email protected]
Indian Army: পাকিস্তানে 'অপারেশন সিঁদুর'-এর পর বাংলাদেশের নাকের ডগায় ভারতীয় সেনার মহড়া 'তিস্তা প্রহার'SSC: কসবার স্মৃতি ফিরল বিকাশ ভবনে, চাকরি ফেরত চাওয়ায় শিক্ষক পেটালো পুলিশ, ঝরল রক্তসৌরভ, সানা, নাচ,সংসার নিয়ে মন খুলে আড্ডায় ডোনাউকিল বর্মন জানালেন বাংলাদেশের জেলে অনেকেই তাঁকে দেখতে ভিড় করতবাঙালির কাছে তিনি মহানায়ক, তবে স্কুলেও পড়াতেন উত্তম কুমার, কোন বিষয় জানেন?ভারতের তরফে 'শুল্ক মকুবের প্রস্তাব': ট্রাম্পের দাবি মানলেন না জয়শঙ্কর, জানালেন, 'আলোচনা চলছে'SSC: সাইরেন বাজিয়ে চাকরিহারা শিক্ষকদের ওপর পুলিশি লার্ঠিচার্জের অভিযোগ! রণক্ষেত্র বিকাশভবনসমস্ত বিতর্ক ভুলে অপূর্বার সঙ্গে দেখা করলেন সময়, ভাইরাল একান্তে কাটানো মুহূর্ত, ডেট করছেন নাকি?জলের পদ্ম মাটিতে ফুটিয়ে চমকে দিলেন রেজিগরের নিজামুদ্দিন শেখপরিচালক স্বামীর কাঁধে মাথা অভিনেত্রী সামান্থার, চলছে প্রেম গুঞ্জন, স্ত্রী শ্যামালি লিখলেন...
The Story of Manik Bandyopadhyay

একটি বাজি বদলে দিল জীবন, বিজ্ঞান ছেড়ে সাহিত্যে নিজেকে ‘উৎসর্গ’ করলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

জীবনের অন্ত্যপর্বে, বাংলার সাহিত্যভূমিতে তার জয়ধ্বজা যখন পতপত করে উড়ছে, তখনও দৃঢ় প্রত্যয়ে ঘোষণা করেছিল, ‘কেরানির বেশি খেটে লিখতে না শিখে জগতে আজ পর্যন্ত একটি ছোটখাট লেখকও লেখক হতে পারেনি।… সাহিত্য সাধনার জিনিস।’

একটি বাজি বদলে দিল জীবন, বিজ্ঞান ছেড়ে সাহিত্যে নিজেকে ‘উৎসর্গ’ করলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: 6 May 2025 07:51

রূপক মিশ্র 

বিজ্ঞানের ছাত্র তিনি। আরও স্পষ্টভাবে বললে: গণিতশাস্ত্রের। জটিল ফর্মুলা আর পরীক্ষানিরীক্ষায় মশগুল মন। পদার্থবিদ্যা আর রসায়ন—বিজ্ঞানের এই দুই ধারা—’ছ্যাবলামি, ন্যাকামি, ভাবপ্রবণতা’র তিলার্ধ নেই যেখানে, তাদের ‘অভিনব কাব্য’ বলে মনে করেন।

তাই বলে সাহিত্য দুয়োরানি? মোটেও নয়। বারো-তেরো বছর বয়স থেকেই লুকিয়ে-চুরিয়ে নভেল পড়ার নেশা। শেষ করে ফেলেছেন ‘গোরা’, ‘বিষবৃক্ষে’র মতো উপন্যাস। তবু গ্রন্থপাঠ স্রেফ হাল্কা বিনোদন আর সস্তা ভাবালুতা জাগায় না। এক একটি বই শেষ করেন। আর তার নির্যাস যতক্ষণ পর্যন্ত না শরীরের অস্থি-মজ্জা-রক্ত-স্নায়ু বেয়ে মনের অতলে সেঁধিয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণ অস্থির হয়ে থাকেন। শান্ত হন না কিছুতেই। ঘুরে বেড়ান, ছুটে চলেন মাঠ-প্রান্তর-নদীতীর। আর খুঁজে চলেন একটাই উত্তর: ‘কেন?’

স্কুল, কলেজ পেরিয়ে বাকি জীবনেও এই একটিমাত্র মানসিক রোগ, সবকিছুর ভেতরে ‘কেন’-র উত্তর খোঁজার বাসনা তাড়া করে বেরিয়েছে প্রবোধকে। প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। ডাকনাম মানিক। আরও কাছের যারা, ডাকে ‘কালো মানিক’ নামে।

বাবা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারি চাকুরে। বদলির চাকরি। তাই সদর-মফঃস্বল মিলিয়ে খান দশেক স্কুল আর তিনটি কলেজে পড়াশোনা করতে হয়েছে। অবশেষে থিতু হয়েছেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। অঙ্কে অনার্স। ফর্মুলা আর ক্যালকুলেশনের নেশা পেয়ে বসেছে।

বড়দা ডঃ সুধাংশুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। পুণায় থাকেন। কৃতবিদ্য। তদুপরি পদস্থ আধিকারিক।  পেশায় মেটিওরলজিস্ট। প্রমোশন পেয়ে ভারত, ব্রহ্মদেশ ও সিংহলের আবহাওয়া বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল হন। তাঁর আগে কোনও বাঙালি এই পদ অর্জন করেননি।

সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। প্রেসিডেন্সি থেকে অঙ্কে স্নাতক ডিগ্রিটুকু অর্জন করলেই মেধাবী ছাত্র প্রবোধের পক্ষে সম্মানের চাকরি আর আর্থিকভাবে স্বচ্ছল জীবন বেছে নেওয়াটা অসম্ভব কিছু ছিল না।

কিন্তু জীবনদেবতা তাঁর জন্য বেঁধে দেন অন্য পথ, ভিন্ন গন্তব্য। বন্ধুদের সঙ্গে একটিমাত্র আড্ডা। একটিমাত্র বাজি৷ আর তাতেই বদলে গেল প্রবোধের জীবন। দুয়োরানি হয়ে উঠল সুয়োরানি। ল্যাবরেটরির মাপজোক আর ক্লাসে বসে চুলচেরা গাণিতিক বিশ্লেষণ গেল উড়ে। যে সাহিত্য পড়ে একদা রোমাঞ্চিত, শিহরিত হয়ে উঠত সে, খুঁজে চলত ‘কেন'-র উত্তর, তার জবাব দিতে, সমাজের মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষদের মুখে ভাষা জোগাতে হাতে তুলে নিল কলম। অথচ সেই খাতবদলই শেষমেশ জীবনের ‘নিয়তি’ হয়ে দেখা দিল।

বিনোদনের জন্য সাহিত্য পড়েনি সে, বিনোদনের জন্য লেখেনি। লেখককে ‘কলম-পেষা মজুরে’র অতিরিক্ত কিছু ভাবেনি প্রবোধ। প্রতিভা নিয়ে জন্মানোর ধারণাকে করেছিল নস্যাৎ। প্রাণপাত পরিশ্রমই ছিল মূলমন্ত্র। জীবনের অন্ত্যপর্বে, বাংলার সাহিত্যভূমিতে তার জয়ধ্বজা যখন পতপত করে উড়ছে, তখনও দৃঢ় প্রত্যয়ে ঘোষণা করেছিল, ‘কেরানির বেশি খেটে লিখতে না শিখে জগতে আজ পর্যন্ত একটি ছোটখাট লেখকও লেখক হতে পারেনি।… সাহিত্য সাধনার জিনিস।’

অথচ নিয়তি… সেই নিয়তিরই কি অদ্ভুত মায়াখেলা! সাহিত্যসাধনার চরম মূল্যই একদিন তাকে চোকাতে হল। সংসারে মনোমালিন্য, বিচ্ছেদ, অর্ধাহার, শরীরের প্রতিশোধ, আবাল্য ব্যাধির ফিরে ফিরে আসা এবং অপরিসীম দারিদ্র‍্যের মধ্যে মৃত্যুবরণ৷ বন্ধুদের সঙ্গে ধরা একটি বাজি নিয়তির বেশে সৃষ্টিপ্রাচুর্যে ভরা একটি জীবনকে দগ্ধে ছাই করে দিল!

কী ছিল সেই বিতর্ক, সেই চ্যালেঞ্জ, যার জন্য একটা আস্ত জীবন আচমকা এলোমেলো হয়ে গেল?

প্রেসিডেন্সির ক্যান্টিনে বসে হাল্কা চালেই শুরু হয়েছিল আড্ডা। একথা-সে কথার মধ্যে উঠেছিল সাহিত্যের প্রসঙ্গ। ততদিনে 'কল্লোল যুগ' শুরু হয়ে গিয়েছে। ‘কল্লোল’, ‘কালি কলম’, ‘প্রবাসী’, ‘বিচিত্রা’র মতো পত্রিকা বাংলা সাহিত্যে তথাকথিত আধুনিকতা ও রবীন্দ্র-বলয় কেটে বেরিয়ে আসার অভিমুখ খুঁজছে। দানা বাঁধছে বিতর্ক৷ উঠে আসছে নতুন মুখ। তাঁদের তুলে ধরছেন, ‘প্রমোট’ করছেন একদল সম্পাদক।

কিন্তু নয়া লেখকদের অভ্যুত্থান এত সহজ নয়। বাংলার সাহিত্যক্ষেত্র বড্ড পিচ্ছিল, দুর্গম। দলাদলি পাঁক আর পক্ষপাতের কাঁটায় আকীর্ণ। চাইলেই কেউ নাম লেখাতে পারে না। পরিশ্রমই সবটুকু নয়। চলতি হাওয়ার পন্থীও হওয়া চাই। তাই নামকরা লেখক ছাড়া ওরা কাউকে পাত্তাও দেয় না।—আওয়াজটা তুলেছিল আড্ডাচক্রের কেউ। লুফে নিয়েছিল আর সকলে। সহমত জানিয়ে টেবিল চাপড়েছিল।

সুরে সুর মেলায়নি প্রবোধ। ওই যে… ‘কেন'-র রোগে আক্রান্ত সে, সেই ছোটবেলা থেকে। প্রতিষ্ঠিত আপ্তবাক্য, সরব ঘোষণা কোনওকিছুই বিনা বিচারে মেনে নিতে নারাজ। তাই ভুঁরু কুঁচকে প্রশ্ন তুলেছিল: ‘ভাল লেখাও ফিরিয়ে দেয় কেউ? দিতে পারে? শুধু নামটাই কি সব? সম্পাদকরা কি পাগল যে সুলিখিত গল্প ফিরয়ে দেবে?’

পাল্টা প্রশ্ন ভেসে এল: ‘তুমি কী করে জানলে?’

ব্যাস! এই একটি সওয়াল প্রবোধকে সমস্যায় ফেলে দিল। সত্যিই তো! যারা সম্পাদকদের ঔদাসিন্য ও পক্ষপাত নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, তারা ভুক্তভোগী। গল্প লিখেছে। পত্রিকা দফতরে পাঠিয়েছে। একবার, দু'বার… বহুবার। প্রতিবার লেখা অমনোনীত হয়ে ফিরে এসেছে! আর সে নিজে, জীবনে একটিও গল্প না লিখে, না পাঠিয়ে কী করে স্রেফ ধারণা আর অনুমানের জোরে এত বড় কথা বলতে পারে? তার জন্য তো প্রমাণও জরুরি!

প্রবোধ সেদিন, সেই মুহূর্তে ‘আমি জানি’ বলে ঠেকা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল বটে। কিন্তু বন্ধুরা ছেঁকে ধরে। তারপর কথার পিঠে কথা জমতে জমতে উঠে আসে বাজি। তিন মাস সময়৷ পাক্কা নব্বই দিন৷ এর মধ্যে যে কোনও মাসিকপত্রে গল্প প্রকাশিত হতে হবে। ছেপে বেরোলে ভাল। প্রবোধের কথাই ঠিক। নতুবা…

যে সময়কার কথা বলছি, তখন প্রবোধের বয়স মোটে বাইশ বছর। আগে একটিও  গল্প লেখেনি সে। কিন্তু পড়েছে অজস্র। তাই মোটের উপর সম্পাদক-ভোলানো কাহিনি দাঁড়াবে, এ বিষয়ে নি:সংশয় ছিল। কিন্তু প্লট কী? চরিত্র কারা? এই নিয়ে দুশ্চিন্তা দানা বাঁধে৷

অনেক ভাবনার পর ঠিক করে প্রেমের গল্প ফাঁদবে। কিন্তু কেমন প্রেম? মাসিকপত্রের পাতায় স্তূপাকৃত, ফেনিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলা অবাস্তব ভালবাসার কথা? নাকি চোখে-দেখা কোনও অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেবে?

নিজের জীবনে সেভাবে প্রেমের পদসঞ্চার হয়নি। কিন্তু অদ্ভুত, আশ্চর্য এক ভালবাসাকে পাপড়ি মেলতে দেখেছিল প্রবোধ। অথচ ফুল হয়ে ওঠার আগেই অকালে ঝরে যায়। পূর্ববঙ্গে থাকাকালীন এক ক্ল্যারিনয়েট বাদককে চিনতে সে। চিনত তাঁর স্ত্রীকেও। সেই বাঁশি-বাজিয়ে ছিল ভীষণই জেদি, খাপছাড়া স্বভাবের মানুষ। লোকে তোয়াজ করে অনুষ্ঠানে নিয়ে যেত। ইচ্ছে হলে, মেজাজ ঠিক থাকলে হাতে তুলে নিত বাদ্যযন্ত্র। নয়তো না বাজিয়ে ফিরে আসত।  

আবার এই মানুষটাই বাড়িতে স্ত্রীর কাছে বিলকুল অন্য রকম। যাবতীয় বাসনা, ভালবাসা ঢেলে বাঁশি শোনাত। যেন তিনিই জীবনের একমাত্র শ্রোতা! বেশি বাজালে গলা দিয়ে রক্ত ঝরত। তবু থামত না কিছুতেই।

এই মূল বিষয়কে কেন্দ্র করে থোড়-বড়ি-খাড়া রোম্যান্টিক গল্প নয়, ট্র‍্যাজিক প্রেমের আখ্যান বুনল প্রবোধ। নাম দিল ‘অতসীমামী’। আর খামে বন্দি গল্প রেখে এল প্রবাসীর দফতরে। রচনার তলায়, লেখকের নাম স্বাক্ষরের জায়গায় স্বনাম নয়, সই করল ছদ্মনামে। প্রবোধের বদলে লেখা রইল ‘শ্রীমানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’। আর এই একটি নাম কালান্তরে গল্পের পাণ্ডুলিপি ছাড়িয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিল।

প্র‍থম গল্প লিখে পৃথিবীর সমস্ত লেখক কিছুটা হলেও কুণ্ঠিত, একটু জড়সড় হয়ে থাকেন। ব্যতিক্রম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। বাজি রাখার সময় থেকেই তাঁর বিশ্বাস ছিল, তিনি পারবেন। লিখে কতটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন সেই খতিয়ান কোথাও লিখে যাননি বটে। কিন্তু তার সাক্ষ্য পেশ করেছেন আরেক সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। সেই সময় তিনি ‘বিচিত্রা’য় কাজ করতেন। মানিকের সঙ্গে প্রথম মোলাকাতের কথা বলে গেছেন ‘কল্লোল যুগ’ গ্রন্থে। লিখেছেন, ‘একদিন বিচিত্রার দফতরে কালোপানা একটি লম্বা ছেলে এল। বলল গল্প এনেছি। বললাম, দিয়ে যান। সেই ছেলে লম্বা হাত বাড়িয়ে গল্পের পাণ্ডুলিপি দিয়ে বলল, এই যে রাখুন। এমন ভাব যেন এখুনি ছাপতে দিয়ে দিলে ভাল হয়। চোখে মুখে আত্মবিশ্বাস চুঁইয়ে পড়ছে। গল্প জমা দিয়ে সে চলে গেল। আমি তারপর এমনিই গল্পে একবার চোখ বোলাতে গিয়ে চমকে উঠলাম। এ যে রীতিমতো দুর্দান্ত গল্প!’

কতটা ‘দুর্দান্ত’ তার প্রমাণ মানিক, তাঁর বন্ধুমহল আর বাংলার তামাম পাঠক টের পেল মাসের শেষে। মাসের মাঝামাঝি সময়ে দিয়ে আসা গল্প মনোনীত হলেও সাধারণত ঠিক পরের সংখ্যায় ছাপা হয় না। কিন্তু বিচিত্রা সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের তর সয়নি। গল্প তো বেরলোই। উপরন্তু সাম্মানিক বাবদ কুড়িটি টাকা হাতে নিয়ে মানিকের বাসায় উপস্থিত হলেন তিনি। সস্নেহে জানালেন পরিচয়। জানালেন গল্প প্রকাশের কথা। আর রাখলেন বিশেষ দাবি: একটি গল্পই যথেষ্ট নয়। পরের সংখ্যায় আবার লেখা দিতে হবে!

চলনসই গল্প লিখলেও সম্পাদকরা ফেরান না—অনুমান আর যুক্তির টানেই বলেছিলেন মানিক। এই একটি কথা এত প্রবলভাবে সত্যি হয়ে ধরা দেবে, আন্দাজ ছিল কি?

অথচ একটিমাত্র গল্পই বদলে দিল জীবন। প্রেসিডেন্সির পড়াশোনার পাট গুটিয়ে ফেললেন। আর নেশার টানে লিখে গেলেন একের পর এক গল্প!

অঙ্কে অনার্স মুলতবি রেখে মানিক কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই সাহিত্যের ময়দানে নেমে পড়েন। ইচ্ছে ছিল তিরিশের চৌকাঠ না পেরোলে কলম তুলবেন না। কিন্তু প্রথম গল্প প্রকাশের মোহে ততদিনে সেই পণ ভুলেছেন। মানিকের আকস্মিক পরিবর্তন দেখে বন্ধুমহলে শোরগোল। পরিবারেও অসন্তোষ। বৈজ্ঞানিক দাদার চিঠিতে কৈফিয়ত তলব—কেন এই অধঃপতন? ঠিক কী কারণে পর পর দু-বার পরীক্ষায় ফেল?

জবাবে মানিক জানান—পাঠ্যপুস্তক পড়ার সময় নেই। তার বদলে সারা বছর পড়েন রাশীকৃত বিদেশি লেখকের লেখা গল্প ও উপন্যাস। চিঠির শেষে সদর্প ঘোষণা— 'গল্প উপন্যাস লেখা ও পড়া আমি ছাড়তে পারব না। কাজেই কলেজের পড়াই আমায় ছাড়তে হবে। তবে আপনি দেখে নেবেন, কালে এই লেখার মাধ্যমেই আমি বাংলার লেখকদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে স্থান করে নেব। রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের সমপর্যায়ে আমারও নাম ঘোষিত হবে।' কথাগুলো যখন বলছেন, তখন মানিকের বয়স মোটে বাইশ বছর!

মধ্যবিত্ত পরিবারে সদ্যযুবকের সাহিত্যরচনায় আশকারা দেওয়ার চল সেদিনও ছিল না, আজও নেই৷ এর জেরেই মানিকের দাদা সুধাংশুকুমার ভাইয়ের সঙ্গে এক প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ক্রমশ পরিবারের বাকিরাও মুখ ফিরিয়ে নেন। এই সমবেত, চরম ঔদাসিন্য মা-হারা ছেলের বুকে সেদিন প্রবলভাবে বিঁধেছিল। বাবা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় যদিও মানিককে স্নেহ করতেন। সাহিত্য রচনাতেও উৎসাহ জোগাতেন। কিন্তু ততদিনে তিনি সরকারি কাজে অবসর নিয়েছেন। যৌথ পরিবার সামলানোর দায়ও অনেক। ফলে আর্থিক সংকট উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে।

এই সংকট কোনওদিন কাটিয়ে উঠতে পারেননি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। অর্ধাহারে জীবন কাটাতে হয়। শরীরও তোলে শোধ। আযৌবন মৃগীতে ভুগেছেন। ধীরে ধীরে সেই উপক্রম বাড়তে থাকে। নিজের অজান্তে আচমকা ফিটগ্রস্ত হন। এসবের মধ্যে কাজ থেমে থাকে না। ‘প্রত্যহ’, ‘সীমান্ত’, ‘গল্পভারতী’, ‘দীপায়ন’, ‘সাহিত্যপত্রে'-র মতো ছোটো-বড়ো পত্রিকায় মানিক গল্প পাঠাতে থাকেন।

না লিখলে হাঁড়ি চড়বে না। ‘কলম-পেষা মজুর’ তিনি। লেখা নেশা। পেশাও বটে। তাই দিনলিপির পাতায় মানিক লিখে রাখেন—‘প্রত্যহের রবিবাসরীয়ের জন্য ৩৫ টাকায় গল্প দিতে অক্ষমতা জানালাম। ৫০ টাকা সর্বনিম্ন মজুরি।’

আমাদের স্মরণে আসবে আট বছর আগে, ১৯৩৮ সালে, জনৈক এক সম্পাদককে লেখা চিঠির কথা। যেখানে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শ্লেষের সুরে বলছেন—‘সম্মানমূল্যের জন্য আমি গল্প লিখি না, গল্প লিখিয়া কিছু সম্মানমূল্য প্রত্যাশা করি।… আজকাল একটা অপরাধ করিতে আরম্ভ করিয়াছি—গল্পের জন্য কিছু বেশী পারিশ্রমিক দাবী করি। অপরাধ তবু মার্জ্জনীয়, অভদ্রতার মার্জ্জনা নাই। তবু একটা ঘোরতর অভদ্রতা করি—প্রায় দোকানদারের মতই প্রার্থনা জানাই পারিশ্রমিকটা হাতে হাতে নগদ দিতে হইবে।’ যথোপযুক্ত পরিশ্রমের পর হকের মজুরি ‘ছিনিয়ে’ আনায় লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে কোনোদিন এতটুকু দ্বিধা ছিল না।

সাহিত্যকেই বেঁচে থাকার অবলম্বন করতে চেয়েছেন। অথচ বিনিময়ে যে অনটন তাঁকে সহ্য কর‍তে হয়েছে, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না! মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিনলিপি এই সংকটের মর্মান্তিক ভাষ্য। সেখানে ছত্রে ছত্রে ধরা পড়েছে—কীভাবে দুর্গতির দিনে দাদারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে  বরানগরের ভাড়াবাড়িতে ক্যানভাসের পার্টিশন দিয়ে সংসার ‘সাজাতে’ হয়, স্ত্রী মৃত সন্তান প্রসব করলেও অনটন এমন পর্যায়ে পৌঁছয়, যাতে করে তাঁকে লিখতে হয়—‘বাচ্চা মরে যাওয়ায় ডলি অখুসী নয়। বলল যে বাঁচা গেছে বাবা, আমি হিসেব করছি বাড়ী ফিরে মাসখানেক বিশ্রাম করে রাঁধুনি বিদায় দেব! অনেক খরচ বাঁচবে।’ স্ত্রীর এই অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়ার কারণ অনুসন্ধানে মানিকের বিশ্লেষণ—‘মানুষ সন্তানকে ভয় করছে? দশমাস গর্ভ ধারণ করে মৃত সন্তান প্রসব করে মা ভাবছে, বাঁচা গেল? অভিশপ্ত সমাজ এমনি অস্বাভাবিক করেছে জীবন।’

টাল সামলাতে প্রকাশকের দফতরে নতুন চুক্তি, পাওনা-বকেয়া উদ্ধার নিয়ে নাজেহাল হয়ে পড়েন। গল্পের প্লট মাথা থেকে ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হতে থাকে। জায়গা নেয় রোগজ্বালা, সংসারে স্ত্রীর সঙ্গে অশান্তি, সন্তানদের অসুস্থতা। সবকিছু সামাল দিতে অর্থের সন্ধানে পদাতিক মানিক হন্যে হয়ে হেঁটে চলেন শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা। ডায়েরিতে লিখে রাখেন: ‘সারাদিন ঘুরেছি—দুপুর ১টা থেকে রাত রাত ৮টা। ২ মাইল হাঁটা হয়েছে।… আজও বেরিয়ে অনেক কাজ সেরে এলাম—প্রকাশকদের কাছে—... কী শ্রান্তিই বোধ করছি।’  এতকিছুর পরেও হকের মজুরি মেলে কই? ‘লাজুকলতার শেষ ফর্মা কভার সই করলাম, টাকা কই?’, ‘গল্পভারতীর অগ্নিশুদ্ধির প্রুফ দেখে দিলাম—মজুরি পাঠায় নি’, ‘বেঙ্গলে শচীনের কাছে ১০০ টাকা চেয়ে পত্র দিলাম’—পর পর দিনলিপির এন্ট্রিগুলি হতাশায়, বেদনায়, আর্তনাদে আতুর।

বাংলার সাহিত্য-বাজারের শঠতা, তঞ্চকতা খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। হয়তো এই কারণেই সরে এসেছিলেন প্রথম যৌবনের আদর্শায়িত চিন্তাধারা থেকে। স্বীকারোক্তির ছলে বেদনাবিধুর ভাষায় তিনি লেখেন, ‘এখনও আত্মীয়স্বজন আফশোস করেন, ‘তোর দাদা লেখাপড়া শিখে দু'হাজার টাকার চাকরি করছে, তুই কি করলি বল তো মানিক?—না একটা বাড়ি, না একটা গাড়ি—’... আপনারা কী বলেন?’

শেষ জীবনে, অসুস্থ শরীরে 'যুগান্তর' পত্রিকার পূজাসংখ্যায় লেখা জমা দিতে যাচ্ছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। রাস্তায় বন্ধু দেবীপদ ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা। বিধ্বস্ত চেহারা দেখে দেবীপদ একপ্রকার জোর করেই তাঁকে বাড়ি নিয়ে গেলেন। বন্ধুর মায়ের হাতের রান্না মানিক পেট পুরে খেলেন৷ তারপর একদিন সদর্পে 'আমি শুধু সাহিত্যিকই হব'—বলে ঘোষণা করা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বেরোনোর সময় দেবীপদর হাত ধরে অস্ফুটে বলে উঠেছিলেন—''দেখো দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়।''


ভিডিও স্টোরি