শেষ আপডেট: 2nd December 2024 13:31
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ভবানীপুরের ইন্দ্র রায় রোড চেনেন? হ্যাঁ! পাড়ার লোকসহ অনেকেই সজোরে চিৎকার করে উঠলেও যদি জানতে চাওয়া হয়, কার নামে এই রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে? কিংবা তিনি কে ছিলেন? এবার বোধহয় জ্ঞানকোষের চুল ছিঁড়েও জবাব মিলবে না। যে কৃতী, অসম-সাহসী, বঙ্গতনয়ের নামে এই রাস্তার নাম রাখা হয়েছিল তাঁকে বহুকাল আগেই ভুলেই গিয়েছে বাঙালি। ইতিহাসের পাতা উলটে খুঁজে দেখা যাক ইন্দ্রলাল 'লাড্ডি' রায় নামে এই বাঙালি বীরপুঙ্গবটি কে! যাঁর জন্ম হয়েছিল ২ ডিসেম্বর, ১৮৯৮ সালে। মৃত্যু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্বে ১৮ জুলাই, ১৯১৮ সালে।
ইন্দ্রলাল রায় প্রথম ভারতীয় বাঙালি বিমান চালক এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একমাত্র ভারতীয় বৈমানিক। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধ করেন এবং মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ফ্রান্সের পক্ষ হয়ে জার্মানির বিপক্ষে বেশ কয়েকটি সামরিক অভিযানে অংশ নেন এবং যুদ্ধবিমান চালনায় দক্ষতার পরিচয় দেন।
ইন্দ্রলাল রায়ের জন্ম কলকাতার ভবানীপুরে। তাঁর বাবা পিয়ারিলাল রায় বরিশাল জেলার লকুতিয়া অঞ্চলের জমিদার ও আইনজীবী এবং মা ললিতা রায় ছিলেন নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনকারী। ভাই পরেশলাল রায় ছিলেন মুষ্টিযোদ্ধা। শিক্ষা জীবনে তিনি বেশ কয়েকটি বৃত্তি অর্জন করেন। বৈমানিক হিসেবে যোগদানের আগে তিনি সর্বশেষ ব্যালিওল বৃত্তি লাভ করেন। এই বৃত্তি নিয়ে তিনি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান। ১৯১১ সাল পর্যন্ত তিনি কেনিংস্টনে-এর সেন্টা পলস স্কুলে পড়াশোনা করেন। তার মূল শিক্ষার প্রায় পুরোটাই ইংল্যান্ডে।
১৯১৭ সালের এপ্রিল তিনি রয়্যাল ফ্লাইং কোরে যোগ দেন। এই ফ্লাইং কোর থেকে ১৯১৭ সালের ৫ জুলাই সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কাজে যোগ দেন।
১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ইন্দ্রলাল ফ্রান্সের পক্ষে জার্মানির বিপক্ষে একটি সামরিক বিমান অভিযানে অংশ নেন। এই অভিযানের সময় তাঁর বিমান জার্মান বিমানের হামলা নো ম্যানস ল্যান্ডে এসে পড়ে। তিনদিন পর একটি ব্রিটিশ সেনাদল তাঁকে উদ্ধার করে ফ্রান্সের ব্রিটিশ সামরিক হাসপাতালে পাঠায়। সামরিক হাসপাতালের ডাক্তাররা তাঁকে মৃত ঘোষণা করে মর্গে পাঠিয়ে দেন। পরে তিনি জ্ঞান ফিরে পান। সুস্থ হওয়ার পর আবার বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেন।
১৯১৮ সালে ৬ জুলাই থেকে তিনি বিমান আক্রমণ শুরু করেন এবং ৯টি জার্মান বিমান ধ্বংস করে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ১৮ জুলাই তারিখে তার বিমান ফের গুলি করে ধ্বংস করা হয় এবং সেবারই চিরতরে ইন্দ্রপতন ঘটে।
তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় তথা বাঙালি বিমান চালক, যিনি ১৭০ ঘণ্টা বিমান চালানোর রেকর্ড করেছিলেন। তাঁর অসামান্য কৃতিত্বের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর বিশিষ্ট Distinguished Flying Cross সম্মানে ভূষিত করে।
শুধু ইন্দ্রলাল একা নন, তাঁর গোটা পরিবারের প্রায় প্রত্যেকে ছিলেন বিখ্যাত ব্যক্তি। তাঁর দাদু (মায়ের বাবা) -ডাঃ সূর্যকান্ত চক্রবর্তী ছিলেন পশ্চিমী চিকিৎসা শাস্ত্রে শিক্ষিতদের অন্যতম একজন। ইন্দ্রলালের বড় ভাই সেনাবাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনীতে চাকরিতে করতেন। এবং পরবর্তীকালে তিনিই ভারতীয় বক্সিংয়ের জনক রূপে বিখ্যাত হন।
জার্মান বাহিনীর গুলিতে মৃত ভেবে তাঁকে যখন মর্গে পাঠানো হয়, সেখানে তিনি সংজ্ঞা ফিরে পান। মর্গ থেকেই তাঁর চিৎকার এবং দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে সকলে চমকে ওঠেন। ভয়ে ভয়ে কর্মীরা দরজা খুলতেই হাসিমুখে বেরিয়ে আসেন ইন্দ্র রায়। যমালয় থেকে জীবন্ত মানুষ ফিরে পাওয়ার পর তাঁর ফের চিকিৎসা শুরু হয়। অসুস্থতার সময় তিনি ঘরে বসে যুদ্ধবিমানের ছবি আঁকতেন। যা আজও দিল্লির বিমানবাহিনীর সংগ্রহশালায় রাখা আছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধেই মাত্র ১৯ বছর বয়সে প্রাণ হারানো ভারতের প্রথম 'বোমারু বিমান ওস্তাদ' ইন্দ্রলালের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন সেকালের আরেক প্রখ্যাত জার্মান যুদ্ধবিমান চালক রেড ব্যারন ওরফে ম্যানফ্রেড ফন রিখটোফেন। ইন্দ্রলালের বিমানের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে বিমানে করে আকাশ থেকে তাঁর মৃত্যুস্থলে ভস্ম ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এই প্রবাদপ্রতিম যোদ্ধা। ইন্দ্রলালের সমাধিতে বাংলায় লেখা হয়েছিল 'মহাবীরের সমাধি, সম্ভ্রম দেখাও স্পর্শ করো না।'
উল্লেখ্য, ইন্দ্রলাল রায়ের ভাগনে সুব্রত মুখোপাধ্যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোমারু বিমান চালক হিসেবে কাজ করেছেন এবং ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রথম চিফ অফ এয়ার স্টাফের পদমর্যাদা লাভ করেন।