Sunitikumar-Jatindramohan-Nabaneeta
শেষ আপডেট: 13th January 2025 11:33
বাড়ির নাম ‘সুধর্মা’। তৎসম শব্দ। সংস্কৃতে যার অর্থ ‘দেবসভা’। বাড়ির অন্দরমহলের পারিপাট্য ও সজ্জায় চোখ পড়লেই বোঝা যেত, নামকরণে এতটুকু অত্যুক্তি নেই। ঘরের দেয়ালজুড়ে নানা ভাষার একাধিক ধর্মগ্রন্থের বাণী। আলমারি ঠাসা রেক্সিন-বাঁধানো বই। সেই বইয়ের ঢেউ উথলে এসেছে বিছানায়। শোকেসে সাজানো… না, সুদৃশ্য চিনামাটির কাপপ্লেট কিংবা অনিন্দ্যসুন্দর ফুলদানি নয়… দুনিয়া-সেঁচে জোগাড় করা আশ্চর্যদর্শন কিউরিও। শহরের তামাম বুধমণ্ডলীর আসা-যাওয়া লেগে থাকে নিরন্তর। আড্ডা জমে, তর্কের তুফান ওঠে। মধ্যমণি স্বয়ং গৃহকর্তা। ক্বচিৎ-কদাচিৎ রসসিক্ত মন্তব্য করেন। কিংবা অন্তর্ভেদী টুকরো মন্তব্যে খুলে দেন নতুন কোনো চিন্তাস্রোত।
হিন্দুস্থান পার্কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বাসগৃহ ‘আরও এক অধ্যাপকের বাড়ি'-র পরিচিতি ছেড়ে এভাবেই হয়ে উঠেছিল ‘বাংলার সংস্কৃতি-মন্দির’। ইতিহাস-বিস্মৃত বাঙালি সেই মন্দিরের কদর বোঝেনি। তা না হলে এমন পুণ্যতীর্থ কখনও পণ্যবিপণকেন্দ্রের চেহারা নেয়? হেরিটেজ বিল্ডিং স্রেফ সংরক্ষণের বদলে ধোপদুরস্ত জামাকাপড়ের দোকান হয়ে ওঠে? ‘সুধর্মা’ থেকে ‘ফ্যাব ইন্ডিয়া'-র অভিযাত্রা আসলে বাঙালির সাংস্কৃতিক অবনমন ও দৈন্যের মর্মান্তিক নিদর্শন।
শুধু সুনীতিকুমারই নন। হিন্দুস্থান পার্ক, সাউথ এন্ড পার্ক, হিন্দুস্থান রোড, ডোভার লেন, বালিগঞ্জ প্লেস—বালিগঞ্জ থেকে গড়িয়াহাট পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় এমন অনেক সাহিত্যিক, রাজনীতিকের বাড়িই আজ হস্তান্তরিত হয়েছে। জ্যোতি বসু, নবনীতা দেবসেন, যতীন্দ্রমোহন বাগচী—তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
আজ থেকে দশ বছর আগে একটি স্মৃতিচারণে অমোঘ ভবিষ্যতের ছবি তুলে ধরেছিলেন নবনীতা। খেদোক্তির সুরে লিখেছিলেন, “অভিজাত গৃহস্থের বাসভূমি থেকে বাণিজ্যমুখী হয়ে উঠছে আমার পাড়া। মিষ্টির দোকান উঠে যাচ্ছে, আর কেক পেস্ট্রির দোকান খুলছে পাড়ায়। ইস, এতগুলি ফ্যশানি দোকান, কিন্তু কেউ কখনও হিন্দুস্থান পার্কে একখানাও বইয়ের দোকান খোলেনি কেন গো?”
হিন্দুস্থান পার্কের ৭২ নম্বর বাড়িতে জন্মেছিলেন তিনি। বাড়িটি বানিয়েছিলেন তাঁর পিতা, সাহিত্যিক নরেন্দ্র দেব। মা রাধারাণী দেবী তখন সদ্যোজাত পুত্রকে হারিয়ে শোকে পাথর। শরীর শোধ তুলেছে। নিজের অবস্থাও মরণাপন্ন। কোনওক্রমে ধন্বন্তরি চিকিৎসক শ্যামাদাস বাচস্পতির হাতযশে বেঁচে উঠলেন ঠিকই। কিন্তু নরেন্দ্রকে নিদান শুনতে হল—স্ত্রীকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আলো-বাতাস খেলে এমন বাড়িয়ে নিয়ে আনাটা জরুরি। নইলে শিয়রে শমন! দেরি করেননি নরেন্দ্র। তক্ষুনি নিজে নকশা এঁকে হিন্দুস্থান পার্কে জমি কিনে তৈরি করেন স্বপ্ননীড়। নাম দেন ‘ভালো-বাসা’। প্রেম-অনুরাগ-মায়ার নিবিড় বাঁধনে গড়ে ওঠা ঠাঁই।
১৯৩৮-এ এখানেই জন্ম নেবেন নবনীতা। যাঁর বৈদগ্ধ্য, রুচিবোধ আর রসবোধের স্পর্শে এ গৃহই ধীরে ধীরে সেজে উঠবে। কখনও বসবে সাংস্কৃতিক আসর। কখনও ভূমিষ্ঠ হবে নতুন সাহিত্যপত্রিকা। কখনও-বা আয়োজিত হবে নতুন কোনো নাটকের মহড়া। আজ সেই ‘স্মৃতি’, সেই ‘সত্তা’ মুছে গেছে। ‘ভবিষ্যৎ’-এর জন্য রাখা আছে ক্যাফিনের সুবাস৷ ‘ভালো-বাসা’ এখন ‘বুনাফিল ক্যাফে’। দিনশেষে কর্মক্লান্ত বাঙালি-অবাঙালি মিলে ‘চিল আউটে'-র খোঁজে জমায় মজলিশ। কফির কাপে চুমুক, রোস্ট-গ্রিল-ফ্রাইয়ের ধোঁয়ায় বাইরের লন, ভেতরবাড়ির বারান্দা হরদম সুবাসিত। নবনীতা-নরেন্দ্র দেবের স্মৃতিধন্য বাড়ির কৌলীন্য এভাবেই ধরে রেখেছে বাঙালি। ভেঙেচুরে, রঙ লেপে ‘রিকনস্ট্রাকশন’ আর ‘ডিকনস্ট্রাকশনে’-র মডেলে বদলে দিয়েছে নিজেদের অতীত, বদলে ফেলেছে আগামীর ভবিষ্যৎ।
অথচ এই উথালপাতাল পরিবর্তন যে আসছে, ক্রান্তদর্শী সাহিত্যিকের মতোই যেন তা অনুভব করেছিলেন নবনীতা। স্মৃতিচারণে লিখেছিলেন, “হিন্দুস্থান পার্কেই দেখুন, ফ্যাব ইন্ডিয়া, খদ্দর, বাইলুম, বুনকারী, ভূমিসুতা, দেবশ্রী—আরও কত যে দোকান হয়েছে, সব মনেও আসছে না ছাই। আমাদের সেই ছোটবেলার হিন্দুস্থান পার্ক আর থাকল না, পুরো হই চই বাজারে- পাড়া হয়ে গেল, কোনও মানসম্মান রইল না পাড়াটার—... যে দিন থেকে বাইরে এই পাড়ার দিক নির্দেশক হল ‘ফ্যাব ইন্ডিয়া’ বিপণি, আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘সুধর্মা’-বাড়ির পরিচয়ের বদলে… সে দিন থেকেই আমাদের আত্মপরিচয়ের রদবদল শুরু।”
অবাঙালি প্রোমোটার, ব্যাবসায়ীদের আগ্রাসনে ধীরে ধীরে কীভাবে একটা আস্ত তল্লাটের ভোলবদল, রূপবদল হল সে তো দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। কিন্তু ঠিক কবে থেকে হিন্দুস্থান পার্ক ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল উচ্চাশী বাঙালির কদরের জায়গা হয়ে উঠেছিল? ইতিহাস, নথি বলছে, দেশভাগের আগে, মূলত পূর্ববঙ্গের উচ্চমধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালি ব্যবসা, চাকরি কিংবা মামলা মোকদ্দমার জন্য যখন কলকাতা আসত তখন তারা এই অঞ্চলটিকেই বেছে নেয়।
সেই সময় যা ছিল অস্থায়ী ঠিকানা, দেশভাগের পর তা-ই স্থায়ী বাসস্থানে পরিণত হয়। ১৯৬১ সালের জনগণনার তথ্য ও ১৯৬২ সালের পশ্চিমবঙ্গের বিধান পরিষদের ভোটার তালিকা ঘেঁটে জানা যায়, গড়িয়াহাট-বালিগঞ্জ অঞ্চলের গ্র্যাজুয়েটদের ঘনত্ব সারা ভারত শুধু নয়, পুরো এশিয়ার মধ্যে ছিল সবচেয়ে বেশি! শিক্ষিত, রুচিবান হিন্দু বাঙালির মেধা ও মনন একটা আস্ত এলাকায় এভাবে জড়ো হয়েছিল এবং একচ্ছত্রভাবে নিজেদের চরিত্র ধরেও রেখেছিল। ভুঁইফোড় বাঙালি, অবাঙালি, যাদের কাছে বিত্ত-ই ধর্ম বিত্ত-ই মোক্ষ, তারা যবে থেকে অনুপ্রবেশ করল, বদলে গেল আমূল চালচিত্র।
এক্ষেত্রে অবাঙালিদের খলনায়ক ভাবাটা কিন্তু ভুল হবে। প্রশ্নটা রুচির অবক্ষয় নিয়ে। স্বাধীনতা-দেশভাগের আগেও হিন্দুস্থান পার্কে বেশ কয়ঘর অবাঙালির বাস ছিল। নবনীতা দেবসেন লিখেছেন তাঁদেরই এমন কিছু প্রতিবেশীর কথা। জাতি পরিচয়ে যাঁরা শিখ। শেষবিকেলের পড়ন্ত আলোর রেশ সঙ্গে নিয়েই গোটা মহল্লা ভজন-কীর্তনে সরগরম হয়ে উঠত। আরতি-শেষে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে যেত সুস্বাদু হালুয়া, জিলিপি। পাড়ায় ছিল সাউথ ইন্ডিয়া ক্লাব। তারা পাঠাত জিভে-জল-আনা ইডলি, ধোসা। বাঙালি বাড়ির জানালা গলে চলে যেত দুপুরের তরকারির ছোটো একটি বাটি। রাস্তার জলকল থেকে ঘড়া কাঁখে জল আনতে এ বাড়ি, সে বাড়ির ঝিয়েরা, বউয়েরা পায়ে পা মেলাত। হাইরাইজ স্কাইলাইন সেই পায়ের ছন্দ, জলভরার শব্দ, ছলকে পড়া কলসীর সুর কেড়ে নিয়েছে।
নবনীতার বাড়ির ঠিলছোড়া দূরেই ‘ইলাবাস’। কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর বাড়ি। জমি কিনে মনের মতো ঠাঁই গড়ে তুলেছিলেন ‘কাজলা দিদি'-র কবি। সামনে বিরাট বাগান। গেটের মাথায় হাস্নুহেনা। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ত দু-ধারে থরে-বিথরে সাজানো জুঁই, চাঁপা, গন্ধরাজ, গোলাপ। সেই বাগান পেরিয়ে সামনে লম্বা বারান্দা। যেখানে কার্পেটের উপর তাকিয়া পেতে বসে থাকতেন কবি। অন্দরমহলে বসত মজলিশ। কে আসেননি সেখানে? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, হেমেন্দ্রকুমার রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, কালিদাস রায়, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মেঘনাদ সাহা, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, নরেন্দ্র দেব, রাধারাণী দেবী… এমন সাংস্কৃতিক পীঠস্থানও বেহাত করতে রেয়াত করেনি কেউ। কোথাও কোনো আওয়াজ ওঠেনি। নিশ্চুপে নিষ্ঠুরভাবে ভেঙে ফেলা হয়েছে যতীন্দ্রমোহনের স্বপ্নের ‘ইলাবাস’। এক কবির অনুভবে মোড়া ঠাঁই আজ ‘দ্য ডে রুম ক্যাফে’।
এই স্বপ্নের অপমৃত্যু সেদিন খুব কাছ থেকেই যেন দেখতে পেয়েছিলেন নবনীতা। দমচাপা অভিমান বুকে নিয়েই লিখেছিলেন, “...এমনকী জ্যোতি বসুর বাড়িও এখন কেউ চেনে না, খোঁজে, ‘ফিফটিফাইভ’, গেস্ট হাউস? আগে ‘ভালো-বাসা’ বাড়ি ছিল পথ নির্দেশের চিহ্ন, এখন আমার কাছে লোকে জানতে চায় আমার বাড়ির কাছাকাছি দিক-চিহ্নটি কী? আমি সবিনয়ে জানাই চিনে রেস্তোরাঁর হদিশ।” নিজের অবর্তমানে বাবা-মায়ের স্বপ্নরাঙা নিবাসের অনিবার্য ভবিতব্য নিয়েও এতটুকু আশা ছিল না তাঁর। কাঁপা কাঁপা অক্ষরেই বুঝি লিখেছিলেন পরের বাক্যটা… “কোনও দিন ‘ভালো-বাসা’ হয়ে যাবে, ‘ওই বুনকারীর বাড়িটা’।”
বুনকারীর বাড়ি নয়, ‘ভালো-বাসা’-কে ঝাঁ-চকচকে রেস্তোরাঁয় বদলে যেতে দেখেছে, বদলে যেতে দিয়েছে বাঙালি। বঙ্কিমচন্দ্রের অনুতাপ ছিল “বাঙ্গালার ইতিহাস চাই। নহিলে বাঙ্গালী কখনও মানুষ হইবে না।” ভুল ভেবেছিলেন বঙ্কিম। বাঙালির ইতিহাস ছিল। বাঙালি তার মর্যাদা বোঝেনি। বাঙালি তাকে ‘ভালোবাসেনি’।
তথ্য ও সূত্র:
১. নবনীতা দেবসেন: ‘দোকান রেস্তোরাঁর ভিড়ে পাড়াটা হারিয়ে গেল’
২. পার্থপ্রিয় পণ্ডা: ‘রসনারসিক সুনীতিকুমার’
৩. ঈশিতা ভাদুড়ি: ‘ব্যক্তি যতীন্দ্রমোহন’
৪. সুগত সিনহা
৫. রত্না মিত্র: ‘রাধারাণী দেবী’