Advertisement
ছবি- দিব্যেন্দু
Advertisement
শেষ আপডেট: 20 April 2025 13:54
দ্য ওয়াল ব্যুরো: আড্ডাটা শুরু হয়েছিল এক ভেসে যাওয়া বণিকের গল্প দিয়ে। বাণিজ্যতরী ডুবে যাওয়ার পর এক ব্যবসায়ী সংজ্ঞাহীন অবস্থায় অচেনা দ্বীপে উপস্থিত হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁকে উদ্ধার করেন। তারপর শুরু হয় সমাদর পর্ব। আচমকাই সকলে মিলে সেই বণিককে রাজার আসনে বসিয়ে দেন। যত্নআত্তির এতটুকু খামতি থাকে না। অযুত সম্পদের মালিকও হন তিনি৷ কিন্তু পাশাপাশি জানানো হয়, এই বিলাস-ব্যসন, আতিথিয়েতার মেয়াদ এক বছর। তারপরই তাঁকে যেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল সেখানেই ছেড়ে রেখে আসা হবে৷
একথা শুনে সেই বণিক ঘাবড়ে যান। জানতে পারেন, আগে আরও অনেকে ‘এক বছরের রাজা হয়েছেন’ এবং বছরশেষে বৈভব ছেড়ে ফের কপর্দকশূন্য হওয়ার পর অনাহারে, অবসাদে মারাও গিয়েছেন৷
গল্পের বণিক বিচক্ষণ। তিনি আর সেই ভুল করলেন না। বছরের আয়ু ফুরতে না ফুরতেই দ্বীপের পাশে জঙ্গল সাফ করে, পাহাড় কেটে বানিয়ে ফেললেন আস্ত নগর। তারপর সঞ্চিত সম্পদ ও লোকবল নিয়ে সরে গেলেন সেখানে৷ বারো মাস কেটে যাওয়ার পর তাঁর সমস্যা রইল না। নয়া রাজ্যে সুখে-শান্তিতে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিলেন।
গল্পটা সাঁটে বলার পর আড্ডাচক্রের সূত্রধর, পেশায় সাংবাদিক-সম্পাদক ভাস্কর লেটের প্রশ্ন ছিল: এই বণিক-রাজার মতো কোনও লেখক যদি নশ্বরতা ও আকস্মিকতার মুখোমুখি হন, তাহলে তাঁর মনে ঠিক কোন অনুভূতি জন্ম নেয়? ঈশ্বর বা ঈশ্বরপ্রতিম কোনও শক্তিকেই কি তিনি শ্রেষ্ঠ গল্পকার বলে মনে করেন? নাকি নিজে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে চান?
প্রশ্নটা উঠেছিল গতকাল। আলিপুরের জেল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে। উল্টোদিকে বসেছিলেন সাহিত্যিক শ্রীজাত ও উজ্জ্বল সিনহা। উপলক্ষ্য: চলতি বছরে প্রকাশিত দুটি উপন্যাস এবং সেই সূত্রে দুই সাহিত্যিকের লেখক হয়ে ওঠার যাত্রাপথের আলোচনা।
একদিকে শ্রীজাত। কবি হিসেবে আদৃত, আলোচিত। কিন্তু গদ্যের ভুবনে তাঁকে সেভাবে দেখা যায়নি। ‘৪০৪৩’ কালানুযায়ী শ্রীজাতর প্রথম উপন্যাস। কল্পবিজ্ঞানকে ভিত্তি করে এই আখ্যান গড়ে উঠেছে৷
অন্যদিকে উজ্জ্বল সিনহা পেশায় উদ্যোগপতি। বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় পরিচিত মুখ। প্রথম উপন্যাস ‘উজানযাত্রা’। তারই রেশ টেনে এ বছর বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে দ্বিতীয় আখ্যান ‘কালোদিঘি’।
মূলত এই দুটি বই-ই আলোচনার টেবিলে উঠে এসেছিল৷ আলোচনা বলা ভুল, অনুষ্ঠানের আদ্যোপান্ত জুড়ে ছিল আড্ডার মেজাজ। ‘দুই হুজুরের আড্ডা'—নামনির্দেশে যা স্পষ্ট।
সঞ্চালক লেখকের নশ্বরতা নিয়ে যে প্রশ্নটি তুলেছিলেন, দুজন দুভাবে তার উত্তর দেন। উজ্জ্বলবাবু প্রথম উপন্যাস লেখার প্রেক্ষিতটিকে তুলে ধরেন৷ বিজ্ঞাপনের দুনিয়া যেহেতু সীমিত শব্দ ও সংকুচিত সময়ের কারবার, সেখানে ১৫-২০ শব্দ কিংবা ১৫-২০ সেকেন্ডেই যেহেতু নিজের কপি রচনার মুন্সিয়ানা দেখাতে হয়, তাই একজন লেখক হিসেবে এই শব্দের দুর্ভিক্ষ তাঁকে পীড়া দিত। তিনি বুভুক্ষুর মতো পরিসর খুঁজে যেতেন। আর সেই সুযোগ খুঁজতেই কেটে গেল তিরিশ বছর৷ কেটে গেল বলা ভুল। এই দীর্ঘ সময়পর্বে নিজেকে প্রস্তুত করলেন। কোভিডকালে পেলেন আকাঙ্ক্ষিত অবসর। আর ধাপে ধাপে জন্ম নিল ‘উজানযাত্রা’।
‘উজানযাত্রা’-য় আখ্যানের গড়ন নিয়ে নিরীক্ষা চালিয়েছেন উজ্জ্বল। এই আখ্যান প্রথাবদ্ধ সম্পর্কযুক্ত অধ্যায় মেনে লেখা নয়৷ এর চলন, লেখকের ভাষায়, ‘রাইজোমেটিক’। আদা যেভাবে নির্দিষ্ট আকার-অবয়বহীনভাবে জন্ম নেয়, বেড়ে ওঠে, সেভাবেই প্রথম লেখাকে ‘রূপ’ দিতে চেয়েছিলেন তিনি। অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল নাতিদীর্ঘ বিদেশি উপন্যাস ‘দিজ ঘোস্টস আর মাই ফ্যামিলি’ (These Ghosts are My Family)।
যদিও দ্বিতীয় উপন্যাস ‘কালোদিঘি’ অনেক বেশি আত্মজৈবনিক এবং সূত্রবদ্ধ গল্পের (Linked Stories) ধরনে লেখা৷ একজন মানুষ কীভাবে গাছমানুষ হয়ে ওঠে, তারপর আসবাব হয়ে পুরনো ডেরায়, সংসারে ফিরে আসতে চায়—জাদুবাস্তবতার থিমকে কাজে লাগিয়ে উপন্যাস গেঁথেছেন লেখক।
সহবক্তা উজ্জ্বল যেমন কাজের জগৎ বিজ্ঞাপনের দুনিয়া থেকেই উপন্যাস লেখার ক্ষুধা সঞ্চয় করেছেন, শ্রীজাতর ক্ষেত্রে বিষয়টা আলাদা। তিনি কবি৷ কবিতা লিখতে গেলে ভাবনার সলতে পাকানোর সময় দিতে হয়, পরিশ্রম লাগে কম। তাই স্বভাব-আলস্যেই এতদিন কথাসাহিত্যে নামা হয়নি। রসিকতার ছলে জানালেন তিনি।
প্রথম উপন্যাস ‘৪০৪৩’ লেখার বীজ বুনেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ২০০৬ সালে। তখন তিনি আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছেন লেখকদের একটি কর্মশালায় অংশ নিতে। বিদেশের নি:সঙ্গতা ও শৈত্য ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করেছে৷ সেই মানসিক উচাটনে লিখে ফেলেন এই কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক উপন্যাস। যেখানে উঠে এসেছে কাঁটাতার মুছে যাওয়া পৃথিবী, যেখানে আর কোনও রাষ্ট্রনেতা বেঁচে নেই, যে কেউ যে কোনও দেশে অবাধে বিচরণ করতে পারে, তাই সবাই নিজেদের পাসপোর্ট নদীতে ভাসিয়ে দেয়।
কিন্তু প্রথম উপন্যাসেই কল্পবিজ্ঞান কেন? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় পয়লা লেখাতেই নিজের জীবনের কথা বেছে নেন। সেখানে আচমকা খাত বদলের কারণ?
জবাবে শ্রীজাত বলেন, ‘আসলে আত্মজৈবনিক লেখায় নিজের জীবনের কথা তুলে ধরতে হয় ঠিকই৷ কিন্তু সেক্ষেত্রে জীবনকে দেখা উচিত একটু দূরে দাঁড়িয়ে। সেই সময় ও সুযোগ প্রথম উপন্যাসে পাওয়াটা মুশকিল।’
উজ্জ্বলবাবুর মত যদিও কিছুটা আলাদা। তিনি ‘উজানযাত্রা'-র রসদ নিজের জীবন থেকে নিয়েছেন। চরিত্রদের নাম পর্যন্ত পরিবারের সদস্যদের সূত্রে পাওয়া। তবে দিনের শেষে সে সবকিছুই রসদ। তারপর তাতে যুক্ত হয়েছে কল্পনা, চৈতন্য।
কিন্তু অভিজ্ঞতা ছাড়া তো রচনা অসম্ভব! প্রেম ছাড়া উপন্যাসও লেখা হতে পারে না। ভিন্ন আকারে, অচেনা অবয়বে সেই প্রেম ধরা দেয়। ‘খরগোশ আর মারুবেহাগে' সুরের মধ্যে দিয়ে সেই প্রেমের ছবি এঁকেছেন শ্রীজাত। উজ্জ্বলের ‘কালোদিঘি'-তে হরিপদর গাছমানুষ থেকে আসবাব হয়ে ছেলের ঘরে সেঁধিয়ে যাওয়ার অন্তর্লীন বাসনাও তো সেই প্রেমই।
বৈশাখী সন্ধ্যায় ভালবাসার কাছে নতজানু হয়ে ‘জি হুজুর’ বলতে দুই হুজুরই শেষমেশ বাধ্য হলেন।
Advertisement
Advertisement