শেষ আপডেট: 22nd February 2025 16:06
দ্য ওয়াল ব্যুরো: মোটামুটি যে কোনও বাড়িতে গেলেই গোদরেজের (Godrej History) একটা না একটা জিনিস দেখা যাবেই। এসি হোক বা ফ্রিজ, সাবান হোক বা ওয়াশিং মেশিন, গোদরেজ ব্র্যান্ডের জনপ্রিয়তা ঘরে ঘরে। আপাতত যা খবর, ১২৭ বছর ধরে পথ চলার পর গোদরেজ গোষ্ঠী দুই ভাগে বিভক্ত হ'তে চলেছে। যার শুরুটা হয়েছিল সেই ১৮৯৭ সালে।
ভাবুন একবার। ১৮৯৭ সাল। ব্রাম স্টোকারের 'ড্রাকুলা'-র গল্প তখন ইউরোপ থেকে আমেরিকা সর্বত্র আতঙ্কের চোরা-স্রোত বইয়ে দিচ্ছে। সদ্য প্রকাশিত হয়েছে তরুণ রবীন্দ্রনাথের কাব্য চিত্রা, চৈতালী। ওদিকে জমাট বাঁধছে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারতের জন-আন্দোলন। ঠিক এইরকম সময় এক পার্সি ব্যবসায়ী আরদেশির গোদরেজ (Godrej Split) একটা তালা বানানোর কারখানা তৈরি করেন।
তাবড় নানা স্টার্টআপের গল্প আজ আমরা জানি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ছোট্ট ঘরে তৈরি হয়েছিল ফেসবুক। সিয়াটলের কাছে একটা গ্যারাজ ভাড়া করে শুরু হয়েছিল আমাজনের ডেলিভারি। প্রায় সেরকমই গল্প ওই তালা কারখানার। তখন ব্রিটিশ আমল। তালা আমদানি হত বাইরে থেকে। ওইরকম সময় আরদেশির গোদরেজের কারখানাতেই বলা চলে, প্রথমবার তৈরি হল দিশি প্রযুক্তির হাতে বানানো তালা। ওটাই একটা ইতিহাস। যেটা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেল ১৯০৮ সালে, যখন গোদরেজ পৃথিবীর প্রথম স্প্রিং-ছাড়া তালার পেটেন্ট আদায় করে নিল। তিন বছর পরের কথা। ভারত সফরে এলেন ব্রিটেনের মহারাজা পঞ্চম জর্জ ও রানি মেরি। তাঁদের বহুমূল্য নানা ধনদৌলত সেবার রাখা হয়েছিল গোদরেজের বানানো সিন্দুকে।
চুরি প্রতিরোধের জন্য তৈরি হয়েছিল গোদরেজের (Godrej Split) তালা। পরে ওই তালাই হয়ে ওঠে প্রতিরোধের প্রতীক। প্রতিষ্ঠাতা আরদেশির ঘোর স্বদেশী মনোভাবাপন্ন ছিলেন। কোনওদিন ভারতের বাইরে গিয়ে ব্যবসার কথা ভাবতেন না। ভাবতেন দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা, স্বদেশী শিল্পের কথা। ১৯০৬ সাল। নরমপন্থী-চরমপন্থীদের মধ্যে তুমুল বিরোধের মাঝে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন বসল কলকাতায়। সভাপতিত্ব করলেন প্রবীণ দাদাভাই নওরোজি। শপথ নেওয়া হল স্বরাজের, ডাক দেওয়া হল বিলিতি পণ্য বর্জন ও স্বদেশী পণ্য ব্যবহারের। সেই অধিবেশনেই আরদেশির প্রস্তাব তুললেন, জৈব, ভেষজ প্রযুক্তিতে সাবান তৈরির কথা। সাবান দিয়ে স্বদেশী? আজ ভাবলে অবাক লাগবে। কিন্তু গোদরেজ আর্কাইভের তথ্য বলছে, আরদেশিরের সেই সাবানের পক্ষে প্রস্তাব সমর্থন করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অ্যানি বেসান্ত। আজ সেই গোদরেজের 'সিন্থল' সাবান ঘরে ঘরে পরিচিত।
গোদরেজের বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন করতে গিয়ে পদে পদে বাধার মুখে পড়েছেন আরদেশির। বিলেতের কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন। কাগজ সেসব ছাপল না। কেন? বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল, 'গোদরেজের তালা আমদানি করা তালার মতোই ভাল'। সাহেব সম্পাদকরা সেসব পত্রপাঠ ছাঁটাই করলেন। একমাত্র 'কেশরী', 'ট্রিবিউন'-এর মত দেশী সংবাদপত্রে গোদরেজের বিজ্ঞাপন ছাপা হত। এই অবদান ভোলেননি আরদেশির। 'কেশরী' সম্পাদক লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলকের স্মৃতিতে তৈরি 'তিলক স্বরাজ ফান্ড'-এ সেই যুগে তিন লক্ষ টাকা দান করেছিলেন তিনি।
গোদরেজের সিন্দুক কতখানি মজবুত, তার একটা প্রমাণ মিলেছিল ১৯৪৪ সালের ১৪ এপ্রিল। আজও মুম্বই বন্দরের আনাচে-কানাচে তারিখটা মনে রেখেছেন অনেকে। ক্রমশ ঝিমিয়ে আসছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ইউরোপের রণাঙ্গনে মোটের ওপর মিত্রবাহিনী দখল নিয়েছে। করাচি থেকে বোম্বাইয়ের তৎকালীন ভিক্টোরিয়া ডকে এসে নোঙর করেছে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ 'এসএস ফোর্ট স্টাইকিন'। পেটে ভর্তি নানা দাহ্য বস্তু, রয়েছে প্রায় দেড় হাজার টনের কাছাকাছি গোলাবারুদ, টর্পেডো, মাইন, শেল এমনকি আস্ত একটা স্পিটফায়ার যুদ্ধবিমান! ছিল তেল, কাঠ, কাপড়-সহ বিস্তর জিনিস। ওইদিন দুপুর দু'টো নাগাদ একটা আগুন লাগার খবর আসে। নাবিকরা থামানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু নিমেষে হাতের বাইরে চলে যায় আগুন। শেষে বিকেল চারটে নাগাদ বোঝা যায় অবস্থা চিকিৎসার বাইরে। নাবিকদের জাহাজ খালি করে পালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু মুহূর্তে এক ভয়াল বিস্ফোরণের আওয়াজে গোটা বন্দর কেঁপে ওঠে! তীব্রতা এতটাই ছিল যে, সিসমোগ্রাফ যন্ত্রেও নাকি সে আওয়াজ ধরা পড়েছিল। আটশোর বেশি মানুষ প্রাণ হারান সেই বিস্ফোরণে। সাত মাস ধরে সেই বিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষ সাফাই করা হয়েছিল। কিচ্ছু বাঁচেনি। শুধু একটাই ব্যতিক্রম। জাহাজে গোদরেজের সিন্দুক ছিল কিছু। স্রেফ ওইগুলোই বেঁচে গিয়েছে। ভেতরের জিনিসপত্র যা ছিল, সেও একরকম অটুট ছিল।
পরে গোদরেজের ব্যবসা বাড়ে স্থাপত্যশিল্পে। তারও ছোঁয়া দেখেছে বোম্বাই। ষাটের দশকে বাণিজ্যনগরী মুম্বইতে পেল্লায় নানা আকাশছোঁয়া অট্টালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়। তখন বহু জায়গায় অ্যালুমিনিয়াম ও ইস্পাতের পোক্ত দরজা-জানালার ফ্রেম দিয়েছিল গোদরেজ। আজও টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, এয়ার ইন্ডিয়ার সদর দফতর, ওবেরয় হোটেল-সহ একাধিক নামী ভবনে গোদরেজের ছাপ মারা ফ্রেম দেখা যায়। তবে গোদরেজের এক অগ্নিপরীক্ষা ছিল ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। ১৯৫১ সাল থেকে পাঁচ মাস ধরে চলা ভারতের প্রথম গণতান্ত্রিক পরীক্ষায় দেশের প্রথম বাঙালি নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন নিয়ম করেছিলেন, ব্যালট পেপার নয়, প্রতিটি প্রার্থীর জন্য প্রতিটি বুথে আলাদা ব্যালট বাক্স বানানো হবে। ভারতের জনসংখ্যা ছিল ৩৬ কোটি। তার মধ্যে ১৭ কোটি ছিল বৈধ ভোটার। ৫৩ দলের ১৮৭৪ প্রার্থী দাঁড়িয়েছিলেন সেবার।
গোদরেজের দায়িত্ব ছিল সেই ব্যালট বাক্স বানানোর। শুধু স্টিলের বাক্স হলেই হল না। হতে হবে ওয়াটারপ্রুফ, ট্যাম্পার-প্রুফ এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ যাতে না হয়, সেদিকেও নজর দিতে হবে। প্রায় সত্তর রকমের প্রোটোটাইপ তৈরির পরে চূড়ান্ত নকশা অনুমোদন করেন কমিশনার সুকুমারবাবু। বাকিটা ইতিহাস। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় তৈরি হয়েছিল তেরো লক্ষ বাক্স! প্রতিটি বাক্সে ছিল গোদরেজের বিখ্যাত তালা সিস্টেম। সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে সফলভাবে দেশের প্রথম নির্বাচন করে রীতিমত সাড়া ফেলে দিয়েছিল ভারত। ধন্য ধন্য করেছিল আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স থেকে তাবড় নানা দেশ।