
রূপাঞ্জন গোস্বামী
সমাধি থেকে শবদেহ চুরির ঘটনা বিরল নয়। দেশে বিদেশে হামেশাই শবদেহ চুরি হয়।কঙ্কাল তৈরি করে চোরাবাজারে বেচে দেওয়ার ব্যবসাটা পুরোনো। তা বলে শবদেহের জন্য একেবারে! তাও আবার, চার্লি চ্যাপলিনের মতো বিশ্বখ্যাত এক অভিনেতার শবদেহের বিনিময়ে!
শবদেহ চুরির ইতিহাসে এটি হয়তো সবচেয়ে বিখ্যাত ঘটনা। যা আমরা অনেকেই জানিনা। সুইৎজারল্যান্ডের লেক জেনিভার কাছে, পাহাড়তলীর কর্সিয়র-সার-ভেভেই( Corsier-sur-Vevey) সমাধি ক্ষেত্র থেকে চুরি হয়ে যায় চ্যাপলিনের মরদেহ। চ্যাপলিন প্রয়াত হয়েছিলেন ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর মাসে, ৮৮ বছর বয়েসে। মৃত্যুর মাত্র দু’মাসের মধ্যেই শবদেহটি সিমেট্রি থেকে চুরি হয়ে যায়।
এর পরেই চ্যাপলিন পত্নী উনা,একটি ফোন পান। সেই ফোনে দেহ ফিরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ৬ লক্ষ ডলার দাবি করে শবদেহ অপহরণকারীরা। যদিও উনা অপহরণকারীদের ফোনকে একদমই পাত্তা দেননি। এবং তাদের জানিয়ে দেন চার্লি এটা জানলে হেসে লুটোপুটি খেতেন।
বিশ্বজুড়ে নিন্দা আর সমালোচনার ঝড় ওঠে
তবে চার্লির স্ত্রী ফোনের কথা জানান পুলিশকে। ছুটে আসে বিশ্বের মিডিয়া। কারণ শবদেহটি প্রবাদপ্রতীম কৌতুকাভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনের। সবাই দৌড়ে যায় সমাধি ক্ষেত্রে। গিয়ে দেখা যায়,সমাধিটি, কে বা কারা খুঁড়ে রেখেছে। এবং সমাধি থেকে চার্লির শবদেহ কফিন সমেত উধাও। ঘটনাটি সংবাদ মাধ্যমে আসার পর বিশ্বজুড়ে নিন্দা, সমালোচনার ঝড় ওঠে।
অনেকে ঘটনাটিতে আমেরিকার হাত আছে বলে রটিয়ে দেন। যেহেতু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চ্যাপলিন বরাবর গর্জে উঠেছেন। আমেরিকা চ্যাপলিনকে কমিউনিস্ট ও রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল মনে করতো। একদম পছন্দ করত না।এমনকি, লন্ডনে লাইমলাইট ছবির প্রিমিয়ারে গিয়ে আর আমেরিকায় ফিরতে পারেননি চ্যাপলিন। রি-এন্ট্রি ভিসা দেয়নি আমেরিকা।
এ দিকে চার্লির শবদেহ অপহরণের পরেই সুইস পুলিশ নেমে পড়ে তদন্তে। নিকটবর্তী প্রায় ২০০ টি টেলিফোন বুথে আড়ি পাতে পুলিশ। ও দিকে, চার্লির স্ত্রীয়ের কাছে পাত্তা না পেয়ে, শবদেহ অপহরণকারীরা নেয় অন্যপন্থা। তারা, আবার চার্লির স্ত্রীকে ফোন করে। বলে, টাকা না দিলে চার্লি ও উনার নাবালক দুই সন্তানকে মেরে ফেলা হবে। এ বার কিন্তু সত্যিই ভয় পেয়ে যান উনা। প্রমাদ গোনে পুলিশ প্রশাসনও।
পুলিশের জালে ওয়ার্ডাস আর গানেভ
পুরো সুইজারল্যান্ড জুড়ে বিশাল তল্লাশি শুরু করে সুইস পুলিশ। পাঁচ সপ্তাহ ধরে তদন্ত ও খানাতল্লাশির পর, পুলিশ পোল্যান্ডের রোমান ওয়ার্ডাস আর বুলগেরিয়ার গানস্ক গানেভ নামে দু’জনকে গ্রেফতার করে। এরা পূর্ব ইউরোপ থেকে আসা দুই রাজনৈতিক রিফিউজি এবং পেশায় অটো মেকানিক। এই দুই ব্যক্তি ধরা পড়ার পর পুলিশকে একটি ভুট্টাক্ষেতে নিয়ে যায়। খেতটি চ্যাপলিনের পরিবারিক বাড়ি কর্সিয়র থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। সেই ভুট্টা খেতে তারা চ্যাপলিনের দেহটি মাটির তলায় পুঁতে রেখেছিল।
ভুট্টা ক্ষেতে সেই কফিন, যার মধ্যে ছিল চ্যাপলিনের মৃতদেহ
১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এই দুজন, শবদেহ চুরি আর মুক্তিপণ আদায়ের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়। তারা আদালতকে জানায় অর্থনৈতিক দূর্দশা কাটাবার জন্যই তারা অপরাধটি করে ফেলেছিল। ওয়ার্ডাসকে সাড়ে চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সেই ছিলো ঘটনাটির মূল চক্রান্তকারী।
ওয়ার্ডাস জানিয়েছিল,একটি ইতালীয় খবরে কাগজে শবদেহ চুরির একটি খবর পড়ে সে অনুপ্রাণিত হয়। এবং বেশি মুক্তিপণের আশায় বেছে নেয় চার্লি চ্যাপলিনের শবদেহ। অপর অপরাধী গানেভের হয় ১৮ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড। শবদেহ অপহরণ কাণ্ডে তার ভূমিকা কম থাকায়।
সবশেষে, চ্যাপলিনের দেহটি পুনরায় সমাহিত করা হয় সেই সমাধি ক্ষেত্রে,যেখান থেকে দেহটি চুরি করা হয়েছিল। তবে, এবার সমাধিটি কংক্রিট দিয়ে ঢালাই করে দেওয়া হয়। যাতে আর কেউ রোমান ওয়ার্ডাস আর গানস্ক গানেভের মতো একদিনে বড়োলোক হবার খেলায় আবার না মেতে ওঠে।