
রূপাঞ্জন গোস্বামী
পশ্চিমবাংলার পর্বতারোহণের ইতিহাসে, ফুরিয়ে আসতে থাকা এই দশকটা সম্ভবত সব চেয়ে অভিশপ্ত দশক। কারণ, এই দশক কেড়ে নিয়েছে বাংলার বেশ কিছু অভিজ্ঞ পর্বতারোহীকে। যে ক্ষতি হয়েছে তা এক কথায় অপূরণীয়। বাংলার পর্বতারোহণের ইতিহাসে যুগ যুগ ধরে, আলোচনার ও বুক চাপড়ানোর বিষয় বস্তু হয়ে থাকবে এই দশক। আরোপ প্রত্যারোপ, তথ্যের কাটাছেঁড়া ও ময়নাতদন্তের বিষয়বস্তুও হয়ে থাকবে এই দশক।
কিন্তু তবুও ভোলা যাবে না হিমালয়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়া পাহাড় পাগল মানুষগুলিকে। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও যাঁরা বাঁচার মতো বাঁচার স্বাদ নিতে গিয়েছিলেন হিমালয়ের অঙ্গনে। কেন নেপাল বাঙালি পর্বতারোহীদের মৃত্যুফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার কারণ খোজার চেষ্টা করেছি এই লেখার শেষ অংশে। তার আগে জেনে নিই মর্মান্তিক সেই ঘটনাগুলি, আরেকবার।
২০১৪, ইয়ালুং- কাং ( কাঞ্চনজঙ্ঘা ওয়েস্ট ) কেড়ে নিয়েছিল ছন্দা গায়েনকে
২০১৪ সালের ২০ মে। চিরাচরিত রুটে কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গ আরোহণ করার পর একই অভিযানে কাঞ্চনজঙ্ঘার পশ্চিম শৃঙ্গ ইয়ালুং কাং (৮৫০৫ মি) আরোহণ করার পরিকল্পনা করেন ছন্দা গায়েন। অত্যন্ত কঠিন ও ভয়ঙ্কর ইয়ালুং-কাংয়ের রুট। অতি সংকীর্ণ গিরিশিরা ধরে এক পা এক পা করে এগোতে হয়।
দু’দিকেই গভীর খাদ। একটু এদিক পা ফেললেই নিশ্চিত মৃত্যু। সেই সঙ্গে তীব্র হাওয়ার ঝাপটা। যা মুহূর্তে উড়িয়ে নিয়ে ফেলতে পারে খাদে। কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণ করার মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ক্লান্ত ছন্দা সেই অসম্ভবের অভিযানে নেমেছিলেন। শেরপাদের অনিচ্ছা সত্বেও।
ইয়ালুং কাং শৃঙ্গ ছোঁয়ার কিছু আগেই আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করে। ওঠে তুষারঝড়, ফেরার সিদ্ধান্ত নেন শেরপারা। ঠিক সেই মুহূর্তেই নামে বিশাল তুষারধস। যেটি এক লহমায় ছন্দা গায়েন ও দুই শেরপা, দার্জিলিংয়ের দাওয়া ওয়াংচুক ও নেপালের মিংমা তেম্বাকে নিয়ে নেমে যায় গভীর খাদে।
কিছুটা পিছনে থাকায় বেঁচে যান তাশি শেরপা। চিরতরে হারিয়ে যান ছন্দা, খুঁজে পাওয়া যায়নি তাঁর দেহ। অভিযানের নেশা! আরও একটা রেকর্ড! নাকি স্পনসরদের চাপ! কীসের টানে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ছুটেছিলেন ছন্দা, তা আজও জানা যায় নি।
২০১৬, ধৌলাগিরিতে শেষঘুমে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন রাজীব ভট্টাচার্য্য
শেরপা তাসিকে সঙ্গে নিয়ে ধৌলাগিরি (৮১৬৭ মি) বেসক্যাম্পে পৌঁছান বরানগরের রাজীব ভট্টাচার্য্য। বেসক্যাম্প থেকে ক্যাম্প-১, ক্যাম্প-২, ক্যাম্প-৩ পৌঁছন। শৃঙ্গের খুব কাছেই ক্যাম্প-৩ এর অবস্থান। ১৯ মে, ক্যাম্প-৩ থেকে সামিট পুশ শুরু করে ধৌলাগিরি শৃঙ্গ আরোহণ করেন রাজীব। কিন্তু ফেরার পথে অসুস্থ হয়ে পড়েন, দেখা দেয় স্নো-ব্লাইন্ডনেস (সূর্যরশ্মি বরফে প্রতিফলিত হয়ে চোখে পড়ায় দৃষ্টিহীনতা)।
চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না রাজীব৷ এই অবস্থায় পাহাড় থেকে নামা মানে মৃত্যুকে ডেকে আনা। তবুও রাজীব হাতড়ে হাতড়ে নামার চেষ্টা করেন। আপ্রাণ চেষ্টা করে যান বাঁচার। অক্সিজেন ফুরিয়ে আসে, অবসন্ন দেহে রাজীব এক সময় হাল ছেড়ে দেন। পড়ে থাকেন ধৌলাগিরি নির্জন তুষার সমুদ্রে। নির্মম মৃত্যুর প্রতীক্ষায়। পরে উদ্ধারকারী দল ধৌলাগিরির ক্যাম্প-৩ থেকে কিছুটা ওপরে, প্রায় ৭৫০০ মিটার উচ্চতায় খুঁজে পান রাজীবের নিথর দেহ।
২০১৬, এভারেস্ট কেড়ে নিয়েছিল গৌতম ঘোষ, সুভাষ পাল, পরেশ নাথকে
২০ মে, সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিটে সাউথ কল থেকে রওনা হন চার জন। গৌতম ঘোষ, সুভাষ পাল, পরেশ নাথ ও সুনীতা হাজরা। সঙ্গে পাঁচ শেরপা, বীরবাহাদুর গুরুং (বিষ্ণু), মিংমা তামাং,পাসাং নুরু,লাকপা শেরপা, থিলে শেরপা।
২১ মে, ভোর ৫টায় এভারেস্টের ব্যালকনিতে পৌঁছে যান সুনীতা, গৌতম ও পরেশ। ব্যালকনিতে ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষা করেন, দলের অপর আরোহী সুভাষ পাল ও তাঁর শেরপার জন্য।
কিন্তু তাঁরা জানতেন না সুভাষ তাঁদের আগেই এভারেস্ট শৃঙ্গের দিকে এগিয়ে গেছেন তাঁর শেরপার সঙ্গে। এরপর পর গৌতম ও সুনীতা সামিটের পথে এগিয়ে যান বীরবাহাদুর গুরুং-এর সঙ্গে। পরেশ নাথ অসুস্থ বোধ করায় তাঁকে নীচে নেমে যেতে বলা হয়। বীরবাহাদুর গুরুং, ঘৌতম ঘোষ, সুনীতা হাজরা তিন জনেই শৃঙ্গ আরোহণ করেন বলে পরে জানা যায়।
এভারেস্টে আরোহণ ও অবরোহণ কালে, বিভিন্ন সময়ে একে একে চার পর্বতারোহীকেই বিপদে ফেলে চলে যান তাঁদের পাঁচ শেরপা। বিনা অক্সিজেনে নামতে শুরু করে উচ্চতাজনিত অসুস্থতার কবলে পড়েন পরেশ, গৌতম ও সুভাষ। এক সময় চলার শক্তি হারিয়ে সুভাষ পাল রয়ে যান জেনিভা স্পার এলাকায়। গৌতম ঘোষ নিজেকে অ্যাঙ্কর করে রয়ে যান ব্যালকনির কাছে ট্রায়াঙ্গুলার ফেস এলাকায়। ২১ মে রাতেই সম্ভবত মারা যান গৌতম ঘোষ। পরেশ নাথ সাউথ কলের কিছুটা ওপরে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে থাকেন। বহু অভিযাত্রী তাঁর পাশ দিয়ে ওঠা নামা করলেও কেউ সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসেননি।
২২ মে, সকালে আইএমজি দলের পর্বতারোহীরা সুভাষ পাল নামিয়ে আনেন সাউথ কলে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই পৃথিবী ছাড়েন সুভাষ। ২২ মে’তেই অবিশ্বাস্য ভাবে জীবিত কিন্তু মৃতপ্রায় পরেশকে এনসিসি টিম নামিয়ে আনেন সাউথ কলে। বিনা খাদ্যে, বিনা চিকিৎসায়, বিনা অক্সিজেনে ২৩ ঘন্টা বরফে পড়ে থাকা পরেশ আর লড়তে পারেননি। ২৩ মে সকালে মারা যান পরেশ। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে সুনীতা বেঁচে যান লেসলি জন বিনস নামে এক পর্বতারোহীর সহায়তায়।
বাংলার পর্বতপ্রেমী মানুষের মনে তীব্র অভিঘাত ফেলে এই তিনটি মৃত্যু। এবং এই দুর্ঘটনার পরে বিস্ময়কর ভাবেই দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় বাংলার পর্বতপ্রেমী মহল। অনেকে মনে করেছিলেন এই তিন সুদক্ষ পর্বতারোহীর মৃত্যু নিশ্চিত ভাবেই এড়ানো যেত। অন্য পক্ষের যুক্তি ছিল আট হাজার মিটারের শৃঙ্গ আরোহণের জন্যে তৈরি ছিলেন না মৃত তিন আরোহী।
পর্বতপ্রেমীদের প্রিয় মানুষগুলির মৃত্যু নিয়ে এক নির্মম এবং অসহনীয় পরিবেশ, জন্ম দিয়েছিল এক আন্দোলনের। যা আজও স্তিমিত হয়নি। তিনটি মৃত্যুর কারণ সন্ধানের এই আন্দোলন যুক্তি সঙ্গত বলে মনে করেন বাংলার বহু মানুষ। কারণ তিনটি মৃত্যু সংক্রান্ত ও অভিযান সংক্রান্ত অনেক প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি। সেই সব প্রশ্ন বরং রীতিমত সন্দেহের উদ্রেক করেছিল নেপাল সরকার, এজেন্সি ও বাংলার বেশ কিছু পর্বতারোহীর উদাসীনতা ও ভূমিকা ও কার্যকলাপ সম্পর্কে।
২০১৯, কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে ফিরলেন না কুন্তল কাঁড়ার এবং বিপ্লব বৈদ্য
১৪ মে, বিকেলে ক্যাম্প-৪ থেকে সামিট মার্চ শুরু করেন বাংলার বিপ্লব বৈদ্য, রুদ্রপ্রসাদ হালদার, কুন্তল কাঁড়ার, রমেশ রায় ও শেখ সাহাবুদ্দিন। এই পাঁচ জনই এভারেস্ট আরোহণকারী এবং সুদক্ষ পর্বতারোহী। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন পুর্বা, মিংমা, দাওয়া তেম্বা, দাওয়া সিরিং এবং দাওয়া নামের পাঁচ জন দক্ষ শেরপা। ১৫ মে সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণ করেন শেখ সাহাবুদ্দিন , রুদ্রপ্রসাদ, রমেশ রায় ও বিপ্লব বৈদ্য।
শৃঙ্গে পৌঁছনোর আগেই কুন্তল কাঁড়ারের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তিনি পথেই বসে পড়েন। শৃঙ্গ আরোহণ সেরে ফেরার পথে কুন্তলের সঙ্গে দেখা হয় সাহাবুদ্দিনের। কুন্তলকে জল দেন এবং তাঁর সঙ্গে নীচে নেমে যেতে বলেন সাহাবুদ্দিন। কিন্তু কুন্তল রাজি হননি। রুদ্র, বিপ্লব, রমেশের জন্য অপেক্ষা করবেন বলেন। নিরুপায় সাহাবুদ্দিন নীচে নামার পথ ধরেন।
এর পরে কুন্তলের সঙ্গে দেখা হয় কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণ করে ফিরতে থাকা রুদ্রপ্রসাদের সঙ্গে। তিনিও আপ্রাণ চেষ্টা করেন কুন্তুলকে নিচে নামিয়ে আনার। এক পা এক পা করে নামান কুন্তল কে। কিন্তু চোখ বুজে আস্তে থাকে কুন্তলের। গালে আঘাত করে জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করতে থাকেন রুদ্রপ্রসাদ। ব্যর্থ হন। কুন্তলকে কোনও ভাবে নামাতে না পেরে ওখানেই জুমারে (ওপরে ওঠার ইকুইপমেন্ট) অ্যাঙ্কার করে (পাহাড়ের গায়ে বেঁধে রেখে) ভাল করে বসিয়ে রাখলেন। উদ্ধারকারী টিমের আশায়।
কুন্তলকে ছেড়ে ঊর্ধশ্বাসে খানিকটা নেমে তিনটে নাগাদ, রুদ্রপ্রসাদ এসওএস পাঠান জিপিএস ট্র্যাকার ডিভাইসের মাধ্যমে। মেসেজ করার জন্য ওই সময়ে বেশ কিছুক্ষণ রুদ্রপ্রসাদের গ্লাভস আর সানগ্লাস খোলা ছিল। তখনই ফ্রস্ট বাইট আর স্নো ব্লাইন্ডনেস আক্রান্ত হয়ে পড়েন রুদ্রপ্রসাদও। আর ফিরতে পারেন না কুন্তলের কাছে।
অন্য দিকে সফল ভাবে শৃঙ্গ আরোহণ করে ফেরার পথে হাইপোথারমিয়া ও ফ্রস্ট বাইটে (তুষারক্ষত) আক্রান্ত হন বিপ্লব বৈদ্য। শৃঙ্গ আরোহণ করে নামার পথে কুন্তল ও বিপ্লবকে পড়ে থাকতে দেখে ক্যাম্প-৪ এ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু করেন ‘প্রজেক্ট পসিবল’ টিম লিডার ও বিখ্যাত স্পিড-ক্লাইম্বার নির্মল পূর্জা। তাঁকে সাহায্য করেন তাঁর সঙ্গী মিংমা ডেভিড শেরপা ও গেসমান তামাং।
বিপ্লব ও কুন্তল, দু’জনেরই বোতলের অক্সিজেন ফুরিয়ে গেছিল। নির্মল পূর্জা তাঁর কাছে থাকা অতিরিক্ত অক্সিজেন দুজনকে দিয়ে দিয়েছিলেন। প্রত্যেক ১৫-২০ মিনিট অন্তর, নির্মল পূর্জা রেডিও মারফত অক্সিজেন ও সাহায্য চেয়েছিলেন ক্যাম্প-৪ এ থাকা কুন্তলদের এজেন্সির ব্যাক-আপ টিমের কাছে। কিন্তু সে সাহায্য আর আসেনি।
এরপর হঠাৎই ‘প্রজেক্ট পসিবল’ টিমের সদস্যদের অক্সিজেনের অভাবে অসুস্থতা দেখা দেয়। গেসমান তামাং আর মিংমা ডেভিড শেরপা নীচে নেমে যান। এই সময় মারা যান কুন্তল কাঁড়ার। তবুও হাল ছাড়েন না নির্মল পূর্জা। তিনি আর দাওয়া শেরপা দু’জন মিলে বিপ্লব বৈদ্যকে নিচে নামাতে থাকেন। কিন্তু এক সময় মারা যান বিপ্লব বৈদ্যও। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ক্যাম্প-২ থেকে হেলি-রেস্কিউ করা হয় পালপোনারি ইডিমা ও স্নো ব্লাইন্ডনেসে আক্রান্ত রমেশ রায় ও ফ্রস্ট বাইটে গুরুতর আক্রান্ত রুদ্র প্রসাদ হালদারকে।
২০১৯, মাকালু থেকে ফিরলেন না দীপঙ্কর ঘোষ
১৬ মে, মাকালু শৃঙ্গ ছুঁয়ে দলের সঙ্গে নামছিলেন বাংলার বিখ্যাত পর্বতারোহী দীপঙ্কর ঘোষ। আরোহীরা যখন ক্যাম্প-৪ থেকে মাত্র ৩০০ মিটার দূরে, আচমকাই আবহাওয়া খারাপ হয়ে যায়। ধেয়ে আসে তুষারঝড়, সঙ্গে অ্যাভালাঞ্চ অর্থাৎ তুষার ধস। অভিযাত্রীরা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।
আবহাওয়া একটু ভাল হলে সবাই ক্যাম্প-৪ ফিরে এলেও, দীপঙ্কর ফেরেননি। তিনি কোনও তুষারধসে পড়েছিলেন বলে অনুমান করেছিলেন সকলে। ১৭ তারিখ সকালে দলের শেরপা ও বাকি সদস্যরা দীপঙ্কর ঘোষের খোঁজ করতে থাকেন। কিন্তু তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপর ক্যাম্প-২ থেকে শানু শেরপাকে এজেন্সি পাঠায় দীপঙ্কর ঘোষকে খোঁজার জন্য। শানু শেরপা ক্যাম্প-৩ থেকে অক্সিজেন নিয়ে ক্যাম্প-৪ পৌঁছন। সেখানে তিনি বহু খুঁজেও দীপঙ্কর ঘোষের হদিস পাননি।
এরপর আবহাওয়া ভাল হলে,পাঠানো হয় হেলিকপ্টার। ক্যাম্প-৪ এর ওপরে সাদা বরফের মধ্যে একটি কালো স্পট দেখতে পায় কপ্টার। উদ্ধারকারী দলের অনুমান, ওই কালো স্পটটিই হয়ত দীপঙ্কর! তাই সাত শেরপার একটি অভিজ্ঞ দলকে ২১ মে স্পটে পাঠানো হয় এজেন্সির তরফে। সাত শেরপার উদ্ধারকারী দল ২২ মে মাকালুর ক্যাম্প-৪ এর কাছ থেকে উদ্ধার করে দীপঙ্কর ঘোষের নিথর দেহ।
এর পর কে!
এত মৃত্যু কেন! বাংলার অভিজ্ঞ ও প্রবীণ পর্বতপ্রেমীরা কী বলছেন!
● নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলার বেশ কিছু অভিজ্ঞ ও প্রবীণ পর্বতপ্রেমীদের মতে, নেপালে এজেন্সি নির্ভর আরোহণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন বাংলার পর্বতারোহীরা। এমনিতেই প্রতিবছর নেপাল হিমালয়ে দেশ বিদেশের আরোহীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অদক্ষ শেরপার ভিড়। বাড়ছে নেপালি পর্বতারোহণ এজেন্সিগুলির দৌরাত্ম্য। তারাই নেপালে পর্বতারোহণের হর্তা কর্তা বিধাতা। অনেক মাউন্টেনিয়ারিং এজেন্সি ব্যবসার খাতিরে গাইডলাইন মানছে না। ৬ হাজারি শৃঙ্গ জয়ের অভিজ্ঞতা যাঁর নেই, তাঁকেও এভারেস্টের ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঘুরপথে।
● পর্বতারোহণ একটি খেলা, এবং অনান্য খেলার তুলনায় এই খেলায় প্রচন্ড শারীরিক সক্ষমতা ও মানসিক দৃড়তার প্রয়োজন। ৮০০০ মিটারের শৃঙ্গ আরোহণের ক্ষেত্রে নিজেদের মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতাকে তুঙ্গে নিয়ে যেতে যে পদ্ধতিগুলির মধ্যে দিয়ে এক জন অভিযাত্রীর যাওয়া উচিত, বাংলার অধিকাংশ পর্বতারোহী যেকোনও কারনেই হোক, তা মেনে চলেন না। বিদেশীদের মত মনোবিদ বা ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নেন না।
● নেপালে পর্বতারোহণ এমনিতেই আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ। তার ওপর নেপালে পর্বতারোহণ পুরোটাই এখন প্যাকেজ ট্যুরিজমের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। বিমানের ইকনমি ক্লাস ও বিজনেস ক্লাসের পার্থক্য যেমন, নেপালেও এজেন্সিদের পরিষেবার পার্থক্যও তেমন। ফলে যে ক্লায়েন্টের পকেটের জোর যেমন, তিনি সেরকম পরিষেবা পান। কমপয়সা নিয়ে অভিযানে যাওয়া বেশিরভাগ বাঙালি পর্বতারোহী সুরক্ষা ও অনান্য প্রশ্নে এজেন্সির সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করতে বাধ্য হন।
বাধ্য হন নিম্নমানের খাবার, ইকুইপমেন্ট ও শেরপা নিতে। ফলে হিমালয়ের অধিক উচ্চতায় আরোহণের সময় বিপদে পড়েন। আবার, খরচ কমিয়ে সামিট করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে শেরপাদের কথা শোনেন না পর্বতারোহীরা। কখনও কখনও সেটাও চরম বিপদ ডেকে আনে।
●নেপালের বিভিন্ন এজেন্সির বাংলার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডরেরা তো বটেই, এমনকি অভিযান থেকে বরাত জোরে বেঁচে ফিরে আসা বাংলার পর্বতারোহীরা ভুলেও মুখ খোলেন না, নেপালের এজেন্সিদের বিরুদ্ধে। তাহলে নেপালে ঢোকা বন্ধ করে দেবে এজেন্সির মাফিয়ারা। তাদের ক্ষমতা অসীম। ২০১৬ এভারেস্ট দূর্ঘটনার অন্যতম সাক্ষী বীরবাহাদুর গুরুঙ্গকে বিশ্বের মিডিয়া তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও, আজ তিন বছর ধরে লুকিয়ে রেখেছে তারা। কারণ সে সামনে এলেই নেপালের পর্যটন দপ্তর এবং নেপালের এজেন্সিগুলির মুখোশ খুলে পড়বে।
ঠিক যেমন বাংলার বেশ কিছু বিখ্যাত পর্বতারোহীরা মুখ খোলেন না পুরুলিয়া জেলার বেড়ো পাহাড় কেটে পাথর বের করে নেওয়ার ব্যাবসায়িক চক্রান্ত রুখতে। প্রয়োজন মনে করেন না পাহাড় বাঁচানোর আন্দোলনে যাঁরা নেমেছেন তাঁদের পাশে এসে দাঁড়াবার। বরং সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলে নিজেদের রেকর্ডকে আরও উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যান। নিজেদের নিরাপদে রেখে পরিবেশ ও পাহাড়কে বিপদে ফেলেন। চেষ্টা করেন বাংলার পর্বতপ্রেমীদের মধ্যে বিভেদ জিইয়ে রাখতে।
তাইতো এই দশক এতগুলি মৃত্যু দেখলেও, কারও সময় হয়না সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে বসে মর্মান্তিক সমস্যাটার সমাধান খোঁজার। সুতরাং, ছন্দা গায়েন থেকে দীপঙ্কর ঘোষ, নেপালে বাংলার পর্বতারোহীদের মৃত্যু মিছিল চলছে। চলবে আগামী দিনেও।