
আজ তিন দিন হল রিলির গলা শোনা যাচ্ছে না
অথচ কুরোস পরিবারের বাড়িতে লাইট জ্বলছে সারারাত, সারাদিন। চিন্তিত হয়েই পুলিশকে ফোন করেন অলিভিয়া। একই সময়ে পুলিশকে ফোন করেন রিলিদের এক আত্মীয়। তিনিও ফোনে রিলির বাবা মা’কে পাচ্ছেন না আজ তিনদিন ধরে।
দিনটি ছিল গত মাসের ( এপ্রিল,২০১৯) ১৪ তারিখ। সকাল ৯ টার সময়ে একজন পুলিশ আসেন, তিনি বাড়িটির চারদিকে ঘুরে। সন্দেহজনক কিছু দেখতে না পেয়ে ফিরে যান। কিন্তু অলিভিয়া আর জেমস ১০ এপ্রিল ডেভিড আর মিহোকোর ঝগড়ার আওয়াজ পেয়েছিলেন।
তার পর থেকে কুরোস পরিবার থেকে একটিও আওয়াজ ভেসে আসেনি। পুলিশ চলে যাওয়ার পর রিলিদের সেই আত্মীয় আসেন তালা ভাঙার লোককে নিয়ে। রিলিদের আত্মীয়দের দেখে ভরসা পেয়ে নিজেদের অ্যাপার্ট্মেন্ট থেকে নেমে আসেন অলিভিয়া আর জেমস রবিনসন দম্পতিও।
তালা ভেঙে ঘরে ঢোকেন সবাই
বাড়িতে ঢুকে একতলায় দেখতে পান চার বছরের রিলিকে। দেওয়ালে পিঠ দিয়ে বসে আছে। নিজেরই করা প্রস্রাবের মধ্যে। লোক দেখে দেখে মুখ তুলে তাকায় রিলি। ভাবলেশহীন দৃষ্টি, ভীষণ ক্লান্ত লাগে তাকে। অলিভিয়া দৌড়ে যান রিলির দিকে। কোলে তুলে নেন ছোট্ট রিলিকে।
-মা বাবা কোথায় রিলি?
– বাবা আর মা ওপরে ঘুমাচ্ছে, ওরা আহত।
অলিভিয়ার পায়ের তলায় মাটি কেঁপে ওঠে। সবাই বুঝতে পারেন ভয়ঙ্কর কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। দৌড়ে বাড়ির দোতলায় যান সবাই। পাশাপাশি দু’টি ঘর। সবাই আগে ঢোকেন ডেভিড আর মিহোকোর শোবার ঘরে। গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে যান। খাটের ওপর গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছেন ডেভিড কুরোস (৪৬) এবং মিহোকো কুরোস (৩৮)। ডেভিডের পাশে পড়ে আছে একটি রিভল্ভার। দেহগুলিতে পচন শুরু হয়েছে। এর অর্থ কয়েক দিন আগেই তাঁদের মৃত্যু হয়েছে।
অলিভিয়া এবার দৌড়ে পাশের ঘরে ঢোকেন। সেখানে ছোট্ট খাটে শুয়ে দুই মাসের রিচার্ড। প্রস্রাব ও মলে মাখামাখি। কিন্তু জীবিত। মাঝে মাঝে জিভ বের করে ঠোঁট চাটছে রিচার্ড। বারবার মাথা এদিক ওদিক ঘোরাচ্ছে। অলিভিয়ার চিৎকারে তাঁর স্বামী জেমস চলে আসেন। কোলে তুলে নেন রিচার্ডকে।
পুলিশে খবর দেওয়া হয়
পুলিশ আসার আগে রিলি আর রিচার্ডকে নিয়ে নিজের বাড়িতে চলে যান আর এক প্রতিবেশী টনি মেদিনা। তিনি ও অন্য প্রতিবেশীরা রিলি আর তার ভাইয়ের প্রাথমিক শুশ্রুষা আর খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। দু’টি শিশুই প্রচন্ড ক্ষুধার্ত ছিল। শরীরে দেখা দিয়েছিল জলাভাব। ছোট্ট রিচার্ডকে স্তনপান করান এক প্রতিবেশী মহিলা। মা ভেবে তাঁকে আঁকড়ে ধরে দুমাসের রিচার্ড। মহিলার চোখ বেয়ে নামে জল।
পুলিশ আসে, এবং ঘটনাস্থল পরীক্ষা করে জানায়, সম্ভবত স্ত্রী মিহোকোকে খুন করে নিজে আত্মঘাতী হয়েছেন ডেভিড। দু’টি মৃত্যুর পিছনে কারণ হতে পারে পারিবারিক অশান্তি। কারণ টনি মেদিনাকে ছোট্ট রিলি বলেছিল, সে দেখেছিল মাকে কান্নায় ভেঙে পড়তে। পুলিশেরও মতে, খুন ও আত্মহত্যার ঘটনাটি ঘটেছে কয়েকদিন আগেই।
এই ক’দিন বা মায়ের মৃতদেহের সাথে বাড়িতে বন্দী ছিল চার বছরের রিলি আর দু’মাসের রিচার্ড। না খেয়ে তারা কীভাবে বেঁচে রইল, ভয়ে বা আতঙ্কে কেন গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ল না, সেটাই অবাক করল লস অ্যাঞ্জেলস পুলিশ ডিপার্টমেন্ট ও শিশু কল্যাণ দপ্তরের অফিসারদের।
এরকম ঘটনা ঘটলে, সাধারণ ক্ষেত্রে বাচ্চারা কান্নাকাটি করে, চিৎকার করে ডাকে বাইরের লোককে। কিন্তু রিলি বড্ড ছোট, খুব ভালো করে কথা বলতে শেখেনি। তাছাড়া তার উচ্চতায় জানলার কাছে পৌঁছাতে পারেনি হয়ত। বা এই পরিস্থিতিতে কী করতে হবে তা বুঝতে পারেনি। যেমন রিলি বুঝতে পারেনি তার বাবা মা মারা গেছে। ভেবেছিল ঘুমিয়ে আছে। উঠে খাবার দেবে ভাইকে আর তাকে।
তদন্ত শুরু করে হতবাক হয়ে গিয়েছিল লস অ্যাঞ্জেলস পুলিশ
সম্ভবত চার বছরের ছোট্ট রিলির বুদ্ধিমত্তায় ও আপ্রাণ বাঁচার চেষ্টায় সে ও তার ভাই বেঁচে গেছিল। মৃত্যুর আগে রিলির মা কয়েকটি বোতলে ছোট্ট রিচার্ডের জন্য খাবার তৈরি করেছিলেন। সারা দিন ধরে খাওয়াবেন বলে। যখনই ভাই খিদেয় কেঁদেছিল, মায়ের তৈরি করে রাখা তরল খাবার দুমাসের ভাইটির মুখে ধরেছিল রিলি। কিন্তু বোতলের খাবারও সম্ভবত এক দুদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। নিজে না খেয়ে ভাইকে পুরো বোতলের খাবার খাইয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করে গেছে।
ভাইয়ের খাবার শেষ হয়ে গেলে, ছোট্ট রিলি কল থেকে জল বোতলে ভরার চেষ্টা করেছিল। বেসিনে হাত পৌঁছায়নি, টুল নিয়ে এসে বেসিনে ওঠবার চেষ্টা করেছিল রিলি। সারা ঘর খুঁজে খুঁজে, ফ্রিজ থেকে খাবার বার করেছিল রিলি। প্যাকেটজাত খাবার। কিন্তু প্যাকেটগুলো সে খুলতে পারেনি।
অনাহারে ক্রমশ অবসন্ন হয়েছে রিলি, তবুও খিদের জ্বালায় কাঁদতে থাকা ভাইকে ভোলাবার জন্য, তার খেলনা নিয়ে গেছে ওপরে ভাইয়ের ঘরে। অপেক্ষা করেছে, কখন তার বাবা মায়ের ঘুম ভাঙবে। কিন্তু সে জানত না তারা তিনদিন আগেই অনাথ হয়ে গেছে। তারপর, দিন গেছে এসেছে রাত, রাত গেছে, এসেছে দিন। এ ভাবেই কেটে গেছে তিনদিন। ছোট্ট রিলি নানা ভাবে তার দু’মাসের ভাইকে বাঁচাবার আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে গেছে।
ছোট্ট রিলি ও তার দু’মাসের ভাই এখন সম্পুর্ণ সুস্থ
লস অ্যাঞ্জেলসের শিশু কল্যাণ দপ্তরের পরিচর্যায় আছে রিলি আর রিচার্ড। তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের দায়িত্ব নিয়েছে শিশু কল্যাণ দপ্তর। অনাথ রিলি আর রিচার্ড এখন সেলিব্রেটি। ছোট্ট মেয়ে রিলির সাহসিকতার কথা এখন সারা আমেরিকার মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে। বিশ্বের নামিদামি সংবাদমাধ্যম হন্যে হয়ে ঘুরছে তাদের ছবি তোলার জন্য। রিলির সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু সে বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক ও কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে লস অ্যাঞ্জেলসের শিশু কল্যাণ দপ্তর। শিশুদুটির কোনও ছবি বাইরে আসুক তারা চায় না।
লস অ্যাঞ্জেলস পুলিশের প্রেস কনফারেন্সে, আমেরিকাবাসীর মনের কথা বলেছেন ক্যাপ্টেন মৌরিন রায়ান, “লিটল অ্যাঞ্জেল রিলি ও মিরাকল বেবি রিচার্ড, সারা আমেরিকার গর্ব। যে ভাবে চার বছরের ছোট্ট রিলি তার দুমাসের ভাইকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, তার পুরো কাহিনি আমরা এখনও না জানতে পারলেও, যা আমাদের অনুমান,তা এক কথায় অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয়, তার জন্যই আজ দেশবাসী ছোট্ট মেয়েটিকে স্যালুট জানাচ্ছে, সেই আজ সত্যিকারের হিরো।”