Rabindranath & Korczak
শেষ আপডেট: 16th April 2025 12:54
সাল ১৯৪২। জুলাই মাসের কথা বলছি।
পোল্যান্ড তখন পাকাপাকিভাবে জার্মানির দখলে। নাৎসি বাহিনী শুরু করেছে ইহুদি-নিধন-যজ্ঞ। হিটলারের নির্দেশ: আগামি এক বছরের মধ্যে দেশের ৩৫ লাখ ইহুদিকে সাফ করে দিতে হবে। গুলি চালিয়ে নয়। ছোরা কুপিয়ে নয়। খেতে না দিয়ে। অনাহারে, রোগে ভুগে যেন মৃত্যু হয় তাদের। তার জন্য চালান করো কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। সেখানেও প্রাণে বেঁচে যাবে যারা, তাদের অন্তিম ঠিকানা গ্যাস চেম্বার। এই ছিল হিটলারের ইহুদি সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান।
সেই সময় পোল্যান্ডের ওয়ারশ অঞ্চলে অনাথাশ্রম চালাতেন এক ভদ্রলোক: ইয়ানুশ কোরচাক। ভাল নাম: হাইনরিখ গোল্ডস্মিথ। জাতিতে ইহুদি৷ ওয়ারশতেই বেড়ে ওঠা। ঘটনাবহুল, নাটকীয় জীবন। বাবা জোসেফ গোল্ডস্মিথ নেশায় ইতিহাস লিখিয়ে, পেশায় কৌঁসুলি। কোরচাক ছাত্রাবস্থায় বাবাকে হারান। এরপর প্রথমে ঠিক করেন ডাক্তার হবেন। মানুষের প্রাণ বাঁচাবেন। তারপর ‘আন্তন চেকভ যদি চিকিৎসক হয়েও সাহিত্যসেবা করতে পারেন, তাহলে আমিও পারব'—ভেবে লেখালিখি শুরু। লিখে ফেলেন ‘চিলড্রেন অব দ্য স্ট্রিট’ এবং ‘দ্য চাইল্ড অব দ্য ড্রইং রুম’ নামে দুটি উপন্যাস। তারপর অবৈতনিক চিকিৎসক, স্বেচ্ছাশ্রম, সাংবাদিকতা, সেনাবাহিনীর বাধ্যতামূলক চাকরির পালা চুকিয়ে এতিমখানার দায়িত্বগ্রহণ।
বিয়াল্লিশের নরমেধযজ্ঞের আঁচ পড়েছিল সেই অনাথাশ্রমেও। ১৯৫ জন ফুটফুটে শিশু সমেত কোরচাককে ওয়ারশতেই তৈরি হওয়া একটি ইহুদি ঘেটোয় চালান করা হয়। নামেই ঘেটো। আসলে জেলখানা। চারদিকে মোতায়েন সশস্ত্র সেনা৷ চারবেলা কড়া প্রহরা। আকছার বিনা বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হচ্ছে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে। বাদ যাচ্ছে না শিশুরাও৷ একটাই অপরাধ: তারা ইহুদি৷ শত অত্যাচারের পরেও যারা বেঁচে থাকবে তাদের বছরের মাঝামাঝি সময় পাঠানো হবে ট্রেবলিঙ্কার মৃত্যুকূপে।
শেষের সেদিন দুঃসহ। জানতেন কোরচাক। শিয়রে শমন দাঁড়িয়ে। অথচ অনাথ ছেলেমেয়েরা কিছুই বুঝতে পারছে না, জানতে চাইছে না। কিন্তু যদি জেনে যায়? বুঝে যায়? নিশ্চিত মৃত্যু আর কয়েক সপ্তাহ বাদেই ঘনিয়ে আসবে—এই বোধ যদি বিষাক্ত কুঁড়ির মতো জন্ম নেয় মনে?
ভাবামাত্র কোরচাকের সর্বাঙ্গে শিহরণ খেলে। শিশুদের সর্বক্ষণ ব্যস্ত রাখতে চাইতেন তিনি। শুধু শিশু কেন, ওই ঘেটোর সক্কলের জন্য আলাদা আলাদা কাজ ও দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছিলেন। নিজে ডায়েরি লিখতেন। আর সবাইকে লেখার উৎসাহ জোগাতেন। খেলাধুলো, গানবাজনার আয়োজন তো ছিলই।
এই সবকিছু আগের অনাথাশ্রমেও প্রচলিত ছিল। কিন্তু তখন তা বিনোদন আর শিক্ষাদানের কথা মাথায় রেখে করা হত। ঘেটোতে এসে সুরুচির অভ্যাসগুলি আসন্ন মৃত্যু থেকে নজর ঘোরানোর কাজে লাগান কোরচাক। চাইতেন ফুলের মতো সুন্দর শিশুরা ব্যস্ত থাকুক। শেষের ক'দিন তাদের মন খুঁজে নিক আনন্দ আর প্রশান্তি… সুর থেকে, ছবি থেকে, গল্প থেকে৷ যেন নজর এড়িয়ে যায় হত্যালীলার আতঙ্ক, হাড়হিম মৃত্যুভয়ের শ্বদন্ত।
কিন্তু এভাবে বেশিদিন টানা সম্ভব ছিল না। ক্রমশ প্রকট হয়ে ওঠে গোলাবারুদের গন্ধ, মেশিনগানের গর্জন। এদিকে সময়ও এগিয়ে আসতে থাকে। ঘেটো ছেড়ে যেতে হবে। গন্তব্য ট্রেবলিঙ্কার মৃত্যুকূপ… গ্যাসচেম্বার। আর ফিরে আসা, প্রাণে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়৷
এই সময় অনাথ শিশুরা যাতে মৃত্যুকে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে শান্ত-সমাহিত চিত্তে গ্রহণ করতে পারে, তার চিন্তাভাবনা চালান কোরচাক। এর জন্য তিনি একটি নাটক মঞ্চায়নের পরিকল্পনা নেন৷ নাম ‘পোচতা’। অনুবাদ নাটক। মূল রচনার লেখক প্রাচ্যের এক ঋষিকল্প সাহিত্যিক। সেই নাটকে তিনি মৃত্যুপথযাত্রী এক অনাথ কিশোরের কথা বলেছেন। অসুস্থ, রুগ্ণ সে কিশোর। কিন্তু মন সতত সজীব৷ ঘরের চারদেয়ালে বন্দি সে। বাইরে যাওয়া মানা৷ কবিরাজমশাইয়ের নিদান: শরতের সোনালি রোদ, সকালের শীতল হাওয়া গায়ে লাগানো যাবে না। তাহলে মৃত্যু নিশ্চিত।
ঘরবন্দি বাচ্চা ছেলেটি তবু শাসন মানে না। সে মনে মনে উড়ে বেড়ায়। জানলা খুলে কখনও দইওয়ালা, কখনও ছেলের দল, কখনও বা ভিখিরির সঙ্গে বন্ধুত্ব জমায়। পাড়ি দেয় অচিন গাঁয়ে, অজানা দেশে৷ আর রাজার চিঠি আসার অপেক্ষা করে, দিন গোনে। সেই চিঠিই তাকে মুক্তি দেবে।
মৃত্যুকে প্রসন্নমনে বরণের কথা বলা হয়েছে ওই নাটকে। যা কোরচাককে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি নিজেও ছেলেবেলায় আত্মহত্যাপ্রবণ ছিলেন। কাজ করেছেন শিশু হাসপাতালে। দেখেছেন কীভাবে মরণের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন প্রগলভ ছেলেও নিমেষে পরিণত, স্থিতধী, প্রাজ্ঞ হয়ে ওঠে। সেই অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিগত অনুভূতি মিলিয়ে নিজেও উপন্যাস লিখেছেন।
প্রাচ্যের এক সাহিত্যিকের ওই নাটক, যার পোলিশ অনুবাদ ‘পোচতা’, তার সঙ্গে এই সমস্তকিছুর ভাবসাযুজ্য খুঁজে পান কোরচাক৷ আর সিদ্ধান্ত নেন ঘেটোর শিশুদের দিয়ে এর মঞ্চায়ন করবেন। নাটকের সেই অনাথ শিশুর যন্ত্রণা, একাকিত্ব ও মৃত্যুকে পরমবন্ধুর মতো গ্রহণের সঙ্গে ঘেটোর শিশুরাও আত্মীয়তা অনুভব করবে।
এদিকে ততদিনে অন্তিম সময়ও মাপা পায়ে এগিয়ে আসছে। তাই দেরি না করে রিহার্সালে নেমে পড়েন কোরচাক। সঙ্গী হিসেবে পান তাঁর একদা ছাত্রী এস্তেরকা ভিনোগ্রনকে। সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে কোরচাক, পরিচালনায় ভিনোগ্রন। নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য বেছে নেওয়া হয় আব্রোসা নামে এক কিশোরকে৷ একমনে চুপচাপ ভায়োলিন বাজিয়ে যেত আব্রোসা৷ আর করুণ রাগিণীর সুর ঘেটোর পাঁচিল ডিঙিয়ে সমস্ত চরাচরে ছড়িয়ে পড়ত।
খুব অল্প সময়ে সড়গড় হয়ে ওঠে শিশুরা। নাটকের বেদনা আর প্রশান্তি দুইয়ের সঙ্গেই নিবিড় বন্ধন খুঁজে পায়। রিহার্সাল যখন শেষ, মঞ্চায়নের দিনক্ষণও স্থির, তখন নিজের হাতে এর আমন্ত্রণপত্র লেখেন কোরচাক। যেখানে বলা ছিল: ‘দিতে পারব না এমন কোনো কিছুর প্রতিশ্রুতি দেওয়া আমাদের অভ্যাসে নেই। আমরা বিশ্বাস করি এক ঘণ্টার এই নাটক—যার লেখক একাধারে দার্শনিক ও কবি—তার অভিনয় আপনাদের সমস্ত দিক দিয়ে সমৃদ্ধ করবে।’
১৪ জুলাই, বিকেল ৪টের সময় নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার কথা। কিন্তু তার আগের দিন হঠাৎ সমস্যা দেখা দেয়। নাটকের কলাকুশলীদের প্রত্যেকে পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। চিকিৎসক আসেন। ওষুধ দেন। তারপর ধীরে ধীরে সুস্থ হয় সকলে৷ যতটুকু ক্লান্তি ছিল, ধকল ছিল, পরের দিন বিকেলে স্টেজে ওঠার পর সেটুকুও উবে যায়৷ নাটক সফলভাবে অভিনীত হয়।
কোরচাক ডায়েরি লিখতেন ঠিকই। কিন্তু এদিন বা এই সময়ের বিবরণ তিনি জানিয়ে যাননি। ওয়ারশর ঘেটোয় সেই নাটকের অভিনয় ও তার প্রতিক্রিয়া বলে গেছেন এক প্রত্যক্ষদর্শী। ইরিনা সেন্দেলরোভা। নাৎসিদের হাত থেকে তিনি শেষমেশ রেহাই পান৷ পরে তাঁর ঘেটোজীবনের অভিজ্ঞতা প্রকাশিত হয়। ইরিনা লিখেছেন: ‘জানালার বাইরে কী ঘটছে, তা থেকে শিশুদের দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে কোরচাক সেই নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন। কোমলহৃদয় এই ডাক্তার জানতেন কী ভয়াবহ দুর্যোগ এইসব শিশুর জন্য অপেক্ষা করছে। তিনি এমন একটি নাটক বেছে নিয়েছিলেন যার মূল বাণীই ছিল ‘আশাবাদ’। নাটকের শেষে আমরা দেখি রাজার সেই চিঠি, যেখানে শিশুদের মুক্ত, স্বাধীন এক নতুন দুনিয়ায় নিয়ে যাওয়ার আহ্বান করা হয়েছে। এক অসাধারণ শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক শিশুদের সঙ্গে আসন্নপ্রায় নির্মম অভিজ্ঞতার এক দূরত্ব তৈরি করতে চেয়েছিলেন। গ্যাসচেম্বারে মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু তার আগে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আনন্দময় অভিজ্ঞতা উপহার দেওয়াই ছিল তাঁর লক্ষ্য।’
আর অভিনয়শেষের প্রতিক্রিয়া? ইরিনার কথায়, ‘নাটক শেষ হলে পুরো হলঘরে গভীর নীরবতা নেমে আসে। সকলে নিঃশব্দ। বুঝতে পারছিলাম, ছোট্ট শিশু থেকে অশীতিপর বৃদ্ধ—সবাই তাদের দুর্মর জীবন থেকে মুক্তির আলোর খোঁজ পেয়েছে। হলঘরে বসা প্রতিটি মানুষের দেহে-মনে ক্ষণকালের জন্য এই ঘেটোর বাইরে এক মুক্ত জীবনের আলো-হাওয়া ছুঁয়ে যায়।’
৬ আগস্ট। সকালবেলা। সবেমাত্র জলখাবার শেষ। এমন সময় নাৎসি বাহিনীর ভারী বুটের আওয়াজে কেঁপে ওঠে ঘেটোর এমাথা থেকে ওমাথা। ধ্বনিত হয় নির্দেশ: সমস্ত ইহুদি বেরিয়ে এসো।
কথার অমান্য করেননি, কোনও অনুনয়-বিনয়ও জানাননি ইয়ানুশ কোরচাক। প্রায় দুশো জন শিশুকে জামাকাপড় পরিয়ে, সাজগোজ করিয়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। প্রায় এক মাইল দীর্ঘ পদযাত্রা। তারপর ট্রেন। গন্তব্য ট্রেবলিঙ্কা। ১৯৫ জন শিশু কোরচাকের পিছনে সার বেঁধে দাঁড়ায়৷ তারপর পায়ে পা মিলিয়ে চলতে থাকে। কারও হাতে খেলনা, কারও হাতে ডায়েরি, প্রিয় পুতুল।
ইরিনা সেন্দেরলোভা কোরচাক ও তাঁর আশ্রমের শিশুদের প্রায় নিঃশব্দে চলে যেতে দেখেছিলেন। লিখেছেন, ‘সেই শবমিছিলের শিরোভাগে ছিলেন কোরচাক। সবচেয়ে ছোট ছেলেটি তাঁর কোলে, অন্য আরেকজনের হাত তাঁর হাতে। যে যা-ই বলুক, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, নিশ্চিত মৃত্যুর কথা তিনি জানতেন, জানত মিছিলের শিশুরাও। অনাথ আশ্রম থেকে উমশ্লাগপ্লাজ–বন্দিদের যেখানে জড়ো হওয়ার নির্দেশ ছিল–প্রায় এক মাইল যাত্রাপথ। আমি নিজ চোখে দেখলাম জেলেঞ্জা সড়ক থেকে লেজনো সড়কে দলটি মোড় নিল।’
কোরচাক মিথ্যে প্রবোধ দেননি। দিলে তিনি সেই নাটকটি মঞ্চস্থ করতেন না। হয়তো তিনি জানিয়েছিলেন তাঁরা এমন একটি দুনিয়ায় চলেছেন, যেখানে ভরপুর পাইন আর বার্চ গাছ রয়েছে। যার ডালপালা রঙিন পাতায় মোড়া, সুগন্ধি ফুলে ভরা। যার তলায় খুনসুটি করে কাঠবেড়ালি। ছুটে বেড়ায় খরগোশছানা।
কোরচাক কী ভেবেছিলেন, কী ভেবেছিল আব্রোসা নামে ওই বেহালাবাদক কিশোর, আজ জানার উপায় নেই। কিন্তু নিজেদের দিনলিপিতে নিজেদের শেষ স্বপ্ন, সেই মঞ্চস্থ নাটকের নাম লিখে গেছেন ইউনিশ কোরচাক। আশাবাদে ভরপুর নাটকটি ছিল ‘ডাকঘর’। রবীন্দ্রনাথের লেখা এই নাটক পোলিশ ভাষায় প্রথম অনূদিত হয় ১৯১৯ সালে। অনুবাদক লাওরা কানোপনিকা-পিতলিন্সকায়া। তিন বছর পর, ১৯২২ সালে ইয়ান সুর একই গ্রন্থের আরও একটি তর্জমা প্রকাশ করেন।
‘ডাকঘরে’র অমল রাজার চিঠি হাতে পেয়েছিল। দেখতে পেত, ‘রাজার ডাক-হরকরা পাহাড়ের উপর থেকে একলা কেবলই নেমে আসছে—বাঁ হাতে তার লণ্ঠন, কাঁধে তার চিঠির থলি… নদীর ধারে জোয়ারির খেত, তারই সরু গলির ভেতর দিয়ে দিয়ে সে কেবল আসছে—’
ওয়ারশর ঘেটোয় মৃত্যুপথযাত্রী শিশুদের ডাকহরকরা হয়ে উঠেছিলেন কোরচাক৷ কাঁধ থলিভরা রাজার চিঠি। মৃত্যুকে এড়িয়ে যায়নি শিশুর দল৷ রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ তাদের অমৃতের স্বাদ এনে দিয়েছিল।