ক্ষীরপাইয়ের 'বাবরশা'
শেষ আপডেট: 4 May 2025 18:01
চন্দ্রকোণা ব্লকের সদর শহর ক্ষীরপাই। ১৭৯৮ সালে বর্ধমান জেলা থেকে ভাগ করে একে মেদিনীপুরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। ১৮৪৫ সালে ফের হুগলি জেলায় অন্তর্ভুক্তি। গড়ে ওঠে তিনটি নতুন মহকুমা: চুঁচুড়া, শ্রীরামপুর ও ক্ষীরপাই। পরে এই অঞ্চল আরেকবার মেদিনীপুরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। ১৮৭৪ সালে লাভ করে পুরসভার স্বীকৃতি।
প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বারবার এ জেলা-সে জেলা ঘুরপাক খেয়েছে প্রাচীন জনপদ ক্ষীরপাই৷ একইভাবে আন্দোলিত হয়েছে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও। ১৭৭৩ সালে আছড়ে পড়ে সন্ন্যাসী আক্রমণের ঢেউ। তার রেশ কাটতে না কাটতে চুয়াড় বিদ্রোহ। যার সূচনা হয়েছিল ক্ষীরপাই থেকে।
এই দুই বিদ্রোহের আগে আরও একটি ঐতিহাসিক ঘটনায় কেঁপে ওঠে ক্ষীরপাইয়ের মাটি। বলা ভাল, বিপর্যস্ত হয়। কিন্তু সেই পরাক্রমী বিদেশি আক্রমণ, ইতিহাসে যা ‘বর্গি হানা’ নামে স্মরণীয়, তা ক্ষীরপাইকে সবদিক দিয়ে বিধ্বস্ত করলেও এরই সূত্রে জন্ম নেয় এক নতুন সংস্কৃতি: মিষ্টান্ন সংস্কৃতি। প্রায় আড়াইশো বছরেরও বেশি পুরোনো ‘বাবরশা’, যা একান্তভাবে ক্ষীরপাইয়ের আঞ্চলিক ও লোকজ মিষ্টি, তার সূত্রপাতের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে বর্গি আক্রমণ।
আঠারো শতকের কথা। বাংলায় তখন নবাদ আলিবর্দি খাঁর রাজত্ব। সেই সময় মারাঠা সাম্রাজ্যের নজর পড়ে বঙ্গদেশে। ধনসম্পদ, শস্যফসলে এই অঞ্চল তখন সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠেছে। সেই বিত্ত লুঠ করতে মারাঠার মহারাজ রঘুজি ভোঁসলে ও তাঁর সেনাপতিরা বাংলা আক্রমণ করে। একবার নয়, একাধিকবার। ইতিহাসমতে, ১৭৪২ সাল থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ন'বছর ধরে বঙ্গদেশ লুঠ করতে মারাঠি সৈনিকেরা হানাদারি আক্রমণ চালায়। কিন্তু প্রতিবার সেই উদ্দেশ্য বানচাল করেন নবাব আলিবর্দি খাঁ। ব্যর্থ হয় মারাঠার বাংলা লুণ্ঠনের স্বপ্ন। তবু এই অবিরত আক্রমণ, যা মানুষের মুখে মুখে ‘বর্গির হাঙ্গামা’ বলে পরিচিত, তার জেরে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলার জনসাধারণ ও গ্রামীণ অর্থনীতি।
ক্ষীরপাইও তার ব্যতিক্রম নয়। একসময় তাঁত ও রেশমশিল্পে এই অঞ্চল ব্যাপক উন্নতি করে। সারা দেশে এখানকার বস্ত্রবয়নের সুনাম ছড়ায়। গড়ে ওঠে অর্থবান বণিক ও সম্পন্ন তাঁতিদের জনবসতি। যার ফলে বিদেশি ইংরেজ ও ফরাসি ব্যবসায়ীরাও এখানে কুঠি স্থাপনে উদ্যোগ নেয়। স্বাভাবিকভাবে সম্পদ হরণের লোভে আকৃষ্ট হয় মারাঠি বর্গিরাও।
১৭৪০-৫০-এর মধ্যে কোনও একটি সময়ে ক্ষীরপাই আক্রমণ করে তারা। শ্যামদেব নামে একটি জায়গায় শিবির বানায়। আর অকাতরে লুঠতরাজ শুরু করে। প্রাণ বাঁচাতে ভিটেমাটি ছেড়ে পালাতে থাকে ভীতসন্ত্রস্ত সাধারণ গ্রামবাসী। এই সময় তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ান, না কোনও স্থানীয় ভূস্বামী বা জমিদার নন, একজন ইংরেজ কুঠিয়াল। নাম এডওয়ার্ড বাবর্শ। জড়ো করেন সাধারণ মানুষদের। তারপর তাঁদের নেতৃত্ব দিয়ে গড়ে তোলেন প্রতিরোধ। সংঘর্ষ বাঁধে। হার মানে মারাঠিরা। বাধ্য হয় পিছু হটতে৷ এরপর আর কোনওদিন ক্ষীরপাই আক্রমণের সাহস দেখায়নি বর্গিরা।
বিপদমুক্ত জেনে ধীরে ধীরে ঘরে ফেরে গ্রামবাসী। আর ধন্যবাদ জানায় এডওয়ার্ড সাহেবকে। এই সময় তাঁর বীরত্ব ও মহানুভবতাকে সম্মান জানিয়ে পরাণ আটা নামে এক স্থানীয় মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটি মিষ্টি প্রস্তুত করেন। ময়দা, ঘি এবং চিনি দিয়ে বানানো সুদৃশ্য সেই মিষ্টান্নের নাম দেন ‘বাবরশা’। ইংরেজ কুঠিয়ালের নামাঙ্কিত মিষ্টিটির সুখ্যাতি ক্ষীরপাই ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে আশপাশের অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, অনেকে এর সঙ্গে নাম-সাদৃশ্যে মুঘল সম্রাট আকবরের যোগ খুঁজে বের করলেও তার কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।
চটজলদি পরিকল্পনার ফসল বলেই হয়তো বাবরশার উপকরণে বাহুল্য নেই। ময়দা আর ঘি-ই প্রধান বস্তু। সঙ্গে লাগে লোহার ছাঁচ। প্রথমে ময়দা ঘি দিয়ে মেখে জলে গুলে বানানো হয় খামি। তারপর কড়াইয়ে ঘি গরম করে লোহার ছাঁচকে তাতে ডোবানো হয়। এরপর এক হাতে খামি নিয়ে ময়দা ও ঘিয়ের মিশ্রণ বিন্দু বিন্দু আকারে ফেলে যেতে হয় ঘিয়ের উপর জেগে থাকা ছাঁচের উপর। বিশেষ কৌশলে এই কাজটি করা জরুরি। যাতে খামির মিশ্রণ গরম ঘিয়ে পড়া মাত্র ফোঁটা ফোঁটা আকারে পরস্পর যুক্ত থাকে, আলাদা হয়ে না যায়। এভাবে লোহার ছাঁচ সম্পূর্ণ ভর্তি হলে তার রং বাদামি না হওয়া পর্যন্ত ভেজে যেতে হয়। এরফলে একটা সময় পর কড়াইয়ে ভাজা সম্পূর্ণ অংশটিও ছাঁচের অনুরূপ আকৃতি ধারণ করে।
সবশেষে ঘিয়ে ভাজা জিনিসটি তুলে রাখতে হয় একটি পাত্রে। তারপর কিছুটা ঠান্ডা হলে উপর থেকে মধু বা চিনির রস ছড়িয়ে দেওয়ার পালা। এভাবেই প্রস্তুত হয় ‘বাবরশা’। দেখতে ঠিক রাজস্থানের প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন ‘ঘেবড়ে’র মতো। খেতে মুচমুচে, সুস্বাদু।
ক্ষীরপাইয়ের অনেক দোকানে বাবরশা বিখ্যাত। তার মধ্যে রয়েছে চৌকানের আদি শাসমল সুইটস ও হালদারদিঘি মোড়ের সুধা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। বিগত সময়ের সুপ্রাচীন মহিমা, বর্গি হানার মতো ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক, ব্রিটিশ সংযোগ বাবরশার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী মিশে রয়েছে। তবু বিষ্ণুপুরের মোতিচুর কিংবা বর্ধমানের সীতাভোগ-মিহিদানার মতো কৌলীন্য অর্জন করেনি এই মিষ্টান্ন। ক্ষীরপাই এবং তৎসংলগ্ন চন্দ্রকোণা, ঘাটালে বিক্রি হলেও পুরো বাংলায় এর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েনি। এ আবহেই জিআই ট্যাগের দাবি জানিয়েছেন ক্ষীরপাইয়ের বাবরশা প্রস্তুতকারী হালুইকরেরা। সেটাই কি যথেষ্ট? একটা ট্যাগেই কি ‘আঞ্চলিকতা’র খোলস ছেড়ে ‘গ্লোবালে’র পথে হেঁটে যাবে এই মিষ্টান্ন? বাবরশার ভবিষ্যৎ নিয়ে দানা বাঁধছে প্রশ্ন।