Latest News

Anuradha Koirala: নেপালের মাদার টেরিজা, ১২ হাজার মহিলা-শিশুর পাচার রুখেছেন যে মা

চৈতালী চক্রবর্তী

‘আমাদের মেয়েদের বিক্রি করা (Women Trafficking) বন্ধ করুন’…সত্তরোর্ধ্ব এক মহিলার দৃপ্ত কণ্ঠে কেঁপে গিয়েছিল গোটা অডিটোরিয়াম। মুখে পড়ন্ত বেলার তেজ, দু’চোখে যেন আগুন জ্বলছে। বয়সের ভার মনের সাহসকে দমাতে পারেনি। ১২ হাজার নারী ও শিশু পাচার রুখেছেন যে মহিলা (Anuradha Koirala), তিনি সবেতেই অকুতোভয়। সীমান্তে পাচার হয়ে যেতে বসা কিশোরীদের উদ্ধার করে এনেছেন। পাচারচক্রের পান্ডাদের অস্ত্রের সামনে একা দাঁড়িয়েছেন দুর্গার মতো। মায়ের মতো বুক দিয়ে আগলেছেন যৌনপল্লী থেকে পালিয়ে আসা মেয়েদের। ‘বেশ্যা’ বলে যাদের দাগিয়ে দিয়েছিল সমাজ, তাদের জীবনের মূলস্রোতে ফেরাতে এই মা লড়াই করেছেন দীর্ঘ ২০ বছর।

নেপালের মাদার টেরিজা (Mother Teresa) বলা হয় তাঁকে। অনাথদের কাছে তিনি দিজ্জু (বড় দিদি) । মাদার অ্যাগনেস টেরিজা (Mother Teresa) সেন্ট ছিলেন। কিন্তু এই মা সেন্ট নন। তবুও মাদারের মতোই তিনি যেন সন্তাপগ্রস্ত মানুষের জুড়িয়ে যাওয়া প্রাণের প্রতীক। অনুরাধা কৈরালা (Anuradha Koirala)—নারী-শিশু নির্যাতন (Child Abuse), বর্বরতার বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছেন নিঃস্বার্থভাবে।

Anuradha Koirala, Who Rescued Over 12,000 Women From Sex Trafficking, To Be Awarded Padma Shri

মারধর করতেন স্বামী (Anuradha Koirala), রোজ রাতে ধর্ষিতা হতেন, গর্ভপাত হয়েছিল তিনবার

 

জীবনের অন্ধকার দিক যিনি দেখেন তিনিই মনে হয় লড়াই করার প্রেরণা পান স্বঃস্ফূর্তভাবেই। অনুরাধা কৈরালাও তেমনই একজন মানুষ। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস পেয়েছেন নিজে অত্যাচারিত হতে হতেই। মেয়েদের যন্ত্রণা (Women Trafficking) অনুভব করেছেন শিরায় উপশিরায়। কর্নেল প্রতাপ সিং গুরুঙ্গ ও লক্ষ্মীদেবীর আদরের মেয়ে অনুরাধার বিবাহিত জীবন সুখের ছিল না। চরম শারীরিক নির্যাতন সইতে হয়েছে। রোজ রাতে ধর্ষিতা হতে হত। মারধর এমন চরম সীমায় পৌঁছেছিল যে তিনবার গর্ভপাত হয়ে যায় অনুরাধার। শেষবার গর্ভের সন্তান হারিয়ে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের বিচ্ছেদ করেন অনুরাধা। তখন তিনি ধীরস্থির, মুখ বুঝে সব সহ্য করে নেওয়া গৃহবধূ নন, সন্তান হারানো এক মা যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শিখে গিয়েছেন। প্রথমবার ঘর ছেড়ে অনন্ত আকাশের নীচে এক পা রাখেন এক তেজস্বিনী (Anuradha Koirala)।

Anuradha Koirala

Anuradha Koirala

ভারত-নেপাল সীমান্তে পাচারকারীদের বন্দুকের সামনে একা এক তেজস্বিনী (Anuradha Koirala)

সব হারিয়েছেন। কিন্তু মাদার টেরিজার (Mother Teresa) অনুপ্রেরণা ভোলেননি। কালিম্পংয়ের সেন্ট জোসেফ কনভেন্ট স্কুলের ছাত্রী মাদার টেরিজার আদর্শেই অনুপ্রাণিত ছিলেন। স্কুলের মাদার ও সিস্টারদের নীতি মেনে চলেছেন সব সময়ে। তাই জীবন ও মানবতা সম্পর্কে তাঁর আদর্শ ছিল ব্যতিক্রমী। আর এই আদর্শই তাঁকে এক নতুন পথের দিশা দেখায়।

Trafficking has nothing to do with poverty'

অনুরাধা দেখেন এলাকার ঝুড়িগুলিতে পয়সার জন্য কিশোরী মেয়েদের বেচে দিচ্ছেন (Women Trafficking) মা-বাবারা। পয়সা দিয়ে বাচ্চা মেয়েদের কিনে নিয়ে যাচ্ছে দালালরা। হয় তাদের পাচার করে দেওয়া হচ্ছে অন্য দেশ বা রাজ্যে অথবা সদ্য ফোটা কুঁড়িগুলির জায়গা হচ্ছে কোনও অন্ধকার যৌনপল্লীর স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে। প্রতিদিন তাদের শরীর ছিঁড়েখুঁড়ে নিচ্ছে (Child Abuse) হিংস্র শ্বাপদরা। নিজে অত্যাচার ভোগ করেছিলেন অনুরাধা তাই এই যন্ত্রণার সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছিলেন।

মেয়েদের পাচার বন্ধ করার জন্য শুরু করেছিলেন লড়াই। ঘরের মেয়েকে বিক্রি করে দেওয়া যে বর্বরতার পরিচয় তা তিনি বোঝাতে শুরু করেন প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে। শোনা যায়, গরিব ঘরগুলিতে গিয়ে তিনি নিজে টাকা দিয়ে তাদের স্বনির্ভর করার চেষ্টা করতেন। শুরুতে তেমন সাড়া মেলেনি। একজন একা মহিলার ডাকে সাড়া দিতে রাজি হননি অনেকেই। তথাকথিত সমাজপতিরা আবার বাঁকা চোখেও দেখেছিলেন। বাধা আসতে শুরু করেছিল প্রতিটা পদক্ষেপে।

অনুরাধা বুঝেছিলেন (Anuradha Koirala), গরিব, পিছিয়ে পড়া, অন্ধবিশ্বাসে ঘেরাটোপে থাকা লোকজনকে বোঝাতে হলে নিজেকে ঠেলে দিতে হবে বিপদের মধ্যে। পাচারচক্রের পান্ডারা কোথায় ঘুরঘুর করছে, কোন এলাকা দিয়ে মেয়েদের পাচার (Women Trafficking) করা হচ্ছে তার খবর রাখতেন অনুরাধা। একবার নিজে একা চলে গিয়েছিলেন ভারত-নেপাল সীমান্তে। রাতের বেলা সেখানে কয়েকজন কিশোরী মেয়েকে সীমান্ত পার করে নিয়ে যাচ্ছিল পাচারকারীরা। গর্জে উঠেছিলেন অনুরাধা। অপরাধীদের বন্দুকের সামনে একা দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। খবর পেয়ে পুলিশ পৌঁছেছিল যথা সময়। উদ্ধার করা হয়েছিল চারজন কিশোরীকে। তাদের নিজের কাছেই আশ্রয় দিয়েছিলেন অনুরাধা।

Anuradha Koirala

মায়ের বাড়ি’ (Maiti Nepal)— অবহেলিত নারী, শিশুদের আনন্দ-আশ্রম

সেই শুরু। নাম ছড়াতে শুরু করে অনুরাধা কৈরালার। এতদিন যাঁরা তাঁর লড়াইকে বাঁকা চোখে দেখতেন তাঁদের চোখেও সম্ভ্রম ফুটে ওঠে। অনুরাধা বোঝেন তাঁর লড়াইকে সার্বিক রূপ দিতে হলে সংগঠন তৈরি করতে হবে। তাই করেন। সেটা ১৯৯৩ সাল। তৈরি হয় ‘মাইতি নেপাল’ (Maiti Nepal)। নারী নির্যাতন, গার্হস্থ্য হিংসা, শিশু পাচার রুখতে লড়াই শুরু করে অনুরাধার মাইতি নেপাল।

আরও পড়ুন: Child Rights: ১৪০০ নাবালিকা বিয়ে রুখেছেন, নারী পাচার, শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়ছেন ‘ভারত কি বেটি’

Anuradha Koirala
অনুরাধা কৈরালার ‘মাইতি নেপাল’

ছোট ছোট কয়েকটা ঘর নিয়েই শুরু করেন অনুরাধা। পাচারকারীদের কবল থেকে উদ্ধার পাওয়া মেয়েদের রাখতেন এখানে। গার্হস্থ্য হিংসার শিকার এমন মহিলারাও ঠাঁই পেতেন এই মায়ের কাছে। আস্তাকুঁড় থেকে কুড়িয়ে আনা অনাথদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হত অনুরাধার (Anuradha Koirala) মাইতি নেপাল। মাইতি মানে হল ‘মায়ের বাড়ি’। মায়ের মতোই আগলে রাখতেন অনুরাধা।

Anuradha Koirala
‘সিএনএন হিরো অব দ্য ইয়ার’ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন ২০১০ সালে

১৯৯৩ থেকে ২০১১ সাল অবধি ১২ হাজার মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছে এই আশ্রম। তাদের কেউ যৌনপল্লী থেকে পালিয়ে এসেছেন, কেউ পাচার হতে হতেও উদ্ধার পেয়েছেন, কেউ স্বামীর অত্যাচারে ঘর ছেড়েছেন আবার কেউ ধর্ষিতা হয়ে সমাজে একঘরে হয়েছেন। শোনা যায়, কম বয়সে যৌনপল্লীর আঁধারে হারিয়ে যাওয়া মেয়েদেরও উদ্ধার করে নিয়ে আসতেন অনুরাধা। তাদের মানসিক চিকিৎসাও করতেন। অনুরাধা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যৌনপল্লী বা পাচারকারীদের থেকে উদ্ধার করে যে মেয়েদের নিয়ে আসা হত তারা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ত। এমন এক ট্রমা গ্রাস করত মেয়েদের যে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বাঁচার ইচ্ছাই হারিয়ে যেত। সেই অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসাই লক্ষ্য ছিল তাঁর।

Anuradha Koirala

রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে পদ্মশ্রী নিচ্ছেন অনুরাধা কৈরালা২০১০ সালে আমেরিকার সরকার বিপুল অঙ্কের টাকা অনুদান দেয় মাইতি নেপালকে। নারী ও শিশু পাচার রুখতে অনুরাধা কৈরালার (Anuradha Koirala) লড়াইকে স্বীকৃতি দেয় অনেক দেশই। ৩৮টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন অনুরাধা। ১৯৯৮ সালে বছরের সেরা সমাজকর্মীর সম্মান পান, পরের বছর প্রবাল গোর্খা দক্ষিণ বাহু মেডেলে সম্মানিত করা হয় তাঁকে। ২০০২ সালে পেয়েছিলেন ত্রিশক্তিপত্ত অ্যাওয়ার্ড, ২০০৬ সালে ফিস অ্যাবে ফাউন্ডেশনের তরফে দ্য কারেজ অব কনসায়েন্স অ্যাওয়ার্ড, পরের বছর জার্মান ইউনিফেম অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন অনুরাধা।

তাঁর কর্মকাণ্ডের মতোই পুরস্কারের তালিকাটাও দীর্ঘ। ক্যালিফোর্নিয়ায় সিএনএন হিরো অ্যাওয়ার্ড ২০১০ পাওয়ার চার বছরের মাথাতেই মাদার টেরিজা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন অনুরাধা। ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে পদ্মশ্রী পুরস্কার নিয়েছিলেন অনুরাধা কৈরালা।

অত্যাচার, অবিচারের মধ্যে গিয়ে ওই প্রান্তিক মানুষগুলোর জীবনযাত্রাকে ছোঁয়া—এমন নিদর্শন খুব কমই দেখা যায়। কিছু মানুষ আছেন যাঁরা ব্যক্তিগত লাভক্ষতির হিসেব করেন না। অনুরাধা কৈরালা তেমনই একজন। ভাবেননি, তাঁর এই কাজের মাধ্যমে সমাজ কতটা পাল্টাবে। !  হিংসা বাড়ছে। বাড়ছে নিষ্ঠুরতা। আর এরই মধ্যে নীরব বিপ্লব করে চলেছেন এক মা।

You might also like