
রূপাঞ্জন গোস্বামী
‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ নামটা শুনলেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে, ঘন নীল আটলান্টিক সমুদ্রের মাঝে ভেসে থাকা সবুজে ঘেরা দ্বীপমালা। রঙবেরঙের পোশাক পরা প্রাণখোলা নারী পুরুষ। ক্যালিপসো সংগীতের মূর্ছনা। আগুন গরম ‘রাম’ ও সবুজ মাঠের বুক চিরে উল্কাগতিতে ছুটে আসা লাল টুকটুকে ডিউজ বল।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাস কিন্তু এতটা সুন্দর নয়। ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস ওয়েস্ট ইন্ডিজ আবিষ্কার করার পর, প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল উপনিবেশবাদী দেশগুলি। নানা ভাষা, নানা ধর্ম, সাংস্কৃতিক বৈষম্য, বর্ণবৈষম্য, জাতিগত সংকীর্ণতা ও আঞ্চলিক প্রভুত্ববাদে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের সমাজ ব্যবস্থা। তাই কোনও দিন দেশ হিসেবে এক হতে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১৩টি স্বাধীন দেশ ও ১৮টি উপনিবেশে ভেঙে গিয়েছিল।
ওয়েস্ট ইন্ডিজকে একমাত্র দেখা যায় বাইশ গজে। তাতেই বিশ্বত্রাস হয়ে উঠেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে যা লেখা আছে সোনার জলে। কিন্তু বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে লেখা নেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের একটি মর্মান্তিক অধ্যায়। যা আজও ভুলতে চায় এই দেশ, ভুলতে চায় ক্রিকেট বিশ্ব।
কিংসটনের এঁদো বস্তির হিলটন
আমেরিকা থেকে প্রায় ৬২০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে, আটলান্টিকের মাঝে অবস্থিত ওয়েস্ট ইন্ডিজের অন্যতম সুন্দর দ্বীপ জামাইকা। ঘন সবুজ অরণ্য, পাহাড় ও সোনালি বালির সৈকত দিয়ে ঘেরা জামাইকার রাজধানী কিংসটন। সেই শহরের এক এঁদো বস্তিতে, ১৯০৫ সালে জন্ম হয়েছিল লেসলি হিলটনের। সীমাহীন দারিদ্রের পটভূমিকায় বস্তির একটি ঘরে সন্তানদের নিয়ে গাদাগাদি করে থাকতেন হিলটনের মা ও তাঁর বিবাহবিচ্ছিন্না বোন।
মাত্র তিন বছর বয়সে হিলটন হারিয়েছিলেন মাকে। হিলটন জানতেন না, কে তাঁর বাবা। মায়ের স্নেহ দিয়ে দিদিই মানুষ করছিলেন ভাই লেসলিকে। কয়েক বছর পর লেসলি হারিয়েছিলেন তাঁর দিদিকেও। পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মাসি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে কয়েক বছর পর মাসিকেও হারিয়ে ফেলে সম্পুর্ণ অনাথ হয়ে গিয়েছিলেন সদ্য কিশোর হিলটন। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পড়াশোনা।
শুরু হয়েছিল বাঁচার লড়াই
সারাদিন খাবারের সন্ধানে ঘুরতেন বিভিন্ন চার্চে। স্থানীয় নাপিতের দোকানে চুল দাড়ি কাটার কাজ শিখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু অনাথ কিশোরের মন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ আটলান্টিক মহাসাগরের মতোই উত্তাল। কোনও কাজে মন বসাতে পারতেন না। নাপিতের সহকারীর কাজ ছেড়ে হিলটন হয়ে গিয়েছিলেন কিংসটন বন্দরের শ্রমিক।
বিকেল হলেই নারকেলের ডাল দিয়ে তৈরি ব্যাট ও টেনিস বল নিয়ে হিলটন নেমে পড়তেন সমুদ্র সৈকতে। বালির ওপর পড়লে বলের গতিবেগ কমে যায়, তাই আপ্রাণ জোরে বল করার চেষ্টা করতেন হিলটন। ব্যাট করার সময় বল উড়িয়ে দিতেন শূন্যে। যাতে বেশি দূরে গিয়ে পড়ে।
বলের দুরন্ত গতির জন্য একদিন হিলটনের ডাক পড়েছিল অভিজাতদের ক্রিকেট ক্লাবে। উইলো কাঠের ক্রিকেট ব্যাট ও ডিউজ বলের লোভে বালির সৈকত ছেড়ে হিলটন গিয়েছিলেন পিচ তৈরি করা ক্রিকেট মাঠে। দেখেছিলেন সেখানে ব্যাট করার সুযোগ মেলে শ্বেতাঙ্গ ও ধনী কৃষ্ণাঙ্গদের।
গরিব কৃষ্ণাঙ্গদের দিয়ে বল করানো হয়। ক্রিকেটেও বৈষম্যের আঁচ পেয়ে বলের মাধ্যমে ক্ষোভের আগুন ঝরাতেন সদ্যযুবক হিলটন। ব্যাটসম্যানদের শরীর লক্ষ্য করে কামানের গোলার মত ছুটে আসত হিলটনের বল। দু’দিকেই বল ঘোরাতে পারতেন, একটানা নিঁখুত ইয়র্কার দিয়ে যেতে পারতেন। বেশিরভাগ ব্যাটসম্যানই সামলাতে পারতেন না হিলটনকে। ব্যাট একবার হাতে পেলে তাঁর আনন্দ মাত্রা ছাড়াত। বোলারদের পিটিয়ে ছাতু করে দিতেন দশাসই চেহারার হিলটন।
সফল হয়েও মেলেনি স্বীকৃতি
অলরাউন্ডার হিসেবে হিলটনের নাম ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছিল জামাইকায়। ক্লাব ও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে জামাইকা দেখেছিল তাঁর খুনে মেজাজের বোলিং আর ঝোড়ো ব্যাটিং। জামাইকা দলের নিয়মিত সদস্য হয়ে গিয়েছিলেন হিলটন। ঊনবিংশ শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দল তৈরি হলেও, প্রথম টেস্ট খেলেছিল ১৯২৮ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে।
সাগরপারে বল হাতে যখন আগুন ঝরাতেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের লিয়েরি কনস্টানটাইন, জর্জ নাথানিয়াল ফ্রান্সিস ও হার্মান ক্লেরেন্স গ্রিফিথরা, সমুদ্রের ধারে মন খারাপ করে বসে থাকতেন হিলটন। তাঁর মনে হত, সমাজে প্রান্তিক হয়ে জন্মানোর মাসুল দিচ্ছেন তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে জামাইকার তিনজন ক্রিকেটার ছিলেন, যার মধ্যে ছিলেন দলের ক্যাপ্টেন পর্তুগিজ বংশদ্ভুত রবার্ট কার্ল নুনেজ। শুধু ছিলেন না গরিব ও পিতৃপরিচয়হীন হিলটন।
তবে সব অন্যায়েরই বুঝি শেষ আছে
১৯৩৫ সালে সফরকারী ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলার জন্য টেস্ট টিমে জায়গা পেয়েছিলেন তিরিশ বছরের হিলটন। যে বয়সে ফাস্টবোলাররা ফুরিয়ে যেতে শুরু করেন, সেই বয়সে ইংল্যান্ডের হার্বার্ট সাটক্লিফ, ওয়ালি হ্যামণ্ড ও মরিস লেল্যান্ডের মত দুর্ধর্ষ ব্যাটসম্যানদের যথেষ্ট বেগ দিয়েছিলেন হিলটন।
সিরিজে ১৩টি উইকেট নিয়েছিলেন হিলটন, গড়ে ১৯.৩০ রান দিয়ে। সেরা বোলিং, ৮ রানে ৩ উইকেট। এর মধ্যে ছিল ওয়ালি হ্যামন্ডের মতো ক্রিকেটারের উইকেটও। লিয়েরি কনস্টানটাইন, মানি মার্টিনডেল ও লেসলি হিলটনের আগুনে বোলিং-এর জন্যই চার ম্যাচের টেস্ট সিরিজ জিতে নিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ইংল্যান্ডের ক্যাপ্টেন বব উইয়াট বলে গিয়েছিলেন, পৃথিবীর সেরা বোলিং সাইডকে সামলাতে হয়েছিল তাঁদের।
এরপর প্রায় চার বছর টেস্ট খেলেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১৯৩৯ সালে হিলটন আবার সুযোগ পেয়েছিলেন তিন টেস্টের ইংল্যান্ড সফরে। কিন্তু যখন ১৫ জনের নাম ঘোষিত হল, দেখা গেল বাদ গিয়েছেন হিলটন। জামাইকায় শুরু হয়েছিল তুমুল বিক্ষোভ। হিলটনকে আবার দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু মানসিক অশান্তিতে ফর্ম হারিয়ে ফেলেছিলেন ৩৪ বছর বয়সী ফাস্টবোলার। দুটি টেস্ট খেলার পর বাদ পড়েছিলেন দল থেকে। দেশে ফিরে অবসর নিয়েছিলেন হিলটন। ৬টি টেস্টে ৭০ রান ও ১৬টি উইকেট, ৪০টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ৮৪৩ রান ও ১২০টি উইকেট এবং ৩১টি ক্যাচ নেওয়ার পর ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন হিলটন।
জীবনে এসেছিল একমাত্র প্রেম
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হওয়ার সুবাদে অবসরের পর হিলটন চাকরি পেয়ে গিয়েছিলেন জামাইকার পুনর্বাসন দফতরে। ১৯৪০ সালে একটি পার্টিতে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল পুলিশ অফিসারের উচ্চাকাঙ্খী কন্যা লুরলাইন রোজের। জাতীয় হিরোর প্রেমে পড়তে সময় লাগেনি লুরলাইনের।
কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে হিলটন ছিলেন লুরলাইনের অনেক নীচে। তাই প্রচণ্ড বাধা এসেছিল লুরলাইনের পরিবার থেকে। কিন্তু সমস্ত বাধা অগ্রাহ্য করে ১৯৪২ সালে বিয়ে করেছিলেন হিলটন ও লুরলাইন। পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনে সেই প্রথম ভালোবাসার স্বাদ পেয়েছিলেন হিলটন। তাই উজাড় করে ভালবেসেছিলেন লুরলাইনকে।
বিয়ের পাঁচ বছর পর জন্ম নিয়েছিল তাঁদের পুত্র সন্তান। সন্তানের বয়স যখন মাত্র তিন বছর, তখন একটি অদ্ভুত কাজ করে বসেছিলেন লুরলাইন। ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার জন্য শিশু সন্তানকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন নিউইয়র্ক। শেষে সন্তানকে নিয়ে হিলটন চলে গিয়েছিলেন লুরলাইনদের প্রাসাদোপম বাড়িতে।
শ্বশুর মারা গিয়েছিলেন, কিন্তু শাশুড়ি পছন্দ করতেন না পিতৃপরিচয়হীন হিলটনকে। তবুও হিলটন সব মেনে নিয়েছিলেন বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে। বিকেলে অফিস থেকে ফিরে সদ্য কথা বলতে শেখা ছেলেকে নিয়ে চলে যেতেন বাগানে। সেখানে ছেলের সঙ্গে কথা বলতেন প্রাণভরে। বাবার বেশিরভাগ কথাই ছেলে বুঝত না। তবে এটা বুঝত বাবা তাকে খুব ভালোবাসে।এভাবেই কেটে গিয়েছিল তিন তিনটে বছর।
জীবন দিয়েছিল চরম আঘাত
১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি একটি উড়ো চিঠি এসেছিল নিউইয়র্ক থেকে। চিঠিতে লেখা ছিল,”আপনার স্ত্রী লুরলাইন, নিউইয়র্কের কুখ্যাত রোমিও রয় ফ্রান্সিসের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন।” প্রথমে বিশ্বাস করেননি হিলটন। বার বার পড়েছিলেন চিঠিটা। তারপর আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন নিউইয়র্কে। দ্রুত ফিরে আসতে বলেছিলেন লুরলাইনকে। নিউইয়র্ক থেকে এসেছিল টেলিগ্রাম,” চিন্তা কোরো না, সব ঠিক আছে, ভালবাসা নিও।”
মে মাসের ২ তারিখে জ্যামাইকা ফিরে এসেছিলেন লুরলাইন। তার একদিন আগে রিভলভারের বেশ কিছু গুলি কিনেছিলেন হিলটন। নিজের ও পরিবারের সুরক্ষার জন্য রিভলবার আগে থেকেই ছিল তাঁর কাছে। লুরলাইন বাড়িতে ফেরার পর শুরু হয়েছিল তর্কবিতর্ক। লুরলাইন অস্বীকার করেছিলেন রয় ফ্রান্সিসের সঙ্গে তাঁর অবৈধ প্রেমের কথা। বলেছিলেন দু’জনের মধ্যে মৌখিক আলাপ ছাড়া অন্য কিছু নেই। ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের জগতে সবার সঙ্গে আলাপ রাখাটা বাধ্যতামূলক। সহজ সরল হিলটন বিশ্বাস করেছিলেন শিক্ষিতা স্ত্রী লুরলাইনের কথা। আবার শুরু হয়েছিল দু’জনের একসঙ্গে থাকা। বাবা ও মাকে আবার একসঙ্গে কাছে পেয়েছিল শিশুপুত্রটি।
৫ মে, ১৯৫৪
বাইরে আন্তরিকতা দেখালেও কিন্তু হিলটনের মন জুড়ে ছিল সন্দেহ। লুরলাইন ফিরে আসার মাত্র তিনদিন পর, ৫ মে হিলটন জানতে পেরেছিলেন, বাড়ির মালির হাত দিয়ে লুরলাইন একটি চিঠি পোস্ট করতে পাঠিয়েছে। হিলটনের মনে হয়েছিল চিঠিটি লুরলাইন পাঠাচ্ছেন ফ্রান্সিসকে। হিলটন পৌঁছে গিয়েছিলেন পোস্ট-অফিসে। দেখতে চেয়েছিলেন চিঠিটি। পোস্ট-অফিস জানিয়েছিল স্ত্রীর চিঠি হলেও আইনত তা হিলটনকে দেখানো সম্ভব নয়।
বাড়ি ফিরেই চিঠির সত্যতা জানতে লুরলাইনকে চেপে ধরেছিলেন হিলটন। ইচ্ছে করেই নিয়েছিলেন মিথ্যার আশ্রয়। বলেছিলেন, তিনি খবর পেয়েছেন চিঠিটি ফ্রান্সিসকে পাঠানো হচ্ছে। পোস্ট-অফিস থেকে তাঁকে বলা হয়েছে, দুপুরে গিয়ে চিঠিটি পড়ে আসতে। এইসব শুনে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে গিয়েছিলেন লুরলাইন। তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানোর জন্য অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন স্বামীকে।
হিলটনের পিতৃপরিচয় না থাকা, বস্তিতে বাস করা, শিক্ষাহীনতা, এমনকি ত্বকের বর্ণ নিয়েও কটুক্তি করেছিলেন লুরলাইন। বলেছিলেন বিয়ের আগে বাবা মায়ের কথা শুনলে ভাল করতেন। হিলটনের মত নিচু সামাজিক মর্যাদার কোনও ব্যাক্তিকে বিয়ে করা লুরলাইনের উচিত হয়নি।
উত্তেজিত লুরলাইন বলেছিলেন, “হ্যাঁ আমি আমার ভালবাসার মানুষকে খুঁজে পেয়েছি। আমার প্রেমের রাস্তায় তুমি বাধা দাঁড়াতে পারবে না। আমি ফ্রান্সিসের সঙ্গে শুয়েছি। আমার শরীর কেবলমাত্র তারই জন্য।” এরপর শুরু হয়েছিল দু’জনের মধ্যে ধস্তাধস্তি। হিলটনের কথা অনুযায়ী এরপর লুরলাইনের হাতে উঠে এসেছিল হিলটনেরই গুলি ভরা রিভলভার। যেটি ছিল শোবার ঘরেরই ড্রয়ারে।
হিলটনকে গুলি করেছিলেন লুরলাইন। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল গুলিটি। প্রাণ বাঁচাতে লুরলাইনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন হিলটন। লুরলাইনের হাত থেকে রিভলভার কেড়ে নিয়ে তাঁর শরীর লক্ষ্য করে পর পর গুলি চালিয়ে দিয়েছিলেন। কার্পেটের ওপর লুটিয়ে পড়েছিলেন লুরলাইন। রক্তে ভেসে গিয়েছিল কার্পেট। ছুটে এসেছিলেন বাড়ির সকলে। ঘটনার আকস্মিকতায় অ্যাম্বুল্যান্স বা পুলিশকে খবর দেওয়ার কথা কারও মনে পড়েনি। ফোন করে পুলিশকে ডেকেছিলেন হিলটনই।
শুরু হয়েছিল বিচার
বেশ কয়েকমাস জেলে থাকার পর, ১৯৫৪ সালের অক্টোবর মাসে হিলটনের বিচার শুরু হয়েছিল। তাঁর হয়ে মামলাটি লড়ছিলেন জামাইকার সব থেকে নামী ব্যারিস্টার ভিভিয়ান ব্লেক। হিলটনের আইনজীবী ছিলেন নোয়েল নেদারসোল। যিনি তিরিশের দশকে জামাইকার ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন, যাঁর নেতৃত্বে খেলেছিলেন হিলটনও। সেই সময় সারা ওয়েস্ট ইন্ডিজে সাড়া ফেলে দিয়েছিল ‘লুরলাইন মার্ডার’ মামলাটি। বিচারের দিনগুলিতে আদালতের বাইরে জড়ো হতেন ক্রিকেটার হিলটনের ভক্তরা। সমর্থন জানাতেন স্লোগান দিয়ে। একসময় যেমনটি তাঁরা করতেন গ্যালারি থেকে।
হিলটনের আইনজীবীদের তরফে আদালতকে বলা হয়েছিল, লুরলাইনই প্রথমে অপমান ও আক্রমণ করেছিলেন হিলটনকে। প্রাণ বাঁচাতে হিলটন গুলি করেছিলেন। তাতেই প্রাণ হারান লুরলাইন। সুতরাং এই হত্যা অনিচ্ছাকৃত। হিলটনের আইনজীবীরা আদালতে পেশ করেছিলেন সেই চিঠি, যার জন্য ঘটেছিল এই হত্যা। চিঠিটি লুরলাইন লিখেছিলেন প্রেমিক ফ্রান্সিসকেই। চিঠির ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পেয়েহিল ফ্রান্সিসের প্রতি লুরলাইনের অন্ধ প্রেম। প্রকাশ পেয়েছিল স্বামী হিলটনের প্রতি লুরলাইনের তীব্র ঘৃণা ও অবজ্ঞা।
কিন্তু প্রতিপক্ষের আইনজীবীরা আদালতকে বলেছিলেন লুরলাইনের শরীরে থাকা গুলির সংখ্যার কথা। মোট সাতটি গুলি বিঁধেছিল লুরলাইনের দেহে। এর অর্থ, রিভলভারের প্রথম গুলিটি যদি লুরলাইন ছুঁড়েও থাকেন, ম্যাগাজিনের বাকি পাঁচটি গুলি ছুঁড়েছিলেন হিলটন। পাঁচটি গুলি করার পরও ক্ষান্ত হননি হিলটন। খালি হয়ে যাওয়া ম্যাগাজিনে আবার গুলি ভরে, তীব্র আক্রোশে সেদিনের সপ্তম ও অষ্টম গুলিটিও ছুঁড়েছিলেন মৃত লুরলাইনের শরীর লক্ষ্য করে।
আদালতে হিলটন স্বীকার করেছিলেন ম্যাগাজিনে গুলি ভরার কথা। আদালতকে তিনি বলেছিলেন, আত্মহত্যা করার উদ্দেশ্যেই তিনি রিভলভারে গুলি ভরেছিলেন। শিশুপুত্রের কারণেই আত্মহত্যা করতে পারেননি। কিন্তু আদালতকে জবাব দিতে পারেননি, কেন তিনি লুরলাইনকে লক্ষ্য করে সেদিনের সপ্তম ও অষ্টম গুলিটি ছুঁড়েছিলেন।
বিচারকেরা শুনিয়েছিলেন রায়
বিচারপর্ব সমাপ্ত হয়েছিল ১৯৫৪ সালের ২০ অক্টোবর। স্ত্রীকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট ক্রিকেটার লেসলি হিলটনকে। রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করেছিলেন হিলটন। সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছিল আদালত। হিলটনের আইনজীবীরা লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে আবেদনের অনুমতি চেয়েছিলেন। সে আবেদনও খারিজ হয়ে গিয়েছিল।
আইনজীবীদের অনুরোধে, শেষ চেষ্টা হিসেবে জামাইকার গভর্নর স্যার হগ ফুটের কাছে মার্জনা ভিক্ষা করেছিলেন হিলটন। ১৯৫৫ সালের ৯ মে, সেই আবেদনও খারিজ হয়ে গিয়েছিল। জেল কতৃপক্ষের কাছে নির্দেশ গিয়েছিল, ১৭ মে সকালে হিলটনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে।
ফাঁসির আগের কয়েকদিন, হিলটনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রোমান ক্যাথলিক চার্চে। তাঁকে দেওয়া হয়েছিল বাইবেল। জেলের নির্জন প্রান্তে থাকা ডেথ সেলে সারাদিন বাইবেলে ডুবে থাকতেন জ্যামাইকার বিখ্যাত ফাস্টবোলার লেসলি হিলটন। যাঁর সম্পর্কে বিখ্যাত ক্রিকেট সমালোচক ও লেখক নেভিল কার্ডাস বলেছিলেন, “Hylton is unmistakably a good bowler, possibly more than good”।
ফাঁসির আগের দিন
হিলটনের ফাঁসির আগের দিন, অর্থাৎ ১৬মে, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বার্বাডোজে টেস্ট ম্যাচ খেলছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেই দলে থাকা জামাইকার ক্রিকেটার হল্ট বার বার ক্যাচ মিস করছিলেন। ধারাভাষ্যকার টনি কোজিয়ার মজা করে বলেছিলেন “Hang Holt, Save Hylton”। ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন দর্শকরা। তাঁদের হাতে উঠে এসেছিল ‘পৈশাচিক রসবোধ’ লেখা ব্যানার।
এই দিন বিকেলে হিলটনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তাঁর ১৯৩৯ সালের টিমমেট স্টলমেয়ার। যাঁকে দলে নেওয়ার জন্য বাদ দেওয়া হয়েছিল হিলটনকে। হিলটনের সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটিয়েছিলেন স্টলমেয়ার। বেরিয়ে এসে বলেছিলেন, সাদা গাউন পরা হিলটনকে দেখতে পাদ্রিদের মতো লাগছিল।
নির্লিপ্ত ছিলেন শেষ মুহূর্তেও
দিন গড়িয়ে রাত নেমেছিল জামাইকার সেন্ট ক্যাথরিন জেলা কারাগারে। ডেথ সেলের মধ্যে বাইবেলে ডুবেছিলেন হিলটন। পাশে পড়েছিল রাতের খাবার। জেলের বাইরে মাঝরাতে হাজির হয়েছিলেন হাজার হাজার ভক্ত। ওয়েস্ট ইন্ডিজের শোষিত, নিপীড়িত মানুষদের কাছে হিলটন ছিলেন সংগ্রাম ও সাফল্যের প্রতীক। তাই তাঁদের হিরোর জীবনের অন্তিমলগ্নেও পাশে থাকতে চেয়েছিলেন তাঁরা।
জেলের চিরাচরিত প্রথা মেনে ১৭ তারিখ ভোরে, ফাঁসির একঘণ্টা আগে হিলটনকে দেওয়া হয়েছিল প্রাতরাশ। স্মিত হেসে ফিরিয়ে দেয়েছিলেন হিলটন। শান্তভাবে চরম মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। জেলার এসে ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই মাথা উঁচু করে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়েছিলেন ফাঁসির মঞ্চের দিকে। ঠিক সেইভাবে, যেভাবে বল হাতে হেঁটে যেতেন বোলিং মার্কে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন, অত্যন্ত নির্লিপ্ত ভাবেই মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন হিলটন। পায়ের তলা থেকে পাটাতন সরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত মাথাটা উঁচুই রেখেছিলেন। তীব্র গণবিক্ষোভের কথা মাথায় রেখে হিলটনের মরদেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল জেলের কম্পাউন্ডের ভেতর থাকা সুবিশাল ‘তাবেবুইয়া’ গাছটির নীচে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হিলটনের সমাধি ঢেকে গিয়েছিল হলুদ সুগন্ধি ফুলে। মাটিতেই হারিয়ে গিয়েছিলেন মাটির মানুষ হিলটন।