
রূপাঞ্জন গোস্বামী
দক্ষিণ ভারতের মহাপরাক্রমশালী দেবতা আয়াপ্পান। দেবাদিদেব মহাদেব ও মোহিনীর (জগৎপালক শ্রী বিষ্ণুর নারীরূপ) সন্তান আয়াপ্পান। তাই তাঁর ভয়ে কাঁপে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল। কারণ তাঁর দেহে একই সঙ্গে বিরাজ করেন হরি এবং হর। মূলত দক্ষিণ ভারতের কেরালায় এই দেবতার আরাধনা করা হয়। কেরালার বসবাসরত অনেক মুসলিম ইসলাম ধর্ম পালনের সঙ্গে সঙ্গে আয়াপ্পানের আরাধনা করেন। আয়াপ্পানের অনেক নাম, সাস্থাভু, হরহরিপুত্রা, মনিকান্তা,সাস্থা এবং ধর্মসাস্থা। মহাপরাক্রমশালী দেবতা আয়াপ্পান পৃথিবীতে বিরাজ করেন দক্ষিণ ভারতের এক সুউচ্চ পাহাড়চূড়ায়, বিশ্বখ্যাত শবরীমালা মন্দিরে। তাঁর অস্ত্র তীর-ধনুক। এবং বাহন বাঘ, ঘোড়া ও হাতি।
পশ্চিমঘাট পর্বতমালা ঢালে, পেরিয়ার টাইগার রিজার্ভের মধ্যে অবস্থিত হিন্দুদের পবিত্র তীর্থ শবরীমালা মন্দির। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তীর্থযাত্রাগুলির মধ্যে একটি হলো ‘শবরীমালা যাত্রা’। প্রায় চার থেকে পাঁচ কোটি মানুষ প্রতিবছর এই মন্দিরের আসেন। আঠারটি পাহাড় ও পুনগাভানম নামক বিপদসংকুল অরণ্য ঘেরা শবরীমালা মন্দিরের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪১৩৩ ফুট।
দক্ষিণ ভারতে এবং বিশ্বের অনেক জায়গায় আয়াপ্পানের মন্দির আছে। কিন্তু লোকবিশ্বাস অনুসারে এই শবরীমালা মন্দির পরশুরামের নিজের হাতে প্রতিষ্ঠা করা পাঁচটি আয়াপ্পানের মন্দিরের একটি। এই পাঁচটি হল, কুলাথুপুঝা মন্দির ( আয়াপ্পান এখানে বালক ) আরইয়ানকাভূ মন্দির (আয়াপ্পান এখানে এখানে ব্রহ্মচারী), আচানকভিল মন্দির (আয়াপ্পান এখানে এখানে গৃহী। সঙ্গে আছেন দুই স্ত্রী পূর্ণ এবং পুশকালা ), শবরীমালা মন্দির ( আয়াপ্পান এখানে বাণপ্রস্থে),পুনমবালামেদু মন্দির (আয়াপ্পান এখানে যোগী)
১২ শতকে পান্ডালাম সাম্রাজ্যের মানিকান্দাম নামে এক যুবরাজ পাহাড়চূড়ায় মন্দিরটি আবিস্কার করেন। শবরীমালা মন্দিরে তপস্যা করেন এবং মোক্ষপ্রাপ্ত হন। মানিকান্দাম কালক্রমে দেবতা আয়াপ্পানের অবতার হয়ে যান। প্রচুর মানুষ তাঁর ভক্ত হয়ে যান। মানিকান্দাম যুবরাজ থাকাকালীন ভাভার নামের এক মুসলিম সেনাপতির সেনাকে তিনি পরাজিত করেছিলেন। সেই ভাভার আয়াপ্পানের অবতার রুপী মানিকান্দামের শিষ্য হয়ে যান। এবং মন্দিরেই থেকে যান। ভাভারের সেনারাও স্বপরিবারে মানিকান্দামের শিষ্য হয়ে যান। শোনা যায় অবতার রুপী মনিকান্দাম, তাঁর সেরা ভক্ত ভাভার কে নিয়ে মন্দির চত্বরে ঘুরে বেড়াতেন সঙ্গে থাকত একপাল বাঘ। একসময় মনিকান্দাম শবরীমালা মন্দিরে বিলীন হয়ে যান। মন্দিরটি আবিস্কার হওয়ার পর প্রায় তিন শতাব্দী পর্যন্ত অগম্য ছিল। তারপর থেকে ভক্তদের শবরীমালা যাত্রা শুরু হয়।
শবরীমালা মন্দিরটি ভারতের অন্যান্য মন্দিরের মতো সারা বছর খোলা থাকে না। শবরীমালা মন্দিরটি কেবল মাত্র কিছু বিশেষ বিশেষ দিনে বা সময়ে ভক্তসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। মণ্ডলাপূজা (১৫ নভেম্বর থেকে ২৬ ডিসেম্বর), মাকারাভিলাক্কু বা মকর সংক্রান্তি (১৪ জানুয়ারি), মহা বিষুভ সংক্রান্তি (১৪ এপ্রিল) এবং প্রত্যেক মালয়ালম মাসের প্রথম পাঁচ দিন।
শবরীমালা মন্দিরে তীর্থ যাত্রার আগে একজন ভক্তকে ৪১ দিনের ব্রত রাখতে হয়। একটি মন্ত্রপুত রুদ্রাক্ষ বা তুলসীর মালা পরে ভক্তরা ব্রত শুরু করেন। এই সময় নিরামিষ ও দুগ্ধজাত খাবার খেতে হয়। এই সময় নারীসঙ্গ নিষিদ্ধ। ক্রোধ সংযম করতে হয়। তীর্থযাত্রা সমাপ্তির আগে হাত পায়ের নখ, দাড়ি-গোঁফ কাটা যায় না। এই সময় ব্রতীরা মানুষদের যতটা সম্ভব সাহায্য করতে চেষ্টা করেন। দিনে দু’বার স্নান করেন। এবং স্থানীয় মন্দিরে যান। ব্রত চলা কালে কালো বা নীল রঙের ব্রতর পোশাক পরেন। শবরীমালা মন্দিরের তীর্থযাত্রীকে রাস্তা ঘাটে দেখলেই চেনা যায়। কারণ তাঁরা কালো নয়তো নীল রঙের পোশাক পরেন। এবং কপালে বিভূতি বা চন্দনের প্রলেপ লাগান। ভক্তরা ব্রতের ৪১ দিন চারপাশের সব বস্তুর মধ্যেই আয়াপ্পানকে দেখেন।
৪১ দিনের ব্রতের শেষে ভক্তরা ঘন জঙ্গল ঘেরা সুপ্রাচীন পাহাড়ি পথে শবরীমালা মন্দিরে পৌঁছন। শবরীমালা মন্দিরের দূরত্ব ইরুমেলি থেকে ৬১ কিমি। বান্দিপেরিয়ার থেকে ১২.৮ কিমি এবং চালাকায়াম থেকে ৮ কিমি। দুর্গম অরণ্যে ভক্তরা ভাবেন দেবতা আয়াপ্পান তাঁদের সঙ্গে পথ চলেন। যাত্রাপথগুলির মধ্যে ইরুমেলি রুটটি সবচেয়ে কষ্টসাধ্য ও পবিত্রতম রুট বলে গণ্য করা হয়।
ইরুমেলি রুটটি আলুধা নদীর ধার থেকে আলুধা পাহাড় হয়ে কারিভিলাম থডুতে এসে পৌঁছয়। এর পর পবিত্র কারিমালা , চেরিয়ানভাট্টোম, ভল্লিয়ানাভাট্টম হয়ে পেরোতে হয় পবিত্র পাম্বা নদী। সেখান থেকে নিলিমালা পর্বত আরোহণ শুরু হয়। গনেশা-বেট্টম, শ্রীরাম-বেট্ট্টপদম, অরুমালা কোট্টাম একে এক পার হয়ে ভক্তকুল দুর্গম শবরীমালা । আজকাল অবশ্য ভক্তরা সরাসরি গাড়িতে পম্বা নদীতে চলে আসেন। এখান থেকে দূর্গম নিলিমালা পর্বত রুটে ট্রেক করে শবরীমালা মন্দিরে পৌঁছন। দুর্গম পথে ব্রতীদের জন্য জরুরি জিনিসপত্রের দোকান ও ওষুধের দোকান আছে। জঙ্গলাকীর্ণ উঁচু চড়াই ভাঙবার সময় তীর্থযাত্রীদে সাহায্য করার জন্য সাহায্যকারী দল থাকেন। বয়স্ক তীর্থযাত্রীদের জন্য কেদার-বদ্রীর মতো ডান্ডির ব্যবস্থা আছে। অবশ্যই অর্থের বিনিময়ে।
ঋতুস্রাব হয় এমন কোনও মহিলা এই মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবেন না। কারণ এখানে দেবতা ব্রহ্মচর্য পালন করছেন। পঞ্চাশোর্ধ মহিলারা মন্দির চত্বরে তাঁদের সন্তানদের অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠান (ছরুনু) করে মন্দিরে প্রবেশধিকার পান। মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশাধিকার নিয়ে কেরালা হাইকোর্টে একটি মামলা হয়। মন্দিরটি চালান ত্রিবাঙ্কুর দেবসোম বোর্ড নামক একটি অছি পরিষদ। পরিষদের প্রধান গোপালকৃষ্ণন বলেছিলেন, “শবরীমালা মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশাধিকার দিলে মন্দির চত্বর ‘যৌন পর্যটন’-এর আখড়া হয়ে যাবে”। প্রবল বিতর্ক শুরু হয় এই মন্তব্যে। ১৯৯১ সালে কেরল হাইকোর্টের বিচারপতি কে পারিপূর্ণাম এবং বিচারপতি কে বালানারায়ণা ত্রিবাঙ্কুর দেবসোম বোর্ডের আবেদন অনুযায়ী শবরীমালা মন্দিরে ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সী মহিলাদের ঢোকা নিষিদ্ধ করেন। এবং মন্দির চত্বরে এই আইন লাগু করার জন্য পুলিশ মোতায়েন করার আদেশ দেন। পরবর্তীকালে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে যায়। সুপ্রিম কোর্ট কেরল হাইকোর্টের রায় পুনর্বিবেচনা করার জন্য মামলাটি গ্রহন করে। শবরীমালা মন্দিরে ঋতুযোগ্য মেয়েদের প্রবেশ অবশ্য এখনও বিচারাধীন। সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতির বেঞ্চ ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে বিষয়টি পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন।
.
সুপ্রিম কোর্ট এই বছর এই মামলাটির রায় ঘোষণা করতে চলেছে। রায়টি হয়তো ঋতুমতী মহিলাদের শবরীমালা মন্দিরে প্রবেশধিকার দিতে চলেছে। কারন সুপ্রিম কোর্ট একটি অন্তবর্তী রায়ে জানিয়েছেন, মহিলাদের সমান সাংবিধানিক ক্ষমতা আছে পাবলিক প্লেসে পুরুষদের সঙ্গে পুজো আরাধনা করার। মহিলাদের সামাজিক জীবনে বাধাদান করে এমন আইন মহিলাদের অধিকারের প্রশ্নে বাধাস্বরূপ। একজন পুরুষ যদি সার্বজনীন আরাধনা স্থলে যেতে পারেন, সেখানে একজন মহিলাও যেতে পারবেন। পুরুষের ক্ষেত্রে যেখানে অনুমতি আছে মহিলাদের ক্ষেত্রেও সেখানে অনুমতি আছে। এবং নারী আর তাঁদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য ভগবানের দান। যদি ভগবানের না হয় তো প্রকৃতির দান। ঋতুস্রাব পুজো বা অন্যান্য কাজের ক্ষেত্রে বাধা কেন হবে?”
কেরলের মহিলারা সুপ্রিম কোর্টের রায় তাঁদের পক্ষে যাওয়ার জন্য যাঁকে ডাকছেন দিনরাত, তিনি হলেন একমেবাদ্বিতীয়ম আয়াপ্পান। যাঁর শবরীমালা মন্দিরে ঢোকার জন্য তাঁদের দরজা বন্ধ আছে আজ অবধি।