
রূপাঞ্জন গোস্বামী
সাউথ-ইস্ট আফ্রিকার দেশ মালাউই-এর দক্ষিণের গ্রামগুলিতে রয়েছে অদ্ভুত অমানবিক ঘৃন্য প্রথা। মেয়েরা ঋতুমতী হলেই এখানকার মেয়েদেরকে একজন পুরুষের সঙ্গে বাধ্যতামূলক ভাবে শারীরিক সংসর্গ করতে হয়। এর বিনিময়ে আবার সেই পুরুষকে টাকাও দিতে হয়। ধর্ষণ তো নয়ই, এটা এখানকার গ্রামগুলোতে এক ধরনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বলে গণ্য করা হয়।
তবে যেকোনো পুরুষের শারীরিক সংসর্গ করা যাবে না। এজন্য সমাজের বাঁধা ধরা লোকও আছে। স্থানীয় ভাষায় এদের বলা হয়, হায়না’। প্রাপ্তবয়স্ক ও মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিগুলি এই প্রথার সুযোগ নিয়ে লাগাতার কুমারী মেয়েদের লাঞ্ছনা করে চলেছে, একই সঙ্গে ঘরে তুলছে পয়সাও। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস, এই প্রথা চলে আসছে হাজার বছর ধরে। বর্তমানে এসব হায়নার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন যৌনরোগ এমনকি এইডসও।
মালাউইয়ের দক্ষিণের জেলা নাসানজেতে একজন কুখ্যাত হায়নার বাস।লোকটির নাম এরিক আনিভা। এলাকার কোনো মেয়ের প্রথমবার ঋতুস্রাব হলেই শারীরিক সংসর্গর জন্য ভাড়া করা হয় তাকে এরিক আনিভাকে।
এমনকি কোনো মহিলার স্বামী মারা গেলেও মৃতদেহ কবর দেওয়ার আগে ওই বিধবা নারীকে একবার বাধ্যতামূলক শারীরিক সংসর্গ করতে হয় আনিভার সঙ্গে। এমনকি ওই নারী তখন গর্ভবতী হলেও।
কোনো মেয়ের প্রথমবার ঋতুস্রাব হওয়ার পর শিশু থেকে তার যৌবনে উপনীত হওয়ার প্রমাণ হিসেবে পরপর তিনদিন মেয়েটিকে শারীরিক সংসর্গ করতে হয় হায়নাদের সাথে। কোনো মেয়ে এই জঘন্য কাজে রাজি না হলে ধরে নেয়া হয়, ওই মেয়েটির পরিবার বা গোষ্ঠী বা গ্রামের জন্য মহামারী অথবা ভয়ংকর কোনো পরিণাম অপেক্ষা করছে।
এই বর্বর প্রথাকে বলা হয়, মেয়েদের ‘শুচিকরণ’। এই গোষ্ঠীর মানুষদের ধারণা, এই প্রথার মধ্য দিয়ে শুদ্ধ হয় কিশোরীরা।
হায়নাদের সঙ্গে শারীরিক সংসর্গ নিয়ে দুই ধরনের প্রথা প্রচলিত আছে মালাউইয়ে। প্রথমবার ঋতুস্রাব হওয়ার পর কিশোরীদের সঙ্গে যে শারীরিক সংসর্গ, তাকে বলা হয় ‘কুসাসা ফুম্বি’। কোনও মহিলার স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীকে সমাধিস্থ করার আগে বিধবাকে ‘শুদ্ধ’ করতে বিধবার সঙ্গে যে শারীরিক সংসর্গ, তাকে বলা হয় ‘কুলোয়া কুফা’ ।
মধ্য বয়স্ক ‘হায়না’ আনিভা গর্ব করে বলে থাকে ‘আমি যাদের সঙ্গে শারীরিক সংসর্গ করেছি তাদের বেশিরভাগই স্কুলে যাওয়া মেয়ে।’ এর মধ্যে কোনও কোনও মেয়ের বয়স ১২ থেকে ১৩। কিন্তু তাদের সঙ্গে শারীরিক সংসর্গ করে আমার ভালো লেগেছে, আমি জানি মেয়েগুলিরও। সব মেয়েই আমাকে তাদের ‘হায়না’ হিসেবে পেয়ে গর্ব বোধ করে। তৃপ্ত মেয়েরা অন্য মেয়েদের বলে, আনিভা হচ্ছে প্রকৃত পুরুষ। আনিভা জানে, কীভাবে একজন নারীকে আনন্দ দিতে হয়।’
আনিভা নিজের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড নিয়ে গর্ব করলেও অনেক মেয়েই জানিয়েছে , তারা নিতান্তই অনিচ্ছায় আনিভার সঙ্গে শারীরিক সংসর্গ করতে বাধ্য হয়েছে। যেমন মারিয়া নামের এক মেয়ে জানিয়েছে, ‘আমার আর কোনো উপায় ছিল না। আমার মা-বাবার কথা ভেবেই আমাকে আনিভার সঙ্গে শারীরিক সংসর্গ করতে হয়েছে। যদি আমি রাজী না হতাম তবে আমার পরিবারের ওপর আক্রমণ করা হতো।’
চল্লিশোর্ধ আনিভার দুটি স্ত্রী এবং পাঁচ সন্তান। এ পর্যন্ত ১০৪ জন কিশোরী ও মহিলার সঙ্গে শারীরিক সংসর্গ করেছেন বলে দাবি আনিভার। ২০১২ সালে এ নিয়ে স্থানীয় পত্রিকায় তদন্তমূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে কিছুদিনের জন্য আনিভার বাজার পড়ে যায়।
আনিভা জানায় তাদের এলাকায় তার মতো মোট ১০ জন হায়না আছে। প্রতিবার শারীরিক সংসর্গ জন্য তাদের রেট চার থেকে সাত ডলার। তবে শুধু শারীরিক সংসর্গই শুদ্ধ হওয়ার পুরো প্রক্রিয়া নয়। এটা এই প্রক্রিয়ার শেষ ধাপ।
এর আগে অন্য অনেক কিছু রিচুয়ালস আছে। প্রথমে গ্রামগুলির কিছু বয়স্কা নারী সদ্য ঋতুমতী হওয়া মেয়েদের জঙ্গলের মধ্যে একটি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। একজন পুরুষকে কীভাবে যৌন আনন্দ দিতে হয় সেখানে মেয়েদের তা বেশ কিছুদিন ধরে শেখানো হয়। শেষ ধাপে মেয়েদের একজন হায়নার সঙ্গে শারীরিক সংসর্গ করতে দেয়া হয়। শুদ্ধ হওয়ার পুরো প্রক্রিয়ার আয়োজন করে মেয়েটিরই পরিবার।
অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ রোধ করার বা এমনকি রোগের সংক্রমণ এড়ানোর কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না।তাই ভয়ানক যৌনরোগে আক্রান্ত হয় সদ্য ঋতুমতী ও বিধবা মহিলাগুলি।বিষয়টি নিয়ে ধরপাকড় শুরু হলে প্রকাশ পায় আরেকটি একটি ভয়ংকর তথ্য।
আনিভা নিজেও এইডস আক্রান্ত। আর এইডসে আক্রান্ত হওয়ার পরও অবাধ ও অসুরক্ষিত শারীরিক সংসর্গ চালিয়ে গেছে আনিভা। আশার কথা, মালাউই সরকার তাদের দেশের এই ঘৃণ্য ও অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন। মালাউই- এর প্রেসিডেন্টের আদেশে আনিভাকে গ্রেফতার করে সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। বাকি হায়নাদেরও একই হাল হয়েছে।
এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন এমনই এক মানবাধিকার কর্মী নাতাশা অ্যানি টনথলা। এই ঘৃণ্য প্রথা বন্ধের উদ্দেশ্যে ‘প্রোজেক্ট ডিগনিটি’ নামে একটি সংগঠনও শুরু করেছেন তিনি। ১৩ বছর বয়সে প্রথম ঋতুস্রাব হওয়ার পর তাঁকেও একজন হায়নার সঙ্গে শারীরিক সংসর্গ করতে হয়েছিল।
নাতাশা জানান,হায়নার সঙ্গে শারীরিক সংসর্গর সময় মেয়েদের চোখ বাঁধা থাকে। তাই ঠিক কার সঙ্গে তাদের শারীরিক সংসর্গ হলো, তা মেয়েরা জানতে পারে না। নাতাশা বলেন “আমি আশাবাদী, আমরা এই ভয়ংকর প্রথা নির্মূল করতে পারবো। কারণ আমরা কিশোরী ও বিধবা নারীদের লাঞ্ছনা থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছি । এই লড়াইয়ে আমরাই জিতবো, হায়নারা নয়।”