Latest News

মণ্ডপে নয়, নেপালের ঘরে ঘরে পূজিতা হন দুর্গা ভবানী, ‘বড়া দশেইন’ উৎসবে

রূপাঞ্জন গোস্বামী

পূর্ব হিমালয়ের কোলে অবস্থিত নয়নাভিরাম দেশ নেপাল। দেশটির মাথার শ্বেতশুভ্র মুকুট হয়ে বিরাজ করছে মাউন্ট এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, লোৎসে, মাকালু, অন্নপূর্ণা, ধৌলাগিরির মতো বিশ্ববিদিত শৃঙ্গের দল। পশুপতি পুরাণ থেকে জানা যায় ‘নে’ নামের এক সাধু নেপালে এসেছিলেন ধর্মপ্রচার করতে। বাগমতী ও বিষ্ণুমতী (মতান্তরে কেশাবতী) নদীর সঙ্গমে তিনি বসেছিলেন তপস্যায়। তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল উপত্যকাবাসী। সেই ‘নে’ মুনির নামানুসারেই দেশটির নাম হয়েছে নেপাল।

পাহাড়ে ঘেরা নয়নাভিরাম নেপাল

নেপাল নামটির উৎস নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন অনেক ইতিহাসবিদ। তাঁরা মনে করেন, তিব্বতি শব্দ ‘নিয়ামপাল’ থেকে এসেছে ‘নেপাল’ নামটি। ‘নিয়ামপাল’ শব্দটির অর্থ পবিত্র ভূমি। নেপাল যে পবিত্র ভূমি, তা নিয়ে অবশ্য কোনও দ্বিমত নেই। কারণ হিন্দুপুরাণ অনুসারে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর হরিণের রূপ ধারণ করে এসেছিলেন নেপালে। ভগবান বুদ্ধের পদস্পর্শেও পবিত্র হয়েছে নেপাল।

নেপালের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে হিন্দু সংস্কৃতি
নেপাল বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। তবুও দেশটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে হিন্দু সংস্কৃতি। কারণ দেশটির ৮১ শতাংশ জনগণই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। প্রাচীন হিন্দু সৌর পঞ্জিকা ‘বিক্রম সম্ভাত’ অনুসারে দেশটি চলে। নেপালের জনগণ বিশ্বাস করেন, অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় দেবাদিদেব মহাদেব ভগবান শ্রীবিষ্ণুকে দিয়েছিলেন একটি রণপতাকা। যে পতাকায় আঁকা ছিল সূর্য ও চন্দ্র। দেবরাজ ইন্দ্র রণপতাকাটি দান করেছিলেন নেপালবাসীদের। দেবতাদের দেওয়া সেই রণপতাকাই আজ নেপালের জাতীয় পতাকা।হিন্দু ধর্মের সকল দেবদেবী পূজা পান নেপালে। এছাড়াও পূজা পান নেপালের পাহাড়ি এলাকার লৌকিক দেবদেবীরা। হিন্দু ও বৌদ্ধদের পূজা পান সাধক মচ্ছেন্দ্রনাথ বা বুঙ্গা দাই। তবে সবার ওপরে অবস্থান শ্রীবিষ্ণু, মহাদেব, দেবী ভবানী, মা কালী ও মা তারার। নেপালের বেশিরভাগ মন্দিরেই বিরাজ করেন এই দেবদেবীরা। এঁদের বিখ্যাত মন্দিরগুলি হল পশুপতিনাথ, দোলেশ্বর মহাদেব, মুক্তিনাথ, ছাঙ্গুনারায়ণ, বুড়া নীলকণ্ঠ, গুহ্যেশ্বরী শক্তিপীঠ, দক্ষিণাকালী মন্দির ও মনোকামনা মন্দির।

নেপালের জাগ্রত দেবতা মা দক্ষিণাকালী

ভারতীয় হিন্দুদের মতোই নেপালের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও পালন করেন হিন্দু ধর্মের প্রায় সমস্ত আচার অনুষ্ঠান। এছাড়াও তাঁরা পালন করেন নিজস্ব কিছু ধর্মীয় উৎসব, সেগুলির মধ্যে আছে ইন্দ্রযাত্রা, ঘোড়ে যাত্রা, ভৈরব কুমারী যাত্রা, গাই যাত্রা, বাঘ যাত্রা, রাতো মচ্ছেন্দ্রনাথ যাত্রা, মা যাত্রা, তানসেন যাত্রা, জনাই পূর্ণিমা, ফাগু পূর্ণিমা, মাতা তীর্থ আউনসি, গোকারণ আউনসি, ঘণ্টাকর্ণ চতুর্দশী ও আরও অসংখ্য উৎসব। তবে নেপালের উৎসবগুলির মধ্যে সেরার সেরা উৎসব হল আশ্বিনের ‘বড়া দশেইন’ উৎসব। নেপাল বিশ্বাস করে, এই উৎসব নেপালের জনজীবনে সুখ, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, শক্তি, সৌভাগ্য, সম্পদ, সুস্বাস্থ্য, গতি ও গৌরব নিয়ে আসে। নাগরিকদের ও দেশের সকল শত্রু বিনাশ করে।

শরতের নীল আকাশ মাতিয়ে তোলে নেপালকেও
নীল আকাশে ভেসে আসা দুধসাদা মেঘ নিয়ে আসে দেবী দুর্গা ভবানীর আগমন বার্তা। নেপালের আকাশে উড়তে শুরু করে মাঙ্গলিক ঘুড়ি। বৃষ্টি বন্ধ করার জন্য মেঘকে অনুরোধ জানায় ঘুড়িগুলি। কারণ নেপালের পবিত্র মাটিতে দুর্গা ভবানীর পা রাখার সময় আগত। শুরু হবে নেপালের সব থেকে বড় উৎসব ‘বড়া দশেইন’। বাঁধনহীন আনন্দে মেতে উঠবে সমগ্র নেপাল। তার আগে নেপালের গ্রামগুলির গাছে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় ঘাসের দড়ি দিয়ে বাঁধা বাঁশের দোলনা। দেবী দুর্গা ভবানীর আশীর্বাদ লাভ করার জন্য, অন্তত একবার সেই দোলনায় ওঠে আবালবৃদ্ধবনিতা।‘বড়া দশেইন’ উৎসব চলে ১৫ দিন ধরে। আশ্বিনের শুক্লপক্ষের প্রতিপদ থেকে কোজাগরী পূর্ণিমা অবধি। তবে প্রথম ন’দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই ন’দিন ধরে দেবী দুর্গা ভবানীর সাথে পূজিতা হন নবদুর্গা। দেবী দুর্গা ভবানী হলেন শুভ শক্তির বিজয় ও অশুভ শক্তির পরাজয়ের প্রতীক। তাই নেপালের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা, এই ন’দিন তাঁদের প্রাণ-মন সঁপে দেন দেবীর পায়ে। তবে এই পনেরো দিনের মধ্যে, সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলি হল প্রথম, সপ্তম, অষ্টম, নবম, দশম ও পঞ্চদশ।

প্রথমা (ঘটস্থাপনা)

আশ্বিনের শুক্লপক্ষের প্রতিপদ তিথির শুভক্ষণে, মল্ল রাজাদের সুপ্রাচীন রাজপ্রাসাদ হনুমান-ধোকা থেকে ভেসে আসে মালশ্রী ধুন। ছড়িয়ে পড়ে আকাশে বাতাসে। প্রাসাদ থেকে আকাশের দিকে দাগা হয় মাঙ্গলিক তোপ। শুরু হয়ে যায় নেপালের বহুকাঙ্ক্ষিত উৎসব ‘বড়া দশেইন’। ঘরে ঘরে, মন্দিরে মন্দিরে শুরু হয় দুর্গা ভবানীর আবাহন।
এক সপ্তাহ আগে থেকেই দিনটির জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দেন নেপালের হিন্দুরা। পরিবারের সবাই মিলে বাড়ির একটি ঘরকে পরিষ্কার করেন। কারণ সেই ঘরে ন’রাত কাটাবেন ভগবতী জগদম্বা। ঘরের মেয়ে হয়ে। এই বিশেষ ঘরটিকে বলা হয় ‘দশেইন ঘর’। একবার পরিষ্কার করা হয়ে গেলে, সেই ঘরে পরিবারের একজন সদস্য বা পুরোহিত ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবেন না। যিনি প্রবেশ করবেন, তিনিই সকাল সন্ধ্যায় করবেন দেবীর নিত্যপূজা।এই দিন ঘরের নির্দিষ্ট কোণে মাটির সঙ্গে বালি ও গোবর মিশিয়ে তৈরি করা হয় আয়তাকার একটি বেদি। শুভ মুহূর্তে সেই বেদির ওপর স্থাপন করা হয় একটি ঘট অথবা মালসা। যেটির মধ্যে থাকে গোবর মেশানো মাটি। বেদিতে ঘট স্থাপন করার পরে, ঘটের মাটিতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়ে বার্লির বীজ। ঢালা হয় পবিত্র নদীর জল। একইসঙ্গে বেদির ওপরেও ছড়িয়ে দেওয়া হয়, ভুট্টা, ধান ও অনান্য শস্যের বীজ। পবিত্র জল ছিটিয়ে দেওয়া হয়ে বেদির ওপরেও। জল দেওয়া হয় ন’দিন ধরে। নেপালবাসীরা বিশ্বাস করেন, বেদিতে থাকা পবিত্র ঘটেই বিরাজ করেন দেবী দুর্গা ভবানী। কোথাও কোথাও ঘটের পিছনে রাখা হয় দুর্গা ভবানীর ছবিও।
ঘটের ভেতর রাখা, বার্লি বীজ অঙ্কুরিত হয়ে তৈরি হয় চারা। যাকে বলা হয় ‘জামারা’। এই জামারা অত্যন্ত পবিত্র। কারণ এই বার্লি চারাগুলিই দেবী ভবানীর প্রতীক। ঘট স্থাপনের পর, ঘটের সামনে রাখা হয় পূজার অনান্য উপকরণ। দেবীর আবাহনী মন্ত্র পড়ে, দেবীকে ঘটে বিরাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানান পূজক। দরজার বাইরে থেকে দেখেন পরিবারের অন্যান্য সদস্যেরা।এই পদ্ধতিতে সকাল ও সন্ধ্যায় দেবীর পূজা চলে নবরাত্রির ষষ্ঠ দিন পর্যন্ত। ষষ্ঠ সন্ধ্যায় পরিবারের বয়জ্যেষ্ঠ কোনও সদস্য যান বেলগাছের কাছে। বেলগাছে বিরাজ করেন মহাদেব। তাঁকে বাড়ির পুজোয় আমন্ত্রণ জানিয়ে আসেন সেই সদস্য।

মহা সপ্তমী (ফুলপাতি)

বড়া দশেইনের সপ্তম দিন অর্থাৎ মহা সপ্তমীতে অনুষ্ঠিত হয় ‘ফুলপাতি’। এই পবিত্র দিনে, নেপালরাজের রাজকীয় জামারা ঘট, লাল কাপড়ে মুড়ে গোর্খা জেলা থেকে আনা হয় কাঠমাণ্ডুর তুণ্ডিখেল ময়দানে। ঘটের সঙ্গেই লাল কাপড়ে মোড়া হয় কলাবউ, আখ গাছ সহ মোট ন’টি উপকরণ। যেগুলিকে একত্রে বলা হয় ‘ফুলপাতি’।
মগর ব্রাহ্মণেরা খালি পায়ে হেঁটে গিয়ে গোর্খা দরবার থেকে এই পবিত্র ঘট ও ‘ফুলপাতি’ নিয়ে আসেন, তিন দিনে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে। মহা সপ্তমীর সকালে, কাঠমাণ্ডুর সমস্ত সরকারি কর্মচারীদের, চিরাচরিত নেপালি পোশাক পরে, বাধ্যতামূলকভাবে উপস্থিত থাকতে হয় তুণ্ডিখেল ময়দানে। সেখানে উপস্থিত থাকেন স্বয়ং নেপালরাজও। ঘটে বিরাজমান রাজভবানীর সামনে কুচকাওয়াজ করে নেপাল সেনা। দেবীকে দেওয়া হয় গান স্যালুট। এরপর নৃত্য, গীত ও শোভাযাত্রা সহকারে পবিত্র ঘট ও ফুলপাতিকে নিয়ে যাওয়া হয় হনুমান-ধোকা প্রাসাদে।অন্যদিকে, এই দিন ভোরে বেলগাছকে পুজো করে, বেলপাতা নিয়ে আসা হয় প্রতিটি বাড়িতে। আরও আটটি উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয় ফুলপাতি। প্রথা অনুযায়ী বাড়ির দরজার সামনে প্রথমে রাখা হয় গৃহস্থের ফুলপাতিকে। এরপর ফুলপাতিকে পূজা করে নিয়ে যাওয়া হয় দশেইন ঘরে। নেপালের দুর্গা পূজার অন্যতম পবিত্র আচার হল এই ‘ফুলপাতি’।

মহা অষ্টমী

বড়া দশেইনের উৎসবের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিনটি হল মহা অষ্টমী। মহা অষ্টমীতে ঘটের সামনে, দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে একে একে বসিয়ে দেওয়া হয় ধানের ন’টি স্তুপ। সর্বদক্ষিণে স্থাপন করা হয় ধানের প্রথম স্তুপটি। সেটি নিবেদন করা হয় দেবী শৈলপুত্রীকে। এরপর একে প্রথম স্তুপটির উত্তরে বসানো হয়, দেবী ব্রহ্মচারিণী, দেবী চন্দ্রঘণ্টা, দেবী কুষ্মাণ্ডা, দেবী স্কন্দমাতা, দেবী কাত্যায়নী, দেবী কালরাত্রি, দেবী মহাগৌরী ও দেবী সিদ্ধিদাত্রী ভগবতীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত স্তুপগুলি। প্রত্যেকটি স্তুপ রাখার সময় উদ্দিষ্ট দেবীর মন্ত্রচ্চারণ করা হয়। একই পদ্ধতিতে রাখা হয় বেলপাতা, নবপত্রিকা, সুপারি, মিষ্টান্ন, ফল ও দক্ষিণা।
মহা অষ্টমীতে দেবী দুর্গা ভবানী তাঁর দানবদলনী রূপ ধারণ ধরেন। তাই বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয় অস্ত্রপূজা। ঘটের সামনে রাখা হয়, খুকরি, তরবারি, ছুরি, বর্শা। কোথাও কোথাও রাখা হয় কোদাল, শাবল, গাঁইতিও। পূজার পর বাড়ির সামনে বলি দেওয়া হয় কলা, শশা, কুমড়ো ও নারকেল। বলির সময় সবাই সমস্বরে চিৎকার করে ওঠেন ‘জয় মা ভৈরবী’ বলে।

নয় রূপে দেবী দুর্গা ভবানী

অষ্টমীর রাত্রিকে বলা হয় ‘কালরাত্রি’। এদিন রাতে শক্তিদেবীদের মন্দিরে মন্দিরে শুরু হয় পশুবলি। বলি দেওয়া হয় মহিষ, ছাগল, ভেড়া, শূকর, হাঁস, মুরগি ও পায়রা। নেপালবাসীরা মনে করেন রক্ত হল উর্বরতার প্রতীক। পশুর রক্ত জমিতে পড়লে জমি হবে উর্বর। নেপাল হবে শস্যশ্যামলা। বাড়বে রাজকোষে জমার পরিমাণ। তাই হয়ত বাধ্যতামূলকভাবে নেপালের প্রতিটি ভূমিরাজস্ব দফতরের সামনে পশুবলি দেওয়ার প্রথা প্রচলিত।
মহাষ্টমীর রাতেই পশুদের রক্তে
লাল হয়ে ওঠে হনুমান-ধোকা প্রাসাদের প্রাঙ্গণ। একই সঙ্গে ৫৪ টি মহিষ ও ৫৪ টি ছাগল বলি দেওয়া হয় মধ্যরাতে। সেখানে পশুবলি চলে সারা রাত। উপস্থিত জনসাধারণের মধ্যে দেবীর প্রসাদ হিসেবে বিলি করা হয় পশু ও পাখির মাংস। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রান্না করা হয় প্রসাদি মাংস। তারপর কলাপাতায় সাজিয়ে, নিবেদন করা হয় দেবী দুর্গা ভবানীকে। পরে তা বিতরণ করা হয় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে। এই প্রসাদি মাংস খাওয়াটাও অন্যতম পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করেন নেপালের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা।

মহা নবমী

নেপালের মানুষের উৎসাহ তুঙ্গে ওঠে মহা নবমীতে। কারণ নবরাত্রির শেষ দিন মহা নবমী। এদিনও দুর্গা ভবানীর বিশেষ পূজার পর শুরু হয় পশুবলি। নেপালের লোকবিশ্বাস, মহা নবমীর দিন দেবীর ভয়ে ভীত অসুরেরা পশু ও মুরগির ছদ্মবেশ ধারণ করে দেবীর হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করে। ফলে অষ্টমীর থেকেও দ্বিগুণ উৎসাহে নেপাল জুড়ে শুরু হয় পশুবলি বা ‘অসুর নিধন’। সরকারি ব্যবস্থাপনায় এদিনও অসংখ্য মহিষকে বলি দেওয়া হয় হনুমান-ধোকা প্রাসাদে। বছরের এই দিনটিতেই জনসাধারণের দর্শনের জন্য খুলে দেওয়া হয় হনুমান-ধোকায় থাকা তালেজু ভবানীর সুপ্রাচীন মন্দিরটির দরজা। মানুষের ঢল নামে মল্ল রাজাদের তৈরি মন্দিরটির প্রাঙ্গণে।

বিজয়া দশমী

বিজয়া দশমীর দিন গৃহস্তদের বাড়িতে দেবী দুর্গা ভবানীর সঙ্গে পূজিতা হন দেবী অপরাজিতা ভাগবতী, জয়া ও বিজয়া। পূজার পর দশেইন ঘর থেকে বাইরে নিয়ে আসা হয় দেবী দুর্গারূপী জামারা ঘটটিকে। প্রসাদ বিতরণের পর, গুরু, পুরোহিত ও বয়স্কদের কাছ থেকে একটি করে বার্লি চারা গ্রহণ করে পরিবারের নবীন প্রজন্ম। তাদের কপালে লাগিয়ে দেওয়া হয় চালের গুঁড়ো, দই ও সিঁদুর দিয়ে তৈরি গোলাপি রঙের জামারা টিকা। যাতে নবীন প্রজন্মের আগামী দিনগুলি সুখের হয়।এরপর টিকা লাগানো শুরু হয় পরিবারের অন্যান্য সদস্য, আত্মীয় অনাত্মীয়ের কপালে। ‘জামারা টিকা’ হল বিজয়া দশমী ও বড়া দশাইন উৎসবের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ আচার। বড়া দশেইনে জামারা টিকা অন্যকে দেন না বা অন্যের কাছ থেকে নেন না, এমন নেপালবাসী খুঁজে পাওয়া ভার। টিকা পরানোর পর্বটি চলতে থাকে নেপালের কোজাগ্রত (কোজাগরী) পূর্ণিমা পর্যন্ত। মহালক্ষ্মীর আরাধনার মাধ্যমে সেদিনই শেষ হয় ‘বড়া দশেইন’ উৎসব। আবার শুরু হয় দিন গোনা।এভাবেই পনেরো দিন ধরে, দেবী দুর্গা ভবানীর আগমনের আনন্দে মেতে ওঠেন নেপালের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। বাড়ির পূজা সেরে, পরিবার নিয়ে তাঁরা ঘুরে বেড়ান নারাদেবী, বিজয়েশ্বরী, ইন্দ্রায়ণী, নক্সাল ভগবতী, শোভা ভগবতী, মাইতিদেবী, গুহ্যেশ্বরী, ভদ্রকালী, কালিকাস্থান, সঙ্কটা মহাকালস্থান, দক্ষিণা কালী, চামুণ্ডা দেবী ও দুর্গা ভবানীর মন্দিরে মন্দিরে। নব আনন্দে জেগে ওঠার জন্যেই, এই সময় বাড়ি ফিরে আসেন প্রবাসীরা। মানসিক দূরত্ব মুছিয়ে দিয়ে, এই উৎসবের মাধ্যমে শত্রুকেও বন্ধু করে তোলেন দেবী দুর্গা ভবানী। দৃঢ় করে তোলেন নেপালের সামাজিক বন্ধন।

You might also like