
দ্য ওয়াল ম্যাগাজিন ডেস্ক: কৃষিপ্রধান দেশ আমাদের। চাষবাসের সুবিধের জন্য অতি প্রাচীনকাল থেকেই দিনক্ষণ, তিথি নক্ষত্র, চন্দ্র সূর্যের অবস্থানকে গুরুত্ব দিত মানুষ। বাতাসের দিকবদল, তারার অবস্থান এই সবকিছু দেখেই তৈরি হত পঞ্জিকা। শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর কম বেশি সমস্ত প্রাচীন সভ্যতাতেই এমন প্রকৃতিকেন্দ্রিক, ঋতুকেন্দ্রিক পাঁজির প্রচলন ছিল। ঋতু বুঝেই মাঠে নামত কৃষকেরা। দিনক্ষণের হিসেব কষেই উপাসনা করতেন পুরোহিত।
খিষ্ট জন্মের সময়কে প্রামাণ্য ধরেই পশ্চিমে জন্ম নিয়েছিল খ্রিষ্টাব্দের ধারণা। আমাদের দেশে অবশ্য ইংরেজ শাসন কায়েম হওয়ার আগে খ্রিষ্টাব্দের প্রচলন ছিল না। শ্বেতাঙ্গদের বহু আগে এদেশের মাটিতে পা রেখেছিল শক হূণ মোগল পাঠানেরা। সঙ্গে করে এনেছিল তাদের নিজস্ব ধর্ম সংস্কৃতি, জ্যোতিষ, গণিত, এমনকি তিথিনক্ষত্র হিসেবের নিজস্ব নিয়মও।
তাহলে, মুসলমানদের আগমনের আগে ভারতের মানুষ কি পঞ্জিকা ব্যবহার করত না? নিশ্চয়ই করত। তার নানান প্রমাণ ছড়িয়ে আছে এ দেশের বহু আকর গ্রন্থে, বিদেশি পর্যটকদের বিবরণেও। তবে সারা দেশ জুড়ে একটি নির্দিষ্ট পঞ্জিকা মেনে চলা হত না মোটেও। রাজারা নিজের নিজের শাসন এলাকায় সুবিধে মতো কিছু আঞ্চলিক পাঁজির প্রচলন করতেন। এদের মধ্যে উজ্জয়িনীতে রাজা বিক্রমাদিত্যের নামে বিক্রমাব্দ, চতুর্থ শতকের দিকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের নামে গুপ্তাব্দ, উত্তর ভারতে হর্ষবর্ধনের নামে হর্ষাব্দ, সম্ভাব্য শক-ক্ষত্রপদের নামে শকাব্দ ছিল সবচেয়ে পরিচিত। তাছাড়া বিভিন্ন আঞ্চলিক সন তো ছিলই।
সাধারণ বাঙালির কাছে বাংলা ক্যালেন্ডারের হিসেব যতটা অস্পষ্ট তার চেয়েও বেশি ধোঁয়াশায় ভরা এর উত্পত্তির ইতিহাস। বাংলা নববর্ষের শুরু কবে থেকে এ নিয়ে বিতর্ক কম নয়। প্রাচীন ভারতে আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামলনাড়ু, ত্রিপুরা অঞ্চলে বহু আগে থেকেই সৌর বছরের প্রথম দিনটাকে আলাদাভাবে পালন করা হল। এ ছিল প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে এখন যেমন নববর্ষ পালন এক একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, প্রাচীন ভারতে এমনটা ছিল না। তখন নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবেই পালিত হত।
ইতিহাস না মিথ? শশাঙ্ক থেকে হোসেন শাহ
ঠিক কবে থেকে চালু হল বাংলা ক্যালেন্ডার? নাহ, এই নিয়ে ইতিহাসে কোনও প্রামাণ্য তথ্যই সেভাবে নেই। সুনির্দিষ্ট মতবাদও নেই, বরং বলা চলে এ ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত। ইতিহাসবিদেরা তাদের গবেষণায় এব্যাপারে একেবারে আলাদা আলাদা মত পোষণ করেন। বঙ্গাব্দের সূচনা সম্পর্কে প্রচলিত আছে বেশ কিছু মত। আর মধ্যে মাত্র দুটি মতকেই মোটামুটিভাবে প্রামাণ্য হিসাবে ধরা হয়ে থাকে। একটি মত বলছে, বঙ্গাব্দের সূচনা করেন গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক। সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে বঙ্গদেশের রাজচক্রবর্তী রাজা ছিলেন শশাঙ্ক। বাংলার এদিক ওদিকে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট স্বাধীন রাজ্যগুলোকে এক সুতোয় বেঁধে গৌড় রাজ্যের সূচনা করেন তিনি, যার রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ বা কানসোনা।
সুনীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বঙ্গাব্দের উৎসকথা’ বইয়ের ৩৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ই এপ্রিল গৌড়ের সিংহাসনে বসেন শশাঙ্ক, আর সেদিন থেকেই বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের প্রচলন হয়। এই মত অনুসারে পরবর্তীকালে অনেকেই দাবি করেন, যেদিন শশাঙ্ক সিংহাসনে আরোহন করেন সেদিন থেকেই বাংলা বর্ষপঞ্জি বা বঙ্গাব্দের গণনা শুরু। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ঠিক কোন সময়ে শশাঙ্ক ক্ষমতায় এসেছিলেন, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ঐতিহাসিকেরা তাঁর যে শাসনকালের উল্লেখ করেন, তাঁর অনেকটাই নিছক অনুমান। অনেক ইতিহাসবিদের মতে তাঁর শাসনকাল ছিল ৬০০-৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ। সেই সময়কার কিছু প্রামাণ্য পুঁথিতে আবার ‘গুপ্তাব্দ’ শব্দটার উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে।
খুব স্বাভাবিকভাবেই একদল মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন, শশাঙ্কই যদি বঙ্গাব্দের সূচনা করেই থাকেন, তাহলে বঙ্গাব্দের বদলে ‘গুপ্তাব্দ’ শব্দটা ব্যবহৃত হল কেন? খ্রিষ্ট্রীয় ষষ্ঠ শতাব্দী, ভারতবর্ষের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ভানুগুপ্তের হাতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের ঘণ্টা বেজে গেছে ততদিনে। আসলে বঙ্গ কোনও শাসকের নাম নয়, তাই শিলালিপি দেখে শাসনকাল খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর জটিলতা সেখানেই। বঙ্গাব্দের সূচনার সঙ্গে সুলতান হোসেন শাহের নামও জড়িয়ে আছে, কিন্তু সে ক্ষেত্রেও কল্পনার ভাগ বেশি, প্রমাণের একান্তই অভাব।
বাংলা ক্যালেন্ডারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আকবরের নামও
এ ব্যাপারে আরেকটি মত যেটি সবচেয়ে জনপ্রিয় আর গ্রহণযোগ্য, তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মোঘল বাদশা আকবরের নাম। মনে করা হয়, বাংলা সনের সূচনা হয়েছিল মোগল সম্রাট আকবরের ইচ্ছা আর উদ্যোগে। সেসময় দেশজুড়ে হিজরি পঞ্জিকা আর শকাব্দের প্রচলন ছিল। এরপর ১৫৫৬ সাল নাগাদ দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে আদিল শাহ শূরের সেনাপতি হিমুকে পরাজিত করে দিল্লীর সিংহাসনে বসেন আকবর। সেই সময় রাজস্ব আদায়ের জন্য একটা পৃথক সৌর ক্যালেন্ডার চালু করেছিলেন তিনি। হিজরি ক্যালেন্ডারের পাশাপাশি এই সৌর বর্ষীয় ক্যালেন্ডারেরও প্রচলন ছিল।
আকবরনামায় আবুল ফজলের বর্ণনা থেকে জানা যায়, রাজকার্যে যে ক্যালেন্ডার ব্যবহৃত হতো তা ছিল হিজরি ক্যালেন্ডার। আকাশে চাঁদের অবস্থান, পূর্ণিমা অমাবস্যার হিসেবের উপর ভর করে চলত সেই ক্যালেন্ডার। কিন্তু চাষের কাজে চাঁদের থেকেও সূর্যের অবস্থান বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। আর তাই কৃষিকাজের জন্য যে ক্যালেন্ডার প্রচলিত ছিল, তা ছিল সৌর ক্যালেন্ডার।
এর কিছু বাস্তব অসুবিধেও ছিল। একই সাম্রাজ্যে দুরকম ক্যালেন্ডারের প্রচলন থাকায় নানাক্ষেত্রে বিপদে পড়তেন সাধারণ মানুষ। দুটি ক্যালেন্ডারের গণনাপদ্ধতিতে দিনের তফাত থাকায় কর সংগ্রহে খুবই অসুবিধে হত। যে সময় চাষির ঘরে ফসল উঠত, কর সংগ্রহ করা হত তার অনেক পরে হিজরি ক্যালেন্ডার মেনে। স্বাভাবিকভাবেই এতে সমস্যায় পড়তেন গরিব কৃষকেরা।
দেরিতে হলেও, বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনিকভাবে শুরু হয় চিন্তাভাবনা। আবুল ফজল তো রীতিমতো হিসেব কষে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ৩২টি সৌরবর্ষ ৩৩টি চান্দ্রবর্ষের সমান হওয়ায় চাষিরা বাধ্য হচ্ছেন অতিরিক্ত এক বছরের খাজনা দিতে। খাজনা আদায় যাতে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে হয় আর দেশের গরীব চাষিদের যাতে কোনওভাবেই অতিরিক্ত খাজনা না দিতে হয়, তাই আকবর তাঁর রাজত্বকালেই সৌরমতে এক নতুন ক্যালেন্ডার বানানোর নির্দেশ দেন প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতহুল্লা শিরাজিকে।
আকবরের রাজত্বকালের ২৯ তম বর্ষে তাঁর সভাসদ জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীর সহযোগিতায় সৌর সন আর হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ থেকে ‘তারিখ-এ-এলাহি’ নামে নতুন এক বছর গণনা পদ্ধতি চালু করেন। অনেকের মতে এই ক্যালেন্ডারটি আকবরের অর্থমন্ত্রী রাজা টোডরমলের সৃষ্টি, আবার অনেকে এটাকে আকবরের উজির আবুল ফজলের সৃষ্টি বলেও মনে করেন। সৃষ্টি যিনিই করুন ওই ক্যালেন্ডার থেকেই হিসেব মতো বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছে বলে ধরে নেন বেশিরভাগ ঐতিহাসিক।
আকবরের নির্দেশেই তারিখ-ই-ইলাহিতে দিনের হিসেব শুরু হয়েছে আকবরের সিংহাসনে অভিষেকের বছর থেকে। ঐতিহাসিকদের মতে সম্রাট আকবর সিংহাসনে বসেন ৯৬৩ হিজরি সনে, ইংরেজি হিসেবে সেটা ১৫৫৬ সাল। তাঁর নির্দেশ অনুসারে ওই ৯৬৩ হিজরি সাল থেকেই তারিখ-ই-ইলাহির প্রথম দিন ধরা হয়েছিল। ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ফতেহউল্লাহ সিরাজি প্রবর্তিত এই নতুন সাল ‘ফসলি সন’ নামে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপক ভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এ ফসলি সনই বাংলা সাল বা ‘বঙ্গাব্দ’ নাম ধারণ করে।
তারিখ-ই-ইলাহিতে মাসগুলোর নাম ছিল ফরওরদিন, অর্দিবিহিষ্ট, খুরর্দাদ, তির, অমুরদাদ, শারেবার, মিহ্র, আবান, আজর, দয়, বহ্মন এবং ইস্ফন্দারমজ। পরে আকাশের বিভিন্ন নক্ষত্রের নাম অনুসারে বাংলা সনের মাসগুলোর নামকরণ করা হয়। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন এই নামগুলো নেওয়া হয়েছে ৭৮ খ্রিস্টাব্দে সাকা জাতির রাজত্বের সময় প্রচলিত শকাব্দ থেকে।
চাঁদের ২৭টি নক্ষত্র, সেই তারাদের মধ্যে প্রধান কয়েকটি তারার নাম অনুসারে বাংলা মাসগুলোর নাম দেওয়া হয়। যেমন; মাসের শুরুতে বিশাখা নক্ষত্রের নাম থেকে বছরের প্রথম মাসের নাম বৈশাখ। জেষ্ঠা নক্ষত্রের নাম থেকে দ্বিতীয় মাসের নাম জৈষ্ঠ্য। তৃতীয় মাস অষধা নক্ষত্রের সময়কাল, তাই সেই মাসের নাম আষাঢ়। একইরকমভাবে শ্রবণা নক্ষত্র থেকে শ্রাবণ মাস। ভাদ্রপাদ বা ভদ্রা নক্ষত্রের সময়কাল থেকে ভাদ্র।
ভাদ্রের পর চাঁদ অশ্বিনী নক্ষত্রের কক্ষপথে বিরাজ করে। তাই ভাদ্রের পরের মাস আশ্বিন। আবার হেমন্তকালে চাঁদ থাকে কৃত্তিকা নক্ষত্রে, কৃত্তিকার নাম থেকেই সে মাসের নাম কার্তিক। আবার মৃগশিরা নক্ষত্রের আরেক নাম অগ্রহায়ণী, তাই মৃগশিরার মাস অগ্রহায়ণ। একইরকমভাবে পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘমাস, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন আর চিত্রা নক্ষত্রের নামানুসারে চৈত্র মাসের নামকরণ করা হয়েছে।
তারিখ-এ-এলাহি’র আগে বাঙালিরা শকাব্দ অনুযায়ী চৈত্র মাসকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে ব্যবহার করত। পরে যখন ৯৬৩ হিজরির প্রথম মাস মহররমকে ‘তারিখ-এ-এলাহি’র প্রথম মাস ধরে গণনা করা শুরু হয় তখন তা বৈশাখ মাসের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় বৈশাখকেই ধরা হয় “তারিখ-এ-এলাহি”র প্রথম মাস।
পহেলা বৈশাখ, বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন। বাংলাদেশে বাংলা একাডেমি কর্তৃক সংশোধিত বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে এদিন উদযাপন করা হয় প্রতি বছরের এপ্রিল ১৪ তারিখে। যদিও পশ্চিমবঙ্গে তা উদযাপন করা হয় সনাতন বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে। তবে আকবরের সময়কাল থেকেই পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয় বলে মনে করেন ঐতিহাসিকেরা। তখন বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে প্রত্যেক প্রজাকে খাজনা, মাশুল ও শুল্ক দিয়ে দিতে হত। এর পরের দিন মানে পয়লা বৈশাখে জমিদার বা ভূস্বামীরা নিজের নিজের এলাকায় উৎসব করতেন। এই উপলক্ষ্যে প্রজাদের মিষ্টিমুখ করানো হত করতেন। নাচ গান জলসারও আয়োজন হত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়, রূপ বদলাতে বদলাতে যা আজ হালখাতার উৎসবে পরিণত হয়েছে।