Latest News

বিশ্বের বৃহত্তম গোশালা ‘আনন্দবন’, যেখানে আশ্রয় নিয়েছে নব্বই হাজার পরিত্যক্ত গরু

আনন্দবনে এসেছিলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ।

রূপাঞ্জন গোস্বামী

রাজস্থানের জালোর জেলার ‘সানছোড়’ শহর থেকে দশ কিলোমিটার দূরে আছে পুরাণের আনন্দবন। বিষ্ণুর অষ্টম অবতার শ্রীকৃষ্ণের স্মৃতি বিজড়িত আনন্দবন। মথুরা থেকে দ্বারকা যাওয়ার পথে চিরসবুজ ‘কের’ (cappari Desiduas) ও জাল (Salvadora oleoides) গাছে ঘেরা আনন্দবনে এসেছিলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। সাবিত্রী, বনস ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত আনন্দবনে শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে চরিয়েছিলেন মথুরা থেকে নিয়ে আসা গরুগুলিকে।

আনন্দবন

সেই থেকে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে কৃষ্ণভক্তি ও গোভক্তির প্রথা শুরু হয়েছিল। যা ক্রমশ ছড়িয়ে গিয়েছিল মাড়ওয়াড়, কাথিয়াবাড় ও থরপার্কার এলাকায়। এই জায়গাগুলির সুপ্রাচীন লোকগাথাতেও তাই পাওয়া যাবে আনন্দবনের নাম। এখানেই শ্রীকৃষ্ণের তপস্যা করেছিলেন ঋষি দত্তাত্রেয়। এসেছিলেন গোমাতা কামধেনুও। এক অলৌকিক স্পন্দন আছে ছ’শো একরের আনন্দবনে। তারই খোঁজে এসেছিলেন এ যুগের এক সন্ন্যাসী।

স্বামী দত্ত শরণানন্দ

সন্ন্যাসী দত্ত শরণানন্দ ন’বছর হিমালয়ে তপস্যা করার পর, দৈববাণী পেয়ে ১৯৯২ সালের শ্রাবণ মাসে এসেছিলেন পাথমেড়া তহশিলের আনন্দবনে। স্থানীয় শহর ও গ্রামগুলিতে ঘুরে ঘুরে তিনি ধর্ম ও যোগ শিক্ষা দিতেন। সেই সময় তিনি প্রচুর গরুকে উদভ্রান্তের মতো রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াতে দেখেছিলেন। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন প্রবল খরার কারণে গো-পালকেরা গরুগুলিকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাড়ি থেকে।

ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত গরুর দল গ্রামে গ্রামে, শহরে শহরে ঘুরছিল। তিনি দেখেছিলেন গরুগুলি আস্তাকুঁড়ের জঞ্জাল, এমনকি প্লাস্টিক খেতে। দেখেছিলেন অনাহারে বা বিষক্রিয়ায় মারা যেতে। এলাকা ছাড়া করার জন্য গরুগুলির গায়ে ফুটন্ত জল ঢেলে দিতে, কঙ্কালসার ষাঁড়ে ষাঁড়ে রক্তাক্ত যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়ে মজা লুঠতে। তিনি শিষ্যদের বলেছিলেন, “মানবজাতি, চিরকাল গরুদের ব্যবহারই করে গেলো, কখনও তাদের জীবন ও অবদানের কথা ভাবল না।”

খিদের জ্বালায় প্লাস্টিক খাচ্ছে পরিত্যক্ত গরু

সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন সন্ন্যাসী দত্ত শরণানন্দ। আটটি গাভিকে উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছিলেন আনন্দবনে। ছায়াঘেরা আনন্দবনে মনের আনন্দে থাকতে শুরু করেছিল মালিক পরিত্যক্ত গাভিগুলি। গরম, রোদ ও বর্ষার হাত থেকে তাদের রক্ষা করে চলেছিল শ্রীকৃষ্ণের পাদস্পর্শে ধন্য আনন্দবন। গাভিগুলির সেবার সব ব্যাবস্থা নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন স্বামীজি। তাঁকে দেখে এগিয়ে এসেছিলেন গোভক্তের দল। গাভীদের সেবার সব খরচ তাঁরাই নির্বাহ করে চলেছিলেন। এর পর আনন্দবনে আশ্রয় পেয়েছিল, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসা অপুষ্টিতে ভোগা, রোগগ্রস্থ, দৃষ্টিহীন, বিকলাঙ্গ, অত্যাচারিত, ক্যানসারে আক্রান্ত গরুরা। এভাবেই আনন্দবনে গড়ে উঠেছিল গরুদের অনাথাশ্রম ‘শ্রী গোধাম মহাতীর্থ আনন্দবন পাথমেড়া’। যেখানে ভক্তিযোগের সঙ্গে মিশে গেছিল কর্মযোগ।

আনন্দবনে নির্ভয়ে ঘুরছে গরুগুলি

আটটি গরু নিয়ে শুরু করা গোশালাটির গরুর সংখ্যা, ১৯৯৯ সালে পৌঁছে ছিল নব্বই হাজারে। ২০০০ সালে এক লক্ষ ছিয়াত্তর হাজারে। ২০০১ সালে দু’লক্ষ পনেরো হাজারে। ২০০৩ সালে দু’লক্ষ চুরাশি হাজারে। অর্থ সমস্যা না হলেও বড় সমস্যা হয়ে উঠেছিল স্থানাভাব ও লোকবল। এতগুলি গরুর সমান যত্ন নেওয়া কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তাই স্বামীজি ‘শ্রী গোধাম মহাতীর্থ আনন্দবন পাথমেড়া’র ছত্রছায়ায় উত্তর ভারত জুড়ে গড়ে তুলতে লাগলেন আরও গোশালা। নবনির্মিত গোশালাগুলিতে পুনর্বাসনের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হতো কিছু পরিত্যক্ত গরুকে। গোশালার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে আজ প্রায় পাঁচ হাজার। পরিত্যক্ত গরুদের সেবা আজ এক আন্দোলনের রূপ নিয়েছে।

পাথমেড়া গোশালার একটি অংশ

রোজ কাকভোরে শুরু হয় ‘শ্রী গোধাম মহাতীর্থ আনন্দবন’ গোশালার কর্মযজ্ঞ। ভোর থেকেই আশ্রমের দরজায় লাইন দেন করসেবকেরা। তাঁরা দিনভোর অসহায় গরুদের নিঃস্বার্থভাবে সেবা করেন। গোশালায় থাকেন সাধু ও ব্রহ্মচারীরা। থাকেন সংসারত্যাগী প্রচুর বৃদ্ধ বৃদ্ধা। থাকেন প্রায় দু’হাজার কর্মচারী। সবাই মিলে শুরু করেন, আশিটি ছাউনিতে থাকা গরুদের সেবা যত্ন। গরুদের জন্য পুষ্টিকর খাবার নিয়ে গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে থাকে একের পর এক ট্রাক। রাস্তায় পড়ে থাকা অসুস্থ্ কোনও গরুকে গোশালায় আনার জন্য হুটার বাজিয়ে ছুটে যায় অ্যাম্বুল্যান্স।

চলছে পরিত্যক্ত গো-শাবককে বাঁচানোর চেষ্টা

ধন্বন্তরি সেবা কেন্দ্রে গরুদের চিকিৎসা বা অস্ত্রপচারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন পশু চিকিৎসক ও নার্সের দল। পশুদের সর্বাধুনিক চিকিৎসারও পরিকাঠামো আছে এখানে। যেখানে একহাজারেরও বেশি অসুস্থ গরুর চিকিৎসা করা হয়। ধন্বন্তরি সেবা কেন্দ্রে ক্যানসার বিভাগে দেখা মিলবে ক্যানসারে আক্রান্ত গরুদের। সব থেকে করুণ অবস্থা দৃষ্টিহীন গরুদের। তবে সব থেকে বেশি যত্ন নেওয়া হয় তাদের দেখভাল করার জন্যই।

cow with cancer getting treatment
ধন্বন্তরি সেবা কেন্দ্রে ক্যানসার আক্রান্ত এক গরুর শিঙে অস্ত্রপচারের পর

ভক্তি যোগ ও কর্মযোগের সঙ্গে আনন্দবনে স্বামীজি মিশিয়েছেন বিজ্ঞানকে। ভারতে আছে প্রায় ৩৭ জাতের গরু। শাহীওয়াল, গির, লাল সিন্ধি, থরপার্কার, রথী, আরও কত নাম তাদের। কিন্তু উপেক্ষায় ও অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে বেশ কিছু জাতের গরু। তাই অবলুপ্ত হওয়ার হাত থেকে গরুগুলিকে বাঁচাতে স্বামীজি শুরু করেছিলেন উন্নতমানের গো-প্রজনন কেন্দ্র। উন্নতমানের প্রজননের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল উন্নতমানের গো-শাবক। শাবকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার পর, কিছু শাবককে দিয়ে দেওয়া হত গো-পালকদেরকে। তবে শর্ত একটাই, বিক্রি ও অত্যাচার করা চলবে না। পালন করতে না পারলে স্বামীজিকে ফেরত দিতে হবে। স্বামীজির শিষ্যেরা মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসেন কেমন আছে শাবকের দল।

জন্ম নিয়েছে লুপ্তপ্রায় জাতের শাবকেরা

এছাড়া গোশালায় দিনে প্রায় কুড়ি টন জৈব সার উৎপাদিত হয়। সেই সার ব্যবহার করা হয় আশ্রমের কৃষি জমিতে। স্বল্প মূল্যের বিনিময়ে দেওয়া হয় স্থানীয় চাষিদেরও। আশ্রমে আছে পঞ্চগব্য কেন্দ্র। সেখানে তৈরি হয় ঘি থেকে শুরু করে নানান ওষুধপত্র। লাভের পুরোটাই খরচ করা হয় গরুগুলির সেবায়। এ ব্যাপারে আশ্রম কতৃপক্ষ অত্যন্ত কঠোর।

তবে এক ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সাক্ষী এই গোশালা। সতর্ক না করেই ২০১৭ সালে জুলাই মাসে, জালোরের পাঞ্চালা জলাধার থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল কয়েক লক্ষ কিউসেক জল। হড়পা বানে ডুবে গেছিল জালোর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যে সাত আট ফুট জলের নীচে ডুবে গেছিল আনন্দবন গোশালা। প্রাণ হারিয়েছিল হাজারের বেশি গরু। সেদিন আত্মীয় বিয়োগের কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন আশ্রমিকেরা। প্রবল বিপর্যয়ের পর ঘুরে দাঁড়াতে সময় লেগেছিল। কিন্তু হাল ছাড়েননি আশ্রমিকেরা। আজও তাই আনন্দবনে গেলে দেখা মিলবে নব্বই হাজার পরিত্যক্ত গরুর।

তবে আর পরিত্যক্ত নয়, আছে আশ্রয়

রোজ গোধূলির সময় এক অনবদ্য দৃশ্যের সাক্ষী থাকে আনন্দবন। মরুভুমির রক্তিম আকাশে ডুবতে থাকে নিস্তেজ সূর্য। আসন্ন সন্ধ্যাকে সাজিয়ে তোলার প্রস্তুতি নেয়, আনন্দবনে ফিরতে থাকা পাখিদের কলরব ও জোনাকি পোকার ঝলমলে চাঁদোয়া। ঝিঁ ঝিঁ ডাকা আনন্দবন থেকে ছাউনিতে ফিরতে থাকে কামধেনু, কপিলার নব্বই হাজার বংশধর। লাল ধুলোয় ঢেকে যায় আকাশ। মন হারিয়ে যায় দ্বাপর যুগে। ঠিক তখনই হয়ত কোনও স্থানীয় চারণকবি গেয়ে ওঠেন,

“কো কবি বর্ণন কর সকে, পাথমেড়া কা মূল

ইসকে কোণ কোণ মে বসি হ্যায়, কৃষ্ণ চরণ কি ধূল।”

You might also like