
দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ভিতর রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হওয়া অসংখ্য জাহাজ ও বিমানের ‘অন্তর্ধান রহস্য’ খুঁজতে গিয়ে অনেকগুলো তত্ত্ব দাঁড় করানো হয়েছে। সেগুলি পড়ে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গল কী মহাকাশের ব্ল্যাক হোলের মতোই সব কিছু গিলে নেয়! সত্যিই কি এই ত্রিভুজের ভিতর প্রবেশ করলে মৃত্যু অনিবার্য?
জুলেভার্ন, এইচ জি ওয়েলস, অ্যাসিমভ, আর্থার সি ক্লার্ক,দানিকেন-সহ বিভিন্ন লেখকের অমর রচনায় বারে বারেই জায়গা করে নিয়েছে বারমুডা রহস্য। এই রহস্যের পিছনে কি রয়েছে বিজ্ঞান, তা নিয়ে মতান্তরও কিছু কম নয়। অনেকেই আবার ব্ল্যাক ম্যাজিকের তত্ত্ব খাড়া করে নানা রকম মশলা মিশিয়ে রহস্যকে বেশ কয়েক ডিগ্রি উস্কে দিয়েছে।
কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষদের মন থেকে অন্ধকার হটাতে এগিয়ে এসেছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু, মাকড়শার জালে আটকে পড়া পতঙ্গের মতোই তাঁরা বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যের জালে জড়িয়ে গেছেন। চলুন একে একে তত্ত্ব ও তথ্যের মোড়ক খুলে দেখা যাক কী জটিল রহস্য লুকিয়ে আছে প্রকৃতির অন্দরে এবং অবশ্যই মানুষের মনের গভীরে।অতিপ্রাকৃতিক ও আজগুবি তত্ত্ব
কেউ বলেছেন, ডুবে যাওয়া নগরী অাটলান্টিস থেকে নাকি অপদেবতারা আগুনের গোলা ছোঁড়েন। সমুদ্রগর্ভ থেকে উঠে আসে সেই সব আগুনের গোলা। আবার কারওর মত, সমুদ্রে নেমে আসা ভিনগ্রহের মহাকাশযান নাকি ধ্বংস করে দেয় জাহাজ ও বিমানগুলিকে।
কেউ বলেন, সাগরের নীচে থাকা চুম্বক-পাহাড় নাকি লোহার জাহাজ আর বিমানকে আকর্ষণ করে জলে আছড়ে ফেলে। ফোর্থ ডাইমেনশন বা চতুর্থ মাত্রার প্রসঙ্গও উঠেছে। মনে করা হয়, সময়ের এক অনন্ত ফাটল বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে সক্রিয় থাকে। জাহাজ ও বিমান, সময়ের সেই রহস্যময় ফাটলে পড়ে হারিয়ে যায় বর্তমান কালের কাছ থেকে। তারা চলে যায় সুদূর অতীতের কোনও সময়ে, নয়তো ভবিষ্যতের গর্ভে।
দোষ চেপেছে মানুষের ঘাড়ে
দৃষ্টি বিভ্রম
বিমান ও জাহাজের দুর্ঘটনায় পড়ার কারণ হিসেবে মানুষের ভুলকেও দায়ী করা হয়েছে। বেশিরভাগ নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার তদন্তে নাকি দেখা গিয়েছে, অধিকাংশ দুর্ঘটনা চালকের ভুলের কারণে হয়েছে। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ভেতরে থাকা দ্বীপগুলি সবই প্রায় এক রকমের দেখতে। সঠিক দিক নির্ণয় করতে না পেরে, জাহাজের ক্যাপ্টেনরা ভুল দিকে জাহাজ ঘুরিয়ে চলে গিয়েছিলেন হয়তো। এ ভাবেই জাহাজগুলি ধীরে ধীরে এমন এলাকায় প্রবেশ করেছিল, যেখান থেকে তীর অনেকটাই দূরে। তাই হয় তীরে ফেরার আগেই জ্বালানি শেষ হয়ে যায়, অথবা অন্যান্য আবহাওয়া জনিত দুর্ঘটনার কবলে পড়ে যায় জাহাজগুলি।
১৯৭২ সালে ভি.এ. ফগ ( V.A. Fogg)-এর নিখোঁজ হওয়ার কারণ হিসেবে আমেরিকান কোস্ট গার্ডের ধারণা ছিল অন্য। মানুষের ভুলে জাহাজে থাকা ‘বেনজিন‘ -এ বিস্ফোরণ ঘটে ডুবে গিয়েছিল ‘ভি.এ. ফগ’ নামের জাহাজটি। আবার ফ্লাইট-১৯ হারিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রেনার পাইলটের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসকে দায়ী করেছেন কেউ কেউ।
যুদ্ধ বা শত্রুতা
যুদ্ধের সময় অনেক জাহাজ শত্রু পক্ষের অতর্কিত আক্রমণে ডুবে গিয়ে থাকতে পারে বলে মনে করা হয়। এ কারণেও জাহাজ বা বিমান নিখোঁজ হতে পারে বলে অনেকের ধারণা। যেমন মনে করা হয় ১৯১৮ সালে ইউ এস এস সাইক্লপস ( USS Cyclops) এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সিস্টার শিপ প্রোটিয়াস (Proteu) এবং নিরিয়াস ( Nereus)-কে জার্মান সাবমেরিন ডুবিয়ে দেয়। কিন্তু পরবর্তীকালে জার্মান রেকর্ড ঘেঁটেও এর সত্যতা প্রমাণ করা যায়নি।
জলদস্যু এবং মাফিয়া
অনেকে বলেছেন, জলদস্যুদের আক্রমণে অনেক জাহাজ নিখোঁজ হয়ে থাকতে পারে। সে সময়ে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমাংশে এবং ভারত মহাসাগরে মালবাহী জাহাজ চুরি খুব সাধারণ ঘটনা ছিল। ১৫৬০ থেকে ১৭৬০ পর্যন্ত ক্যারিবিয়ান অঞ্চল ছিল জলদস্যুদের আখড়া। কুখ্যাত জলদস্যু এডওয়ার্ড টিচ (Blackbeard)) এবং জেন ল্যাফিট্টি ছিলেন এই অঞ্চলের বিভীষিকা। জলদস্যুরা সমুদ্রের ধারে রাতে আলো জ্বালিয়ে জাহাজের নাবিকদের বিভ্রান্ত করত।
নাবিকরা ওই আলো দেখে লাইট হাউস মনে করে সেদিকে এগিয়ে যেত, এবং ফাঁদে পড়ে সমুদ্রের গভীরে লুকিয়ে থাকা ডুবোপাহাড়ের ধাক্কা খেয়ে ডুবে যেত। ডোবা জাহাজের মালপত্র ঢেউয়ে ভেসে তীরে এলে দস্যুরা সেগুলো নিয়ে নিত। এও শোনা যায়, এই অঞ্চলের কুখ্যাত মাদক চোরাচালানকারীরা সুবিধা মত জাহাজ, নৌকা, ইয়ট ইত্যাদি চুরি করত মাদক চোরাচালানের জন্য। যাতে সেটা নির্বিঘ্নে করা যায়, তাই তারা বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের গল্প লিখিয়েছিল নিজস্ব লেখকদের দিয়ে।
অপরাধীর কাঠগড়ায় যখন প্রকৃতি
জলের নীচে থাকা বিপজ্জনক প্রবালপ্রাচীর
সমুদ্রের একদম তলদেশ থেকে উঠে আসা এই প্রবাল প্রাচীরগুলির অগ্রভাগ থাকে সমুদ্রের জলস্তরের ফুট দুয়েক নিচে। আগেকার দিনে কম্পাস ও আকাশের তারা দেখে দিক ঠিক করত জাহাজগুলি। সমুদ্রের ঠিক কোন এলাকায় ঘাপটি মেরে লুকিয়ে রয়েছে বিপদ, সেটা বোঝার মতো প্রযুক্তি তখন ছিল না। ফলে জলস্তরের নীচে থাকা প্রবালপ্রাচীরে ধাক্কা লেগে সলিলসমাধি হত অধিকাংশ জাহাজেরই। বর্তমানে স্যাটেলাইট ও GPS ডিভাইসের কল্যাণে এই ধরনের বিপদ এড়ানো সম্ভব হয়েছে।
সারগাসো সমুদ্র
এটি হলো বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মধ্যবর্তী আটলান্টিক সমুদ্রের মধ্যে থাকা আর একটি অদ্ভুত সমুদ্র। চারদিকে কোনও তীর নেই। এটা প্রকৃতির তৈরি ফাঁদ। এই এলাকায় একবার ঢুকে পড়লে জাহাজ বা বোট আর নিজের ইচ্ছায় চলতে পারে না। জলের ইচ্ছায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে ভেসে বেড়াতে হয়। পরিশেষে,জল ও খাবার ফুরিয়ে মরতে হয় নাবিকদের। অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ গ্রাস করে তাদের।
জলের দানব ঘূর্ণি
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের পশ্চিম প্রান্তে এক অদ্ভুত জিনিস দেখা গেছে। এখানে জলে তৈরি হওয়া অতিকায় ঘূর্ণিগুলি প্রচন্ড শক্তিশালী। এরা আশপাশে থাকা জাহাজগুলিকে অনায়াসে তার অতলস্পর্শী গহ্বরে টেনে নিতে পারে। প্রাচীন যুগের মানুষরা এই অতিকায় ঘূর্ণি দেখেই সমুদ্রের নিচে থাকা দৈত্যের কথা বলতেন।
নীল গহ্বর
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কালচে-নীল জলের তলায় রয়েছে অজস্র গুহা। ভৌগোলিক কারণে এগুলির আকার হয় বোতলের মতো। বোতলের মুখটা থাকে উপরের জলস্তরের ঠিক নীচে। এই বোতলগুলির নিচ দিয়ে আবার সুড়ঙ্গ পথ আছে। যেগুলি সংযুক্ত থাকে অন্য বোতল গুহার সঙ্গে। এগুলিকে নীল গহ্বর বলা হয়। যেগুলির মধ্যে বিচিত্রভাবে সমুদ্রের জল ঘোরাফেরা করে। নানা সময় তারা ভয়ঙ্কর শক্তিশালী স্রোত তৈরি করে সব কিছু টেনে নেয় নিজেদের ভেতরে।
বিস্ময়কর তলদেশ
বারমুডা ট্রায়াঙ্গল হিসেবে যে এলাকাকে চিহ্নিত করা হয়, আটলান্টিক মহাসাগরের সেই অংশের তলদেশের গঠন কিছুটা বিস্ময়কর। বিজ্ঞানীরা Sonar Mapping প্রযুক্তিতে বা শব্দ তরঙ্গ ছুঁড়ে তৈরি করা ম্যাপে কিছু অস্বাভাবিক বৈচিত্র বা বৈশিষ্ট্য পেয়েছেন। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ভেতরে ভয়ঙ্কর কিছু খাদ পাওয়া গেছে যেগুলি বেশ গভীর। এর ভেতরে জাহাজ বা বিমান ডুবে গেলে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কারণ এগুলির তলদেশে পৌঁছনো এখনও সম্ভব হয়নি।
গালফ স্ট্রিম
গালফ স্ট্রিম হল, মেক্সিকো উপসাগর থেকে Straits of Florida হয়ে উত্তর আটলান্টিকের দিকে প্রবাহিত উষ্ণ জলের স্রোত। বলা যেতে পারে মহাসাগরের মাঝে থাকা এক নদী। নদীর স্রোতের মতোই গালফ স্ট্রিম ভাসমান বস্তুকে স্রোতের দিকে ভাসিয়ে নিতে পারে। এমনই নাকি ঘটেছিল ১৯৬৭ সালের ২২ ডিসেম্বর। উইচক্রাফট নামের একটি প্রমোদতরী মিয়ামি উপকূল থেকে কয়েক মাইল দূরে ইঞ্জিনের সমস্যায় পড়ে। জাহাজের ক্যাপ্টেন তখন জাহাজটির অবস্থান মিয়ামি কোস্ট গার্ডকে জানায়। কিন্তু কোস্ট গার্ডরা সেখানে দ্রুত পৌঁছেও জাহাজটিকে খুঁজে পায়নি।
বিস্ময়কর আবহাওয়া
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ছোটো এলাকা জুড়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে বিপজ্জনক ঝড় উঠতে পারে। ফলে আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা ঝড়ের আগাম সতর্কতা দিতে পারেন না। স্যাটেলাইটও ওই এলাকার আবহাওয়ার গতি প্রকৃতি চিহ্নিত করতে পারে না। কিন্তু এই মারাত্মক ঝড়গুলি মুহূর্তের মধ্যে জাহাজ ও বিমান ধ্বংসের শক্তি রাখে। তা ছাড়াও এই এলাকায় দেখা যায় সামুদ্রিক টর্নেডো। যার ফলে সমুদ্রের জলে তৈরি জলস্তম্ভ আকাশ ছোঁয়। তার গতিপথে জাহাজ ও বিমান এসে পড়লে ধ্বংস অনিবার্য।
কম্পাসের গন্ডগোল
চুম্বকের উত্তর মেরু আর ভৌগোলিক উত্তর মেরু এক নয়। এর অর্থ হলো কম্পাস যেটাকে উত্তর (Magnetic North)দেখায়, সেটাই ভৌগোলিক উত্তর (True Geographic North Pole) নয়। সুতরাং, প্রতিমুহূর্তে দুই উত্তরের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে চলতে হয় জাহাজদের। কিন্তু, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ভেতরে একটি সঙ্কীর্ণ স্থানে কম্পাসের উত্তর মেরু ও ভৌগোলিক উত্তর মেরু এক হয়ে যায়। ফলে জাহাজ বা বিমান সঠিকভাবে দিক চিনতে না পারার জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভুল দিকে এগোয় ও ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।
হারিকেন
শক্তিশালী সামুদ্রিক ঝড় হলো হারিকেন। আটলান্টিক মহাসাগরে, বিষুব রেখার কাছাকাছি অঞ্চলে,শক্তিশালী হারিকেনের কারণে সমুদ্র ও তটভূমিতে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। রেকর্ড থেকে জানা যায়, ১৫২০ সালে স্প্যানিশ নৌবহর ফ্রান্সিসকো দ্য বোবাডিলা এমনই একটি বিধ্বংসী হারিকেনের কবলে পড়ে ডুবে যায়। তাই অনেকের মতে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কাহিনীর সঙ্গে জড়িত ঘটনাগুলির জন্য দায়ী হারিকেন।
সমুদ্রতলের ভূমিকম্প
বিজ্ঞানীরা বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের জলের নীচে অদ্ভুত সব কম্পন লক্ষ করেছেন। সেগুলি বেশ বড় মাপের ভূমিকম্প। এই ভূমিকম্পের ফলে সাগরজলে সুনামি দেখা দেয় কখনও কখনও। জাহাজডুবির কারণ হিসেবে সুনামিকেও দায়ী করেছেন অনেকে।
বিজ্ঞান যখন সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের ভূমিকায়
Helen Czerski নামে এক পদার্থবিজ্ঞানী এবং সমুদ্রবিদ এই তত্ত্ব মেনে নেন এবং একটি ভিডিওর সাহায্যে সেই তত্ত্বের ব্যাখ্যাও দেন।
ইলেকট্রনিক কুয়াশা ও হাচিসন এফেক্ট
কানাডার স্বঘোষিত আবিষ্কারক ও বিজ্ঞানী John Hutchison একটি পরীক্ষায় ইলেকট্রনিক কুয়াশা তৈরি করে দেখিয়েছিলেন। সেই কুয়াশার ভেতরে প্রবেশ করলে যে কোনও বৈদ্যুতিক যন্ত্র উল্টোপাল্টা কাজ করতে শুরু করে। অনেক বিজ্ঞান অনুরাগী বারমুডা ট্রায়াঙ্গল রহস্যকে হাচিসন এফেক্টের সঙ্গে জুড়তে চেয়েছেন। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ভেতরে এরকমই কোনও ইলেকট্রনিক কুয়াশা তৈরি হয়, এবং এই বিপজ্জনক কুয়াশা, জাহাজ ও বিমানগুলির কলকব্জা বিগড়ে দিয়ে তাদের দুর্ঘটনায় ফেলে।
দস্যু ঢেউ
ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের মতে ৩০ মিটার উঁচু দস্যু ঢেউ (rogue waves) বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের জাহাজডুবির কারণ। ব্রিটেনের সাউদাম্পটন ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন ভয়ানক এই ঢেউ তত্ত্বে। ১৯৯৭ সালে সাউথ আফ্রিকার তটভাগে নাকি সেই ঢেউ দেখা গিয়েছিল। The Bermuda Triangle Enigma নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন কী ভাবে ইন্ডোর সুইমিংপুলে সিমুলেটরের সাহায্যে দৈত্যকার ঢেউ তৈরি করা যায়।
সেই ঢেউয়ের সাহায্যে রিসার্চ টিম USS Cyclop এর মডেল জাহাজ ডুবিয়েছেন। কেন ওঠে এই ঢেউ? সাউদাম্পটন ইউনিভার্সিটির সমুদ্রবিজ্ঞানী ডঃ সাইমন বক্সাল বলেছেন, এই ভয়ঙ্কর এলাকায় তিন দিক থেকে তিনটি মারাত্মক ঝড় এক সঙ্গে আসতে পারে। যা ‘দস্যু ঢেউ’ বা rogue wave তৈরি করতে পারে। তিনি বিশ্বাস করেন বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে বেশির ভাগ জাহাজ ডুবেছে এই দস্যু ঢেউয়ের জন্য।
ষড়ভূজাকৃতি মেঘ ও বাতাস বোমা
সবচেয়ে আধুনিক ও জনপ্রিয় তত্ত্বটি অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী রন্ডি সেভেনি আবিষ্কার করেছেন। তিনি বলেছেন, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে বেশিরভাগ জাহাজ ও বিমান হারিয়ে যাওয়ার পেছনে দায়ী হচ্ছে ষড়ভূজাকৃতি মেঘ আর বাতাস বোমা।
যা আচমকাই প্রকান্ড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রচন্ড গতির বাতাস পাঠিয়ে দেয় চারদিকে, এমনকি সমুদ্রের তলাতেও। ঘণ্টায় ১৭০ থেকে ২৫০ মাইল গতিসম্পন্ন বাতাসের ধাক্কায় মুহূর্তে উত্তাল হয় সমুদ্র। ১৪ থেকে ৫০ মিটার উঁচু ঢেউ তোলে। ডুবে যায় অতিকায় জাহাজও। মিসাইলের মতো ছুটে আসা বাতাসের প্রচন্ড ধাক্কায় সমুদ্রে ভেঙে পড়ে আকাশে থাকা বিমানও।
সন্দেহবাতিকদের তত্ত্ব
‘কোনও রহস্য নেই’
এই মতবাদের মানুষ ও বিজ্ঞানীরা বিশ্বাসই করেন না যে আদৌ ‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গল’ নামক কাল্পনিক ত্রিভুজটিতে আদৌ কোনও রহস্য আছে। অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি”-র রিসার্চ লাইব্রেরিয়ান Lawrence David Kusche হলেন প্রথম মানুষ যিনি ‘ বারমুডা ট্রায়াঙ্গল’ রহস্যকে গাঁজাখুরি কাহিনী বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর লেখা The Bermuda Triangle Mystery: Solved (১৯৭৫) বইতে তিনি পরিস্কার বলেছিলেন কিছু সাংবাদিক ও কল্পবিজ্ঞানের লেখক, অজ্ঞতার কারণে বা ইচ্ছাকৃত ভাবে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে রহস্য তৈরি করেছেন।
তিনি তাঁর বইয়ে বিস্তারিত ভাবে বলেছেন, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে যে পরিমাণ জাহাজ ও উড়োজাহাজ নিখোঁজ হওয়ায় কথা বলা হয় তার পরিমাণ বিশ্বের অন্যান্য সমুদ্রের তুলনায় বেশি নয়। ২০১৭ সালে, সিডনি ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী Karl Kruszelnicki বলেন “এটা পৃথিবীর ধণীতম এলাকার কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় সাগর ও আকাশ পথে ভিড় লেগেই থাকে। আপনি যদি এই অঞ্চলে একশো বছর ধরে আকাশ পথে যাওয়া বিমান ও জলপথে যাওয়া জাহাজের সংখ্যা দেখেন, তাহলে দেখবেন অন্যান্য এলাকার তুলনায় দুর্ঘটনা এখানে অনেক কম।বরং, দুর্ঘটনার শতকরা হার পৃথিবীর আর পাঁচটা জায়গার মতোই।
তাহলে কী দাঁড়ালো ?
এক বিজ্ঞানীর তত্ত্ব অন্য বিজ্ঞানী নস্যাৎ করে দিচ্ছেন। আবার কেউ বলছেন ‘কোনও রহস্যই নেই‘। একটি অঙ্ক অনেকে কষতে পারেন। কষা যদি সঠিক হয়, তাহলে উত্তরও এক হওয়া উচিত তাই না? এক্ষেত্রে হয়েছে কি? বিজ্ঞানীরা একের পর এক তত্ত্ব উগরে দিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করছেন। ল্যাবরেটরিতে বসে স্যাটেলাইটের ছবি দেখে বায়ু বোমা আর ষড়ভূজাকৃতি মেঘ তত্ত্ব আবিষ্কার করছেন। তবে, বায়ুবোমা বিস্ফোরণের প্রমাণ কিন্তু দিতে পারেননি। অনুমান করছেন মাত্র।
কেউ সুইমিংপুলের জলে নকল দস্যু ঢেউ তুলে ‘নকল সাইক্লপস’ জাহাজ ডোবাচ্ছেন, প্রমাণ দিতে পারেননি। অনুমান করছেন মাত্র। এ আর নতুন কী! হলিউডের স্টুডিওতে বসে স্পিলবার্গ এসব আগেই করেছেন। এর চেয়ে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটিয়েছেন। সব থেকে মজার কথা, বিজ্ঞানীরা কেউ কারও তত্ত্ব মানছেন না। কেউ স্বীকার করছেন না, তাঁর তত্ত্বই অভ্রান্ত। নাগাড়ে বলে যাচ্ছেন ‘এরকম হয়ে থাকতে পারে’। বিজ্ঞানই বলেছে, হতে পারে আর হয়েছে-এর মধ্যে দূরত্ব কোটি কোটি আলোকবর্ষ।
কেন এক মত হতে পারছেন না বিজ্ঞানীরা? কেন এখনও বিজ্ঞানীরা বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে গবেষণা করেই চলেছেন? আর যাঁরা বলছেন ‘কোনও রহস্যই নেই’, তাঁরা ১৯৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর, একই দিনে ২৭ জন বিমানকর্মী নিয়ে ৬টি বিমানের একই জায়গায় হারিয়ে যাওয়াকে আজ অবধি কেন ব্যাখ্যা করতে পারেননি? আসলে,মানুষকে সর্বশক্তিমান প্রমাণ করতে গিয়ে তাঁরা হেরে গেছেন প্রকৃতির কাছে। এই অমোঘ সত্যটা স্বীকার করতে এখন লজ্জা পাচ্ছেন সবাই।