
শহরবাসীর মতোই এমন ছবি দেখে আতঙ্কিত নেটিজেনরা। মানুষের রক্তে ইরাকের টাইগ্রিস নদীর জল ২০১৪ সালে লাল করে দিয়েছিল আইসিস জঙ্গিরা। সে রকমই কি কোনও গণহত্যা চলছে নদীর পাড়ে? এ শহরটার নামতো কস্মিনকালেও শোনা যায়নি! গুগল খুলে অনেকের সন্দেহ বাড়তে থাকে। শহরটা দেখতে কেমন যেন ভয়াবহ। ধোঁয়ায় ঢাকা, চারদিকে আবর্জনা। রঙহীন পুরোনো কল-কারখানা। রংচটা বাড়ি ঘর। ইন্টারনেট থেকে জানা যাচ্ছে এই শহরটির আশপাশের খনি থেকে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি নিকেল ও ক্যাডমিয়াম উৎপাদিত হয়। এই শহরটি বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর। বাতাসে সবচেয়ে বেশি সালফার ডাই অক্সাইড উগড়ে দেয় এই নরিলস্ক শহর। দূষণ এতোই বেশি যে এখানে বরফের রঙ কালো। জলের রঙ কালো। জমির রং প্রায় কালো।
এ হেন দূষিত শহরে রক্ত-লাল জল নিয়ে বইছে এক নদী! নির্ঘাত কিছু একটা হচ্ছে।
রহস্যটা কী
সেন্টার ফর সায়েন্স ইন পার্টিসিপেশন এর প্রেসিডেন্ট এবং খনি বিশেষজ্ঞ ডেভিড চেম্বার, ইন্টারনেটে নদীটির ছবি দেখেছেন। তাঁর মতে খনিজ বর্জ্যের এই ধরনের লাল রং খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। নদীটির কাছেই নিকেল নিষ্কাশনের ফ্যাক্টরি আছে। তাঁর মতে, নদীর জলের লাল রং হওয়ার পেছনে আছে খনির বর্জ্যের সঙ্গে মিশে থাকা অক্সিডাইজড আয়রন। যদিও তাঁর কাছে এটা পরিস্কার নয় কী ভাবে এটা নিকেল প্ল্যান্টের বর্জ্যে মিশছে। তবে অনুমান করা হচ্ছে প্ল্যান্টের উচ্চ তাপমাত্রা বা চাপে কিছু সালফাইড জাতীয় খনিজ পদার্থ জারিত হয়ে আয়রন অক্সাইড তৈরি করতে পারে। এটা জলের সঙ্গে মিশে উজ্জ্বল লাল বর্ণ সৃষ্টি করতে পারে। কলোরাডো স্কুল অফ মাইনের প্রফেসর রোনাল্ডো কোহেনের মতে অনেক সময় নিকেলেও প্রচুর পরিমাণে লোহা থাকতে পারে। সেটা বর্জ্য হয়ে বেরিয়ে আসে। এরকম অনেকবার হয়েছিল অন্টারিওর সাডবেরীতে। স্থানীয় নিকেল ফ্যাক্টরিগুলি এভাবেই নিকটবর্তী নদীর জলকে প্রায় এই রকম লাল করে দিয়েছিল।
দায়ী কে
রাশিয়ার সরকার এর আগে ২০১৬ সালে তদন্ত কমিশন বসিয়েছিল। রাশিয়ার পরিবেশ মন্ত্রক প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছিল, সম্ভবত নরিলস্কের একটি নিকেল কোম্পানির পাইপে থাকা ছিদ্র নদীর জল লাল হওয়ার জন্য দায়ী।
নরিলস্ক শহরে রাশিয়ার তথা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিকেল নিষ্কাশন কারখানা ‘নরনিকেল’ অবস্থিত। তদন্তে দোষী প্রমানিত হওয়ায় আর্থিক দণ্ড দেওয়া হয় কারখানাটিকে। মাত্র ৮৮০ ডলার। সরকারের কথায় ধাতু নিষ্কাশনকারী কারখানাটি কিছু প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিয়েছিল। কিন্তু এ বছরের (২০১৮) জুন মাসে আবার ডালডাইকান নদীর জল লাল হয়। জুলাই-অগস্ট মাসে নদীর জল স্বাভাবিক অর্থাৎ বর্ণহীন ছিল। এখন সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে আবার রক্তবর্ণ জল নিয়ে ছুটছে ডালডাইকান নদী।
তবুও রহস্যর কিনারা হয়নি
মজার ব্যাপার হলো যাকে পৃথিবীর সবাই আবার অপরাধী ভাবছে সেই নরনিকেল কতৃপক্ষ বলছেন, তাঁরা কোনও অন্যায় করেননি। তাঁদের জন্য নদীর জলের রঙ লাল হচ্ছে না। তাঁরা বরং নদী ও সংলগ্ন এলাকার পরিবেশের সুরক্ষায় জোর দিয়ে আসছেন। তাঁদের দাবি, এটাই ডালডাইকান নদীর জলের স্বাভাবিক রং। এই বিষয়ে তাঁদের ব্যাখ্যা,উত্তর মেরুর কাছে থাকার জন্য নরিলস্ক শহরে প্রায় সারা বছর বরফ পড়ে। সেই বরফগলা জল, সোভিয়েত আমলে গড়ে ওঠা প্রাচীন এই শহরে জমে থাকা পুরোনো বর্জ্যগুলিকে নদীতে এনে ফেলছে। তাই নদীর জল লাল। কেউ বলছে নদী থেকে কিছু দূরে একটি রক্তলাল হ্রদ আছে। কোনও ভাবে হ্রদের লাল জল নদীতে এসে মিশছে। কিন্তু হ্রদের জল কেন লাল,তার কোনও ব্যাখ্যা এখনও পাওয়া যায়নি।
শহরের কিছু প্রবীণ বাসিন্দারা সোশ্যাল মিডিয়াতে জানিয়েছেন, ছোট বেলায় তাঁরা ছড়া কাটতেন, “বসন্ত এসে গেলো , ডালডাইকান লাল হলো”। কিন্তু তখন তো নরনিকেল কারখানাটি ছিলো না। তাহলে নদীর জল লাল হতো কী ভাবে? কোটি ডলারের প্রশ্ন এখন এটাই। উত্তর জানে একজনই। হিমশীতল রক্তধারার মতো বইতে থাকা ডালডাইকান নদী।