প্রথম যৌবনে অবিস্মরণীয় বাঙালি সঙ্গীত পরিচালক সলিল চৌধুরীর সহকারী হয়ে কাজ করতে করতে ফিল্মে সঙ্গীত পরিচালক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন রবীন ঘোষ। ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে পাকিস্তানের ফিল্ম ডিরেক্টর এহতেশাম সাহেব ঢাকায় আসেন। তিনি রবীন ঘোষকে তাঁর বাংলা ছবি ‘রাজধানীর বুকে‘-এর মিউজিক ডিরেক্টর হওয়ার প্রস্তাব দেন। এই ছবির গান সুপারহিট হওয়ার পর, ফিল্ম ডিরেক্টর এহতেশামের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে রবীন ঘোষ চলে আসেন পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে।।
শুরু হয় সূরের মূর্ছনায় এক বাঙালির পাকিস্তান দখলের পালা। তাঁর সুর দেওয়া প্রথম সুপারহিট ছবিটি ছিল চকোরি (১৯৬৭)। সেই ছবিতে তাঁর সুরে ‘জাঁহা তুম উঁহা হাম‘ গেয়েছিলেন পাকিস্তানের সেরা প্লে-ব্যাক সিঙ্গার, পাকিস্তানের মহম্মদ রফি আহমেদ রুশদি। এর পর রবীন ঘোষকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। শুধু তাঁর সুর দেওয়া গানের জন্যই ছবি হিট হতে থাকে পাকিস্তানে।
[caption id="attachment_200649" align="alignnone" width="1024"]
চান্দা (১৯৬২), তালাশ (১৯৬৩),প্যায়সা (১৯৬৪), ভাইয়া (১৯৬৬), চকোরি (১৯৬৭), এহসাস (১৯৭২), চাহাত (১৯৭৪),আইনা (১৯৭৭), বন্দিশ(১৯৮০), দুরিয়াঁ (১৯৮০), স্রেফ সুরের জোরে পাকিস্তানের চলচ্চিত্র জগতকে একের পর এক হিট ছবি দিয়ে গেছেন রবীন ঘোষ । প্রায় একশোর বেশি হিট পাকিস্তানি ছবিতে সুর দিয়েছেন।
‘তুম মেরে হো’ (১৯৬৮) ছবির পর লাহোর থেকে রবীন ঘোষ করাচিতে চলে আসেন। কারণ, করাচিতে তখন প্রচুর বাঙালি এসে গেছেন। তাঁর জীবনের সেরা মিউজিকাল হিটটি দেন ১৯৭৭ সালে। ছবির নাম ছিল ‘আয়না‘। ছবিটি ছিল পাকিস্তান ফিল্ম জগতের প্রথম প্ল্যাটিনাম জুবিলি ফিল্ম। পাকিস্তানি ফিল্ম জগৎ, এমন কি পাকিস্তানের কুখ্যাত মিডিয়া পর্যন্ত, পাকিস্তানের সেরা হিট মিউজিক্যাল ফিল্মের তালিকায় এক নম্বরে রাখেন আয়না ছবিটিকে।
[caption id="attachment_200647" align="alignnone" width="736"]
পাকিস্তানের ফিল্ম জগতে আজ অবধি প্রচুর মিউজিক ডিরেক্টর এসেছেন। তবুও পাকিস্তানের সেরা মিউজিক ডিরেক্টরের তালিকায় রবীন ঘোষের নামটি সবসময় প্রথম দিকেই থাকে। শরাফত ছবির ‘যাও তুমহে পেহচান লিয়ে’, জঞ্জির ছবির ‘গুলবাহার, ম্যায় হুঁ গুলবাহার’, জমিন আসমান ছবির ‘তুঝসে উমিদ নেহি, ও মেরা বচপন’, অঙ্গার ছবিতে প্রবাদপ্রতীম গায়িকা নূরজাহান-এর কণ্ঠে ‘চিটঠি জরা সাইদিকা নাম লিখদে’, আয়না ছবিতে গজল সম্রাট মেহেদী হাসান-এর কণ্ঠে ‘মুঝে দিলসে না ভুলানা’ এবং ‘ওয়াদা করো সাজনা’ প্রভৃতি গান এখনো পাকিস্তানের আপামর জনগণের মুখে মুখে ফেরে।
ভারতের যেমন ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড, পাকিস্তানে তেমন নিগার অ্যাওয়ার্ড। বাঙালি রবীন ঘোষ, পাকিস্তানের বুকে দাঁড়িয়ে এবং পাকিস্তানি সঙ্গীত পরিচালকদের হারিয়ে ছ’ ছটি নিগার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন। তালাশের জন্য ১৯৬৩ সালে, চকোরি (১৯৬৭), চাহাত ( ১৯৭৪), আয়না (১৯৭৭),বন্দিশ(১৯৮০) এবং দুরিয়াঁ ছবির জন্য ১৯৮৪ সালে।
করাচি থেকে ঢাকায় আসতেন নিয়মিত। বাংলা ছবিতে ফিল্ম ডিরেক্টর হয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও, বেশি বাংলা ছবিতে সুর দিতে পারেননি, পাকিস্তানি ছবির চাপে। তবুও আপোষ (১৯৮৭) ছবিতে ‘ও আমার প্রাণেরও সুজন’ গানটি সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে বাঙালির হৃদয়ে দোলা লাগিয়েছিল।
[caption id="attachment_200664" align="alignnone" width="660"]
রবীন ঘোষের সুরে হারানো দিন ছবির ‘আমি রূপ নগরের রাজকন্যা’, নাচের পুতুল ছবির ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’ গানগুলি সুপারহিট হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম গুলিতে ছাত্ররা গাইত রবীন ঘোষের সুর দেওয়া ‘পিচ ঢালা এই পথটারে ভালবেসেছি’ গানটি। তবে, পাকিস্তানের সেরা মিউজিক ডিরেক্টর রবীন ঘোষের জীবনের শুরুর ছবিটির মতো শেষ ছবিটিও ছিলো বাংলাভাষায়। জীবনের শেষবারের মতো বাঙলা ছবিতেই সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন, ছবির নাম ছিল আমার সংসার (১৯৯২)।
[caption id="attachment_200669" align="alignnone" width="400"]
পাকিস্তানের সেরা সঙ্গীত পরিচালক রবীন ঘোষ,তাঁর বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী স্ত্রী শবনম’কে নিয়ে ১৯৯৮ সালে স্থায়ীভাবে ফিরে এসেছিলেন বাংলাদেশে। আর গানে সুর দিতেন না। ছিলেন বিশ্রামে। ২০১৬ সালে ঢাকার গুলশনে ৭৮ বছর বয়সে প্রয়াত হন এই উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মিউজিক ডিরেক্টর রবীন ঘোষ।
যাঁর সুর পাকিস্তানে পরিচিত ছিলো ‘সিরাপি’ হিসেবে। কারণ সিরাপের মতোই মিষ্টি সুর দিতেন। তাঁর মৃত্যুর পর পাকিস্তানের বিখ্যাত পত্রিকা ডন লিখেছিল , সুরের জাদুতে একই সময় দুটি পৃথক রাষ্ট্রকে (১৯৭১ পরবর্তী) মুগ্ধ করেছেন এক ব্যক্তি, এরকম উদাহরণ বিশ্বে বিরল।
[caption id="attachment_200671" align="alignnone" width="731"]
‘ডন’পত্রিকাটি তাঁর সুরারোপিত সেরা দশটি গানের লিস্ট তৈরি করেছিল পাকিস্তানের জনমত অনুসারে। সেই দশটি গান হল,
কভি তো তুমকো ইয়াদ আয়েগি – গায়ক আহমেদ রুশদি (চকোরী, ১৯৬৭)
হামে খোকর বহত পচতাওগে – গায়িকা রুনা লায়লা (এহসাস, ১৯৭২)
সাওন আয়ে – গায়ক গায়িকা ইখলাক আহমেদ ও রুনা লায়লা, (চাহত ১৯৭৪)
পেয়ার ভরে দো শর্মিলে নয়ন- গায়ক মেহেদী হাসান (চাহত ১৯৭৪)
দেখো ইয়ে কোন আগায়া– গায়ক ইখলাক আহমেদ (দো সাথী,১৯৭৫)
মুঝে দিল সে না ভুলানা – বিভিন্ন শিল্পী (আয়না ১৯৭৭)
কভি ম্যায় সোচতা হুঁ -গায়ক মেহদী হাসান (আয়না, ১৯৭৭)
মিলে দো সাথী– গায়ক এ, নাইয়ার ( অম্বর,১৯৭৮)
সোনা না চান্দি না কোই মহল- গায়ক ইখলাক আহমেদ (বন্দিশ ১৯৮০)
শাম্মা, উয়ো খোয়াব সা শাম্মা – গায়ক ইখলাক আহমেদ (নহি আভি নহি, ১৯৮০)
কিন্তু একটাই দুঃখ, বাঙালি হয়েও পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সিনেমায় আমরা রবীন ঘোষকে পেলাম না। ভাবুন তো পর্দায় উত্তমকুমারের লিপে মান্না দে’র কণ্ঠে রবীন ঘোষের ‘সিরাপি’ সুর। অবাক লাগে, কেউ কেন ভাবেননি এই কম্বিনেশন! আকাশছোঁয়া আক্ষেপটা তাই থেকেই গেল।