
রূপাঞ্জন গোস্বামী
আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে অবস্থিত ডেথ ভ্যালি হলো পৃথিবীর উষ্ণতম অঞ্চল। বাটির মতো দেখতে এই উপত্যকাটি প্রায় প্রাণহীন। উদ্ভিদ ও প্রাণীদের বাঁচার জন্য ন্যূনতম রসদও দেয় না এই মৃত্যু উপত্যকা। তাই ২২৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৮ থেকে ২৪ কিলোমিটার প্রস্থের এই উপত্যকাটি কুখ্যাত ডেথ ভ্যালি নামে। এখানকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা আছে ৫৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯১৩ সালের গ্রীষ্মে এটা রেকর্ড করা হয়েছিল। ডেথ ভ্যালির গরমের কাছে হার মেনেছে আফ্রিকার সাহারা, কালাহারি কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের মরু অঞ্চলগুলিও। এখনকার গড়পড়তা তাপমাত্রা ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বার্ষিক বৃষ্টিপাত মাত্র পাঁচ সেন্টিমিটার। গোটা উপত্যকায় আছে গুটিকয়েক জলাশয়, তাও লবণাক্ত জলের, তাই পানের অযোগ্য। বালি, কাঁকর, পাথর, ন্যাড়া পাহাড় ছাড়া আর কিছুই নেই উপত্যকায়। তাই আজও প্রাণহীন সবুজ পৃথিবীর তামাটে হলুদ এই উপত্যকাটি।
রেসট্র্যাক প্লায়ার চলমান পাথর
১৯৪৮ সালে ডেথ ভ্যালিতে অভিযান চালান একদল অভিযাত্রী। তাঁরা ডেথ ভ্যালির ভেতরে একটি রহস্যময়, জলশূন্য হ্রদ খুঁজে পান। হ্রদটির দৈর্ঘ্য সাড়ে ৪ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ২ কিলোমিটার। হ্রদটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,১৩০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। হ্রদটির কাছে যেতে গেলে দুর্গম পথে গাড়িতে তিন ঘণ্টার সফর পার করতে হয় অভিযাত্রীদের। হ্রদটির নাম দেওয়া হয় রেসট্র্যাক প্লায়া। নামেই লুকিয়ে আছে রহস্য। এই জলশূন্য হ্রদের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু পাথর। বিস্ময়করভাবে তারা নিজে থেকে স্থান পরিবর্তন করে। চলমান ভুতুড়ে পাথরদের তৈরি করা ট্র্যাক থেকেই হ্রদটির নাম হয় রেসট্র্যাক প্লায়া। কখনও সরলরেখায়, কখনও বক্রপথে স্থান পরিবর্তন করে পাথরগুলি। এমনও হয় , দু’টি পাথর সমান্তরাল পথে কিছুদূর যাওয়ার পর দিক পরিবর্তন করে। এবং ঠিক বিপরীত দিকে আগের অবস্থানে ফিরে আসে। প্রমাণ হিসেবে পাথরগুলি শুষ্ক হ্রদের বুকে ফুটিয়ে তোলে গাড়ির চাকার দাগের মতো তাদের যাওয়া আসার দাগ। বোঝা যায় এই পথেই পাথরগুলি আগের অবস্থান থেকে নতুন অবস্থানে এসেছে। একটি দুটি নয়, শয়ে শয়ে পাথর। এককেজি থেকে সাড়ে তিনশো কেজির পাথরও স্থান পরিবর্তন করেছে। তা বোঝা গেছে তাদের ট্র্যাক দেখে।
রহস্যের সন্ধানে নেমে পড়লেন যাঁরা
রেসট্র্যাক প্লায়ার ভুতুড়ে পাথরদের কাহিনী বিশ্বের সামনে এলে, ভূবিজ্ঞানীর দল নেমে পড়েন রহস্য উদঘাটনে। রেসট্র্যাক প্লায়ার চলমান পাথর নিয়ে প্রথম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটি আসে ১৯৫৫ সালে। রেসট্র্যাক প্লায়াতে বেশ কয়েক মাস কাটিয়ে ফেলেন বিজ্ঞানী এম. স্ট্যানলি। তিনি বলেছিলেন, বছরের কোনও কোনও সময় ডেথ ভ্যালির পাহাড়গুলি থেকে বৃষ্টির জল গড়িয়ে রেসট্র্যাক প্লায়াতে নেমে আসে। তখন রেসট্র্যাক প্লায়া টলটলে এক হ্রদের আকার নেয়। যদিও জলের উচ্চতা মাত্র ৭-৮ সেন্টিমিটার। রাতের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নামে। জল বরফে রূপান্তরিত হয়ে প্রসারিত হয়। বরফ ও বাতাসের যুগপৎ ঠেলায় পাথরগুলি স্থানচ্যুত হয়। স্ট্যানলির মতবাদ আইস-সিট মতবাদ নামে বিখ্যাত হয়ে যায়।
কিন্তু ১৯৭৬ সালে দুই ভূবিজ্ঞানী ডুইট ক্যারে এবং রবার্ট শার্প রেসট্র্যাক প্লায়া নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তাঁরা স্ট্যানলি’র আইস-সিট মতবাদের বিরোধিতা করেন। ক্যারে এবং শার্প, ভুতুড়ে পাথরগুলির চলার পথের বৈশিষ্ট্য এবং পাথরগুলির অবস্থানের জ্যামিতিক বিশ্লেষণ করেন। রেসট্র্যাক প্লায়ার বালির ওপর বিভিন্ন পাথরের তৈরি করা ট্র্যাকগুলির মধ্যে আশ্চর্যজনক কিছু মিল পাওয়া যায়। পাথরগুলি বরফের ঠেলায় সরলে, ট্র্যাকগুলির মধ্যে এতো গঠনগত মিল হয় কী ভাবে ? অথএব বিজ্ঞানী স্ট্যানলির আইস-সিট মতবাদ নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন উঠে গেলো। এই দুই বিজ্ঞানী বললেন, বছরের নির্দিষ্ট সময় ও নির্দিষ্ট আবহাওয়ায়, অস্বাভাবিক ঝোড়ো বাতাসের কারণে পাথরগুলো সরে যায়। এই ঘটনা প্রতি বছর হতে পারে, আবার দুই তিন বছর অন্তর অন্তরও ঘটতে পারে।
১৯৮০’র দশকের শেষ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত জন বি.রেইড-এর নেতৃত্বে হ্যাম্পশায়ার ইউনিভার্সিটির একদল ভূবিজ্ঞানী রেসট্র্যাক প্লায়াতে সাতটি অভিযান চালান। তাঁরা ১৯৯৫ সালে, তাঁদের গবেষণাপত্রে শার্প-ক্যারে মতবাদ খারিজ করে স্ট্যানলির আইস-সিট মতবাদকে সমর্থন করেন।
সাধারণ মানুষ যা বলছিলেন
রেসট্র্যাক প্লায়ার চলমান পাথর গুলির রহস্যময় ব্যবহার নিয়ে বিশ্বের তাবড় তাবড় ভূবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবাদজনিত মতানৈক্যের কূটকচালি চলছে। সে সময় সাধারণ মানুষরাও নিজেদের মতো করে এই রহস্যজনক ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কেউ বললেন, বছরের কোনও এক সময়ে বিশেষ ধরনের চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয় রেসট্র্যাক প্লায়াতে, চুম্বক পাথরগুলো চৌম্বক ক্ষেত্রের আকর্ষণেই নাকি স্থান পরিবর্তন করে। কেউ বললেন রেসট্র্যাক প্লায়ার নির্জন প্রান্তরে রাতের আকাশ থেকে নেমে আসে ভিনগ্রহের মহাকাশযান। এলিয়েনরা পাথরগুলি ঠেলে সরিয়ে দিয়ে পালায়। কেউ বললেন রাতের অন্ধকারে অপদেবতারা পাহাড় থেকে গড়িয়ে দেন পাথর।
রহস্য উদঘাটনে নামলেন বিজ্ঞানী লরেন্স, রিচার্ড আর জেমস
গ্রহবিজ্ঞানী র্যাল্ফ লরেন্স, ২০০৭ সালে ‘রেসট্র্যাক প্লায়া’ নিয়ে গবেষণায় নামেন। ২০১১ সালে একই জায়গায় গবেষণা করতে যান সমুদ্রবিজ্ঞানী রিচার্ড নরিস এবং তাঁর ইঞ্জিনিয়ার ভাই জেমস নরিস। গ্রহবিজ্ঞানী র্যাল্ফ লরেন্সের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাঁরা। লরেন্স-এর সাহায্য নিয়ে পাথরগুলির নড়াচড়া ক্যামেরাবন্দী করার জন্য রেসট্র্যাক প্লায়াতে স্টিল ও ভিডিও ক্যামেরা বসানো হয়। একই সঙ্গে রেসট্র্যাক প্লায়ার তাপমাত্রা, বায়ুচাপ, আর্দ্রতা, প্রভৃতি আবহাওয়াগত পরিবর্তন নথিভুক্ত করার জন্য একটি ছোট আবহাওয়া কেন্দ্র বসিয়ে ফেলেন তিনজন। রহস্যময় পাথরগুলোর নড়াচড়া ট্র্যাক করার জন্য তাঁরা বিভিন্ন আকারের কিছু পাথরের গায়ে জিপিএস ট্র্যাকার বসিয়ে দিয়ে আসেন।
পাথরগুলো স্থান পরিবর্তন করলেই তা রেকর্ড হয়ে যাবে ট্র্যকারের ডাটাবেসে। কিন্তু তিনজনের কেউই জানতেন না, কতদিন তাঁদের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। প্রকৃতির খেয়ালে, অপেক্ষার মেয়াদ কয়েক বছর থেকে কয়েক শতাব্দীও হতে পারে। লরেন্স পরে বলেছিলেন, “আমি ভেবেছিলাম, এটি হতে যাচ্ছে বিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে বিরক্তিকর পরীক্ষা”। কিন্তু তাঁদের অবাক করে ফলাফল এলো দু’ বছরের মধ্যেই।
যন্ত্রপাতির ব্যাটারি পাল্টাবার জন্য ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে রিচার্ড আর জেমস আবার ডেথ ভ্যালির রেসট্র্যাক প্লায়াতে যান। সেখানে গিয়ে তাঁরা অদ্ভুত একটি দৃশ্য দেখতে পান। মরুভূমির মতো শুষ্ক হ্রদটির তিনভাগের একভাগ জুড়ে রয়েছে বরফের পাতলা চাদর। বরফের স্তর দেখেই স্ট্যানলির আইস-সিট মতবাদ চাক্ষুষ দেখার কথা ভাবেন দুই ভাই। প্রচন্ড ঠাণ্ডার মধ্যে তাঁবু খাটিয়ে ফেলেন। মৃত্যু উপত্যকায় কাটতে থাকে দিনের পর দিন। এক প্রাণান্তকর প্রতীক্ষায়।
অবশেষে এলো সেই দিন
২০ ডিসেম্বর, ২০১৩। সকাল ন’টা নাগাদ রোদ উঠলে বরফের পাতলা আস্তরণ ভাঙতে শুরু করলো। রেসট্র্যাক প্লায়ার কিছু কিছু জায়গার বরফ গলে একটা ফাঁকা এলাকা তৈরি করতে শুরু করলো। উপত্যকায় ঝাঁপিয়ে পড়া সকালের ঠান্ডা বাতাসের ধাক্কায় ভেঙে যাওয়া বরফের প্লেটগুলি নড়াচড়া করতে শুরু করল। হড়কে হড়কে চলাচল করার সময় বরফের ভাঙা প্লেটগুলি তাদের সামনে থাকা পাথরগুলোকে আস্তে আস্তে ধাক্কা দিতে শুরু করল। সবিস্ময়ে রিচার্ড এবং জেমস শক্তিশালী বাইনোকুলারে দেখলেন বিভিন্ন মাপের পাথরগুলো বরফের প্লেটের ধাক্কায় আস্তে আস্তে এগোতে শুরু করেছে।
পাথরগুলো এত আস্তে এগোচ্ছিল খালি চোখে দেখে বোঝাই যাচ্ছিল না। ২০ ডিসেম্বর বিকেলের দিকে রেসট্র্যাক প্লায়ার সব বরফ গলে গেল। দেখা গেল ৬০ টি পাথরের পিছনে নতুন করে ঘষটে এগিয়ে যাওয়ার দাগ তৈরি হয়েছে। সমস্ত ঘটনার ছবি তুলে বিজ্ঞানী রিচার্ড এবং জেমস এরপর সটান শহরে ফিরে যান। বিজ্ঞানী র্যাল্ফ লরেন্সকে ছবি দেখিয়ে সব ঘটনা খুলে বলেন। এবার লরেন্স ফিরে আসেন রেসট্র্যাক প্লায়াতে, রিচার্ড এবং জেমসকে নিয়ে। সঙ্গে মাস ছয়েকের রসদ। ২০১৪ সালের ৯ জানুয়ারি আবার তাঁরা পাথর গুলির স্থান পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেন। সেই ঘটনার স্থির ছবি এবং ভিডিও তোলেন। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেন সবচেয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করেছে একটি বড়সড় পাথর। ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে সেটি তার ২০১৩ সালের গ্রীষ্মের অবস্থানের চেয়ে ২২৪ মিটার দূরে গিয়ে থামে।
বিজ্ঞানী লরেন্স, রিচার্ড আর জেমস যা বললেন
তাঁরা তাঁদের গবেষণাপত্রে বলেন, “ আমাদের রিপোর্ট কোনও কাল্পনিক রিপোর্ট না। আমাদের কাছে ঘটনার প্রমান হিসেবে সযত্নে রাখা আছে ঘটনার আগের ও পরের ছবি, ভিডিও এবং সেসময়ের আবহাওয়া রিপোর্ট। ” রিচার্ড , জেমস এবং লরেন্স ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কেন একসঙ্গে অনেক পাথর সমান্তরাল পথে সমদূরত্ব অতিক্রম করে। তাঁরা বলেছেন, অনেক সময় বরফের প্লেটগুলি আয়তনে বিশাল হওয়ায় একসঙ্গে শ’ খানেক পাথরকে একই দিকে ঠেলতে ঠেলতে এগোয় বলে অতিক্রান্ত দূরত্ব এক এবং গতিপথের ছাপ সমান্তরাল হয়। তিন বিজ্ঞানী তাঁদের গবেষণা পত্রটি প্রকাশ করেছেন তাঁদের প্রিয় বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-এর আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’ এর নামের কিছু অংশ ধার করে। তাঁদের গবেষণা পত্রের নাম ‘এ ব্রিফ মোমেন্ট ইন টাইম’। তবে তিনজন বিজ্ঞানী গবেষণাপত্রে এটাও বলেছেন, তাঁরা যা সিদ্ধান্তে এসেছেন এর বাইরের কারণেও পাথরগুলি গড়াতে পারে। তবে এটাও একটা কারণ, যা তাঁরা প্রমাণ করতে পেরেছেন।
রেসট্র্যাক প্লায়ার চলমান পাথরের রহস্য উদঘাটনে সফল তিনবিজ্ঞানী কিন্তু প্রকারান্তরে, স্ট্যানলির আইস-সিট মতবাদটিকেই প্রমাণ করলেন। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে লরেন্স,রিচার্ড এবং জেমস যা প্রমাণ করলেন ২০১৪ সালে, বিজ্ঞানী এম স্ট্যানলি ১৯৫৫ সালেই তা বলে দিয়েছিলেন। তাঁর প্রমাণের উপর শিলমোহর দিতে আধুনিক বিজ্ঞানের ৬৩ বছর লেগে গেল। তাই রেসট্র্যাক প্লায়ার চলমান পাথরের রহস্য উদঘাটনের পুরো কৃতিত্ব বিজ্ঞানী এম স্ট্যানলিরই।