Latest News

মুখোমুখি ৯৮ বছরের মা ও ৮০ বছরের খোকা, আর বৃদ্ধাশ্রম

রূপাঞ্জন গোস্বামী

না, এই কাহিনীতে নচিকেতার ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গানটির মতো ছেলে মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে দিয়ে যাননি।  বাবার প্রিয় ঘড়ি  ছড়ি বিদায় না করে সযত্নে রেখে দিয়েছেন বাড়িতে। সেই তেরো বছর বয়েস থেকে। বাবার ব্যবহারের  সেই আলমারি আর আয়না ,এখনও পূর্ণমর্যাদায় বিরাজ করছে যথাস্থানে । আর মা’কে?  বাবার মৃত্যুর পর, এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল করেননি ছেলে। নিজের সুখের জন্য বৃদ্ধা মা’ কে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসেননি। বরং মা’কে দেখবেন বলে বিয়েই করেননি ছেলে।

মা আর ছেলে সুখে কাটিয়েছেন প্রায় সাত দশক। মা’ও ছেলে অন্ত প্রাণ। ছেলে টমের যখন ১৩ বছর বয়েস , স্বামী হ্যারি কেটিং মারা যান। টম আর তিন  কন্যা , বারবারা, জ্যানেট ও মার্গিকে নিয়ে লড়াইয়ে নামেন মা এডা। সময়ের নিয়মেই একদিন মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায় । তারপর থেকে এক লহমার জন্যও ছেলে টমকে চোখের আড়াল করেন নি এডা, ২০১৬ সালের আগে। ছেলেকে নিয়েই ছিল মায়ের সুখী জীবন।

এডা আর টম

সেই ছেলের বয়েস এখন আশি । টম , ২০১৬ থেকেই ইংল্যান্ডের লিভারপুলের হিউটন এলাকার মসভিউ নার্সিং হোমের আবাসিক।  আমাদের ভাষায় যেগুলির নাম বৃদ্ধাশ্রম। ছেলে টম বার্ধক্যজনিত কারণে খুবই অসুস্থ। তাই আটানব্বই বছরের মা , নিজেই বসতবাড়ি ফেলে ছুটে এসেছেন ছেলের কাছে।  ছেলের সঙ্গে বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে।

কেনই বা আসবেন না ! ছোট বেলায় খোকা নিজের হাতে খাবার খেতে পারত না । কাঁদত খাইয়ে না দিলে । আশি বছর বয়েসে, এখনও যে কাঁদে খোকা । কিন্তু ২০১৬ সালে, পরিবারের অন্যরা ছেলে টমকে পাঠালেন কেয়ার হোমে। মা এডা এক বছর ছিলেন ছেলেকে ছেড়ে। কিন্তু মন খারাপ হয়ে যেত , কেয়ার হোম থেকে আসা খবরে।

ছেলে নার্সদের হাতে খাবার খেতে চায়না। পোশাক পরতে চায়না । কথা বলেনা । ওষুধ খেতে চায়না। সারাক্ষণ শুধু ‘মম’ ‘মম’ শব্দটা অস্ফুটে বলে। অনবরত গাল বেয়ে গড়িয়ে নামে চোখের জল। একবছর ধরে সারাক্ষন মায়ের জন্য আনচান আনচান করেছে খোকা। এসব শুনে , কোনও মা না এসে থাকতে পারেন ? তাই আটানব্বই বছরের মা এডা সরাসরি চলে এলেন ছেলের টমের কাছে।

ছেলের ঠিক ঠাক দেখভাল করতে হবে। আটানব্বই বছরের মা, রোজ আশি বছরের ছেলের দাঁত মাজিয়ে দিতেন। পোশাক পাল্টে দিতেন। ড্যায়াপার পাল্টে দিতেন। সময় মতো ওষুধ খাইয়ে দিতেন। প্রেসক্রিপশন মিলিয়ে দেখতেন, ওষুধ গুলো ঠিক যাচ্ছে কিনা। ইনজেকশন দিতে হলে ভায়ালের ব্যাচ নাম্বার দেখে নিতেন। ছেলের বিছানার চাদর পাল্টানো হচ্ছে কিনা তার নিয়মিত খোঁজ রাখতেন। ছেলের বিছানার পাশে ছেলের পছন্দের ফুল দেওয়া হচ্ছে কিনা, এমন কি খাবারে লবণটা ঠিক আছে কিনা তাও জিভে ফেলে দেখে নিতেন এডা।

আমি প্রত্যেক রাতে টমকে শুভরাত্রি বলে দিন শেষ করি। সুপ্রভাত বলে আমার দিন শুরু করি।” বলেই মুচকি হেসেছিলেন এডা। “ছেলে আমার ভীষণ ন্যাওটা। আমি যখন হেয়ারড্রেসারের কাছে চুল সেট করতে যাই। নার্সরা বলেন , আমার ছেলে বিছানা ছেড়ে উঠে জানলার কাছে যায়। রাস্তার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অপেক্ষা করে আমার জন্য। যখন আমি ফিরি দুহাত ছড়িয়ে খোকা আমার এগিয়ে আসে। আমার কাছে এসে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে।  একজন মা হিসেবে আপনি আর কি চাইতে পারেন কি বলুন !

টম কিন্তু নচিকেতার গানের ছেলেটির মতোই মস্ত মানুষ ছিলেন। না মস্ত অফিসার নয় , টম ছিলেন একজন  চিত্রকর এবং গৃহসজ্জা শিল্পী। উজ্বল চোখে, আকার ইঙ্গিতে , জড়ানো কণ্ঠে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন মনের কথা। তাঁরও মা’কে ছেড়ে একদম এখানে থাকতে ইচ্ছা করছিল না।  ” আমার মা আমার সব আবদার মেটাচ্ছেন। আমি এখন ঠিক মতো খাবার খাই , ওষুধ খাই । নার্সদের জ্বালাতন করিনা।” শিশুর মতো হেসেছিলেন টম।

নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষও ভীষণ খুশি। কেয়ার হোমের ম্যানেজার ফিলিপ ড্যানিয়েল জানিয়েছিলেন, ” খুব কাছ থেকে আমরা একটা পবিত্র ও সেরা সম্পর্ক দেখতে পাচ্ছি। দুজনের দু’রকম প্রয়োজনীয়তা মেটাতে পেরে আমরাই কৃতজ্ঞ।” আসলে হোম কতৃপক্ষ জানতেন , এ মা যে সে মা নন।

আটানব্বই বছরের এডা রীতিমতো প্রশিক্ষিত নার্স । অবসরের আগে মিলরোড হসপিটালের সিনিয়র নার্স ছিলেন। এই বয়েসেও জরাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে জরাগ্রস্থ ছেলের নিখুঁত ভাবে সেবা করেছিলেন। তা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ।  আর মিডিয়ার দৌলতে মা ও খোকা রীতিমতো সেলিব্রেটি হয়ে গিয়েছিলেন।

“এটা সত্যিই অকল্পনীয় , যে মা ও সন্তান একই কেয়ার হোমে আছেন। আমরা সব সময় চেষ্টা করছি ওঁদের একসঙ্গে থাকার মুহূর্ত গুলি যতটা সম্ভব আনন্দময় করে তুলতে । কারণ ওঁদেরকে আর কোনও ভাবেই আলাদা করা সম্ভব নয়।” বলেছিলেন সিনিয়র নার্স ব্রিজিট

সত্যিই মায়ের ভালোবাসা আর দায়িত্ব বুঝি , শেষ হয়েও শেষ হয় না। আটানব্বই বছরের মা এডা এবং আশি বছরের ছেলে টমের কাহিনীটি , বর্তমানের মূল্যবোধহীন সমাজের গালে কি সপাটে এক চড়? নাকি একবিংশ শতাব্দীর হাতে লেখা নতুন রূপকথা?

You might also like