
রূপাঞ্জন গোস্বামী
সতীর নিথর দেহ নিজের কাঁধে তুলে প্রলয়নৃত্য নেচে চলেছেন দেবাদিদেব মহাদেব। কাপঁছে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল। ঘুরছে প্রলয় চাকা মহাকালের হাতে। মহাদেবের চোখ ক্রোধের আগুনে পলাশের মতো লাল। দীর্ঘনিঃশ্বাসের বাষ্পে পুড়ছে ধরিত্রী। ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে দেবতাদের মধ্যে।
ত্রিভুবনের নিশ্চিত ধ্বংস রুখতে দেবতাদের অনুরোধে জগত পালক বিষ্ণু এগিয়ে আসছেন। সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করতে। ক্রোধে উন্মত্ত, রক্তচক্ষু মহাদেবের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল দু’ফোঁটা চোখের জল। এক ফোঁটা পড়ল রাজস্থানের আজমেঢ়-এ। তৈরি হল হিন্দুদের পবিত্র তীর্থ পুস্কর। অপর ফোঁটা পড়ল, বর্তমান পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের চকওয়াল জেলার সল্ট রেঞ্জ, কাল্লার কাহার-এর এক ঊষর পাহাড়ি ভূখন্ডে।
সৃষ্টি হল এক পবিত্র কুন্ডের। ‘কাটাসকুণ্ড’— কাটাস অর্থ চোখের জল। কেউ বলেন অমৃতকুণ্ড। স্থানীয় মুসলিমরা বলেন ‘চশমে আজম’ । যে কুণ্ডের টানে শত শত বছর ধরে মানুষ ছুটে আসছেন। শিবের চোখের জলে অবগাহন করলে পাপমুক্তি ও মোক্ষ পাওয়া যাবে এই বিশ্বাসে।
মহাভারতের বিখ্যাত ‘যক্ষপ্রশ্ন‘ বিভাগে একটি পুকুরের কথা বলা আছে। যেখানে যক্ষ তৃষ্ণার্ত পান্ডবদের ধাঁধাঁর লড়াইয়ে আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার ধাঁধাঁর উত্তর দিতে পারলে মিলবে কুণ্ডের জল পানের অনুমতি। না পারলে ঘটবে মৃত্যু । পান্ডবদের চার ভাই ধাঁধাঁর উত্তর না দিতে পেরে প্রাণ হারান।
কিন্তু যুধিষ্ঠির যক্ষকে হারিয়ে দেন ধাঁধার যুদ্ধে। প্রাণ ফিরে আসে চার পান্ডবের। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, কাটাসকুণ্ড হল সেই পুকুর। কাটাসরাজ মন্দির চত্বরে ‘পান্ডব কুঁয়া’ নামে একটি কুয়ো আজও আছে। কুণ্ডের জলের পবিত্রতা বজায় রাখতে, দৈনন্দিন কাজের জন্য প্রয়োজনীয় জল পান্ডবরা এই কুয়ো থেকেই নিতেন।

পবিত্র কাটাসকুণ্ডকে ঘিরে আছে সাতটি মন্দির এবং একটি বৌদ্ধ স্তুপ। এই সাতটি মন্দিরের মধ্যে আছে পাকিস্তানের বিখ্যাত শিবমন্দির কাটাসরাজ। স্বয়ং কৃষ্ণ নাকি এই শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের পাথরের শিবলিঙ্গটি শ্রীকৃষ্ণ নিজের হাতে পাথর কুঁদে বানান। এ ছাড়াও এই মন্দির কমপ্লেক্সে আছে রাম এবং হনুমান মন্দির। পাকিস্তানের উর্দুভাষী মানুষ মন্দির কমপ্লেক্সকে বলেন ‘কিলা কাটাস‘।
ঐতিহাসিকদের মতে কাশ্মিরী স্থাপত্যের এই মন্দির কমপ্লেক্স সম্ভবত গান্ধারের হিন্দুশাহীর আমলে তৈরি হয়। মন্দিরগুলির ভিতরের কারুকার্য অসম্ভব সুন্দর। বৌদ্ধ স্তুপটি সম্ভবত সম্রাট অশোকের আমলের। কাছেই আছে এক গুরুদ্বার। সেখানে গুরু নানক আসতেন। আসতেন কাটাসরাজ শিবমন্দিরেও। মুসলিম স্কলার আল-বিরুনী এই অঞ্চলে কাটিয়ে গেছেন বহুদিন। চৈনিক সন্ন্যাসী ফা হিয়েন (Faxian) তাঁর লেখায় কাটাসরাজ মন্দিরের বর্ণনা দিয়েছেন। হিউএন সাং (Xuanzang) এই তীর্থস্থান পরিভ্রমণ করেন।
শিখ রাজা রণজিৎ সিংহ-এর খু্ব প্রিয় মন্দির ছিল এই কাটাসরাজ। নিয়মিত আসতেন এখানে। তাঁর সেনাপতি হরি সিং নওলার হাভেলি আজও আছে। স্থানীয় গাইডরা ট্যুরিস্টদের বলেন মন্দিরের বয়স ৩৫০০ বছর। ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার আলেকজান্ডার কানিংহ্যাম বলেছেন এই মন্দির প্রায় ৬৬ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে তৈরি হয়েছিল। হিন্দুরা বলেন শিবের চোখের জলেই এই পবিত্র কুণ্ড তৈরি হয়েছিল এবং এই কাটাসরাজ মন্দির মহাভারতের যুগের। তাই এখানে বস্তু বিশ্বাসে মিলায়, তর্ক হয়, কাল্লার কাহার থেকে বহুদূ্রে।

১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার আগে, কাটাসরাজ মন্দির অবিভক্ত পাঞ্জাবের দ্বিতীয় বিখ্যাত হিন্দু তীর্থ ক্ষেত্র ছিল। জ্বালামুখীর ( হিমাচল প্রদেশ) পরেই। প্রত্যেক বছর নবরাত্রির সময় বিশাল মেলা আয়োজিত হত। শুরু হতো জাগ্রত শিব ‘কাটাসরাজের’ বাৎসরিক তীর্থ যাত্রা। ভারত ভাগ হওয়ার পর বেশিরভাগ হিন্দু ভারতে চলে আসার জন্য আঁধার নেমে আসে কাটাসরাজে। নিত্যপূজা বন্ধ হয়ে যায়। ভারত-পাক সম্পর্কের অবনতির জন্য জন্য, কাটাসরাজের বাৎসরিক তীর্থযাত্রায় ভারতীয় তীর্থযাত্রীদের যোগদান বন্ধ করে দেয় পাক প্রশাসন।
১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর উত্তেজিত পাকিস্তানি জনতা কাটাসরাজের মন্দির ভাঙার চেষ্টা করে। সমস্ত আক্রোশ গিয়ে পড়ে রাম ও হনুমানের মন্দির ও বিগ্রহের উপর। লুকিয়ে রাখতে হয় বিগ্রহ দুটিকে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবেই অক্ষত থেকে যান কাটাসরাজ শিবলিঙ্গ। এরপর অযত্নে পড়ে থাকে কাটাসরাজ মন্দির। কুণ্ডটির আশপাশ, মন্দির চত্বর ঝোপঝাড়ে ভরে যায়। নেশাখোরদের আস্তানা হয়ে ওঠে।

ভারতের প্রাক্তন উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবানী, ২০০৫ সালে পাকিস্তান ভ্রমণকালে আসেন কাটাসরাজ মন্দিরে। হিন্দুদের পবিত্রতম মন্দিরের শোচনীয় অবস্থা দেখে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। পাকিস্তান সরকার নড়েচড়ে বসে। ফের ঝাড়পোঁছ শুরু হয় মন্দিরে। শ্যাওলা জমা কাটাসকুণ্ড পরিস্কার করা শুরু হয়।
আমেরিকায় বিমান হানার পরে সারা বিশ্ব তখন মৌলবাদীদের একঘরে করতে ব্যস্ত। পাকিস্তানি সেনানায়ক পারভেজ মুশারফ একঘরে হওয়ার ভয়ে, শোরগোল তুলে শুরু করলেন হিন্দু তীর্থ কাটাসরাজের পুনরুদ্ধার প্রকল্প। মন্দিরের মেরামতি শুরু হল। ভারত ও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের উৎসাহিত করা হলো শিবরাত্রির সময় কাটাসরাজ তীর্থযাত্রায় অংশগ্রহন করার জন্য।
কিন্তু ২০০৮ সালের মুম্বই আক্রমণের পর, আবার ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বৈরিতার ব্যারোমিটারের পারা চড়তে থাকায়, মেরামতি বন্ধ হয়ে যায়। নওয়াজ শরিফ ক্ষমতায় এসে, একদিন সরাসরি চলে আসেন কাটাসরাজ মন্দিরে। আবার জাগিয়ে তোলেন কাটাসরাজ চত্বর। ২০১৭ সালে ভারত থেকে প্রায় ২০০ তীর্থ যাত্রী কাটাসরাজ ধাম ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণও করেন।

এদিকে, অন্য আরেক বিপদ ক্রমশ ঘিরে ফেলতে থাকে পবিত্র হিন্দু তীর্থটিকে। কাটাসরাজ মন্দিরের আশপাশের পাহাড়গুলিতে উচ্চমানের লাইমস্টোন মেলায়, এই অঞ্চলে ঢুকতে থাকে সিমেন্ট কোম্পানিরা। দ্রুত তুলে নিতে থাকে মাটির জল। দ্রুত শুকিয়ে যেতে থাকে পবিত্র কাটাসকুন্ড। নামতে থাকে জলস্তর। পাকিস্তানের মিডিয়া ২০১৬ সালে খবর করে, ” অবহেলায় শুকিয়ে যাচ্ছে হিন্দুদেবতা মহাদেবের চোখের জলে তৈরি কাটাসকুণ্ড এই শিরোনামে।
ঘটনাটির গুরুত্ব বুঝে পাকিস্তানের সুপ্রীম কোর্ট নিজেই স্বতোঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা শুরু করে। পাকিস্তানের চিফ জাস্টিস মিয়াঁ সাকিব নিসার রায় দেন, কাটাসকুণ্ডকে বাঁচাতে প্রয়োজনে সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে জল সাপ্লাই বন্ধ করে দেওয়া হবে। জাস্টিস নিসার তাঁর রায়ে বলেন, “এই মন্দির কেবলমাত্র হিন্দুদের কাছে পবিত্র নয় এটা পাকিস্তানের জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ। আমাদের এটি রক্ষা করতে হবে।“

মামলা চলাকালীন বিচারকদের বেঞ্চ, পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের শাসকদের জিজ্ঞেস করেন রামমন্দির ও হনুমান মন্দিরে রাম ও হনুমানের বিগ্রহ নেই কেন ? শাসকরা অম্লানবদনে জানান, তীর্থযাত্রীরা সঙ্গে করে বিগ্রহ আনেন ও যাওয়ার সময় নিয়ে চলে যান। ক্ষুব্ধ বিচারকের আদেশে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে সাতটি মন্দিরে নতুন করে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
তিন সদস্যের পাকিস্তানি আর্কিওলজিক্যাল দল ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা ঘুরে বিগ্রহ সংগ্রহ করে নিয়ে যান। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে মন্দিরের শিখরে কলস স্থাপন করা হয়। নতুন করে মন্দির ক্ষেত্রটির রক্ষণাবেক্ষণ শুরু হয়। কুণ্ডের জল শোধনের জন্য ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বসানো হয়। এই মন্দির কমপ্লেক্সকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করার জন্য আবেদন করার কথা ভাবা হয়।

কিন্তু , পাকিস্তানে সরকার আসে, সরকার যায়। সুপ্রীম কোর্টের নতুন বিচারপতি ‘কাটাসকুণ্ড’ মামলা বন্ধ করে দেন। কারণ তিনি মনে করছেন কাটাসকুণ্ড পুনরুদ্ধারের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা হয়েছে, তাই মামলা দীর্ঘায়িত করার দরকার নেই। কিন্তু , তাহলে কুন্ডের জলস্তর পঞ্চাশ ফুট থেকে কমে এখন মাত্র কুড়ি ফুটে এসে দাঁড়িয়েছে কেন? মন্দিরের এক কিলোমিটারের মধ্যে দুটির জায়গায় চারটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি তৈরি হয়েছে কেন? এখন তো সুইমিং পুল ভরার মতো পাইপে করে জল এনে ফেলা হয় কুণ্ডটি বাঁচিয়ে রাখতে।
আসলে, ভারত-পাকিস্থানের সম্পর্কের গ্রাফের ওঠানামার উপর নির্ভর করে আসছে কাটাসরাজ মন্দির ও কাটাসকুণ্ডের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত। পাকিস্তানের কয়েক লক্ষ হিন্দুদের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের মতোই।
চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড় চূড়ায় বিরাজ করেন জাগ্রত শিব ‘চন্দ্রনাথ’, পাদদেশের সতীপীঠে ‘দেবী ভবানী’