

সেই কবে থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছেন। রক্তেও আপনার রবীন্দ্রগান। কিন্তু এই গান যে যা খুশি গেয়ে একদল শিল্পী তো রবীন্দ্রসঙ্গীতের আর কোনও মর্যাদাই রাখল না।
কষ্ট হয়, দুঃখ হয়। অভিমানে চোখে জল আসে। ছোটবেলা থেকে যে গান সাধনা করছি, যে গানের সান্নিধ্যে জীবনের পূর্ণতা পেয়েছি –তাকে নিয়ে ছেলেখেলা ও গা – জোয়ারি মানতে পারছি না, কোনওদিনও পারব না।
এর পরিণাম কোথায়?
জানি না। ক’দিন গান করতে না করতেই স্টেজে উঠে নিজেদের বড় শিল্পী বলে জাহির করছেন কেউ কেউ। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর গান——বিশাল এই জগৎটা না চিনে না বুঝে যে সব ডায়লগ গানের আগে ও পরে তাঁরা জুড়ছেন——তা কোন অহংবোধের পরিচয় দেয়, জানি না। এমন সব বিনয় তাঁদের আচার – আচরণে, যে এক একজন রবীন্দ্রগানের ‘বিনয়বাবু’।
মোদ্দা কথা, এইসব শিল্পীরাই বাজার নষ্ট করছেন। শ্রোতাদের চোখে হেয় হচ্ছেন তাঁরাই।
কিছুদিন আগে যাদবপুরের এক অনুষ্ঠানে গান করতে গিয়েছিলাম। দেখলাম ব্যান্ডে গান গাইছেন কয়েকজন। বলা যায় রবীন্দ্র ব্যান্ড। ‘তার অন্তরে নাই গো,’ ‘ছিন্নপাতার …..’, ‘জীবনে আমার যত আনন্দ’ – এমন সব গান। সত্যি বলছি, আমি আর বসে থাকতে পারিনি। বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিলাম।
এ ভাবেই চলবে তাহলে?
চলবে তো বটেই। আমি একজনের কথা বলছি। সে কিছুদিন ধরে এখানে-ওখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখছিল। টাকা দিয়ে একটি চ্যানেলে গাইবারও সুযোগ পেয়ে গেল। ব্যস্, কেল্লা ফতে। কাগজে প্রতিষ্ঠিত শিল্পী বলে নিজের দেওয়া বিজ্ঞাপনও বেরিয়ে গেল। অতঃপর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি হাজির থাকছেন। এবং গাইছেনও।
এমন সব কাণ্ড। বলতে লজ্জা নেই রবীন্দ্রগান এখন অভিভাবকহীন।
লজ্জা নয়, আমি জোর গলায় বলছি – এখনই একজন কড়া অভিভাবক দরকার। যিনি রবীন্দ্রগান নিয়ে কোনও বজ্জাতি মেনে নেবেন না। বিশ্বভারতী না হোক অন্য কোনওভাবে রবীন্দ্রগানের মাথায় একজন অভিভাবক বসানো দরকার। সত্যিই সময় এসে গেছে।
প্রবীণ ও এখনকার প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা এ সব নিয়ে এখনও কেন প্রতিবাদ করছেন না? কেনই বা তাঁরা চুপ?
কে বলেছে চুপ? আমি তো প্রথম থেকেই প্রতিবাদ করে আসছি। হ্যাঁ, তবে একটা জোট দরকার।
শুনবে কি প্রবীণদের কথা?
দেখুন কিছুদিন আগে আমি একজন উঠতি শিল্পীকে ডেকে বললাম – দ্যাখো, অনুষ্ঠানে বসে তোমার গানটি শুনলাম। তুমি মানো আর না মানো, মাড়ি চেপে কখনও রবীন্দ্রসঙ্গীত হয় না। কয়েকদিন আগে সেই শিল্পী আমায় ফোন করে জানালো, সে ভুল শুধরে নিয়েছে। দেখুন এটাই আমার কাছে বড় প্রাপ্তি। আমি এটুকু কর্তব্য করতে পেরেছি বলে আমার বিশ্বাস অন্য অভিজ্ঞ শিল্পীরাও অন্যদের শুধরে দিলে একদিন না একদিন ভাল ফল মিলবে। যদিও সবাই সমান নন।
রবীন্দ্রজয়ন্তী এলেই উঠতি এমনকী হালে গান পাওয়া শিল্পীরা সদর্ভে বলে ওঠেন, একদিনে এত গান গেয়েছি। এতগুলি অনুষ্ঠান করেছি। যেন প্রতিযোগিতার হিড়িক পড়েছে। এগুলো কি ছেলেখেলা নয়?
ওগুলো রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়। যেমন শিল্পী, তেমনই তার গান। না আছে সেই গানের অনুভব, না আছে তার কোনও মাধুর্য। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে কোনওদিন প্রতিযোগিতা হয় না। এ বছরে একজন আমাকে এই কথা বলতে আমি তার কাছে তার গাওয়া গানের তালিকা চেয়েছিলাম। মাত্র কয়েকটি গানের সীমাবদ্ধতার বাইরে সে আর পা রাখতে পারেনি। লজ্জা হয় এরাই এখন বাজার দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
সেই জন্যই বোধহয়, জিনস পড়ে স্টেজে মাইক্রোফোন ধরছে। তাই না?
সম্মান চুলোয় গেছে। শালীনতার বালাই নেই। জিনস পরে গাইছে ‘আনন্দলোকে’। বুঝুন ঠ্যালা। জিনস পরে এ গান হয় না, কে বোঝাবে কাকে। কী শিখবে নতুন প্রজন্ম?
তাই যদি হবে তবে রবীন্দ্রগানের ঘরানা তো অবিলম্বে ফেরানো দরকার, তাই না?
পুরনো দিনের সেই ট্র্যাডিশনাল চিন্তাভাবনা আমার মাথায় ঘুরছে। শুধুমাত্র পিয়ানো দিয়ে বা গ্রুপ ভায়োলিনে কিছু কিছু নতুন কাজ করবো। জানিয়ে রাখি, আমার প্রতিষ্ঠান ‘শ্রাবণী সেন মিউজিক অ্যাকাডেমি’তে সেই মতো প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের। আজ আপনাদের কথা দিচ্ছি, আমি সেই পুরনো ঘরানা ফেরাবই ফেরাবো।
সব মানলাম। কিন্তু যাদের তৈরি করছেন তারা আবার পরবর্তীতে বাণিজ্যিক স্রোতে গা ভাসিয়ে দেবে না তো?
প্রকৃত রবীন্দ্রগানের মোহে যে একবার ধরা দেবে, সে পরবর্তীতে কখনও বাণিজ্যিক ফাঁদে পা দেবে না। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে ছেলেখেলা করবে না। জানেন তো, রবীন্দ্রনাথকে একবার চিনলে তাঁর ভালবাসা, স্নেহ, শিক্ষা আপনাকে অন্য ভুবনে পৌঁছে দেবে।
যখনই সময় পাই, মায়ের (সুমিত্রা সেন) পুরনো গানের খাতাগুলো উল্টে-পাল্টে দেখি। আমি মায়ের পথ অনুসরণ করি। শিখতে জানতে লজ্জা নেই, বরং অহংকার আছে। মা যে গানগুলি গেয়েছেন আমিও শ্রোতাদের অনুরোধে তা গেয়ে শোনাই।
যাক আপনার সঙ্গে কথা বলে এটুকু বুঝলাম যে আপনিও হতাশ হয়ে অন্য পেশার কথা ভাবছেন না।
অন্য পেশা? মানে? ছিঃ ছিঃ। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরলে জীবনে আর অন্য কিছু ভাববার প্রয়োজন আছে কি? এটা যাঁরা বলেন তাঁদের শিল্পী সত্তা নিয়ে সন্দেহ জাগে। সমালোচনা করতে চাই না। বরং এঁদের প্রতি করুণা করতে ইচ্ছে করে। ঈশ্বর নিশ্চয়ই ওঁদের ক্ষমা করবেন। আর সেই ঈশ্বর তো খোদ রবীন্দ্রনাথ। তাই না?