
অরিন্দম বসু
নেহাত নোয়ার নৌকো দেখিনি তাই। তা না হলে বার্জের ভেতরটাকে তেমনই বলা যেত। কনকনে জোরালো হাওয়াতেও আমার অনেকের সঙ্গে বার্জের ডেকের উপরেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। সেই একই হাওয়া থেকে বাঁচতে বেশির ভাগ লোকই তখন সেঁধিয়ে গিয়েছিল বার্জ ভিভি গিরির পেটের খোঁদলের মধ্যে। ঘরঘর করে নৌকোর কাছি তোলার শব্দ, ওয়াকিটকিতে বোঝাপড়া করে নেওয়া আড়িয়া-হাফেজ, জয় জয় মা গঙ্গে, তীব্র সাইরেন। বার্জ রওনা দিয়েছিল, কচুবেড়িয়ার দিকে। অন্য লঞ্চের আলো, হারউড পয়েন্ট, লটনম্বর এইটের সার্চ লাইট থেকে ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকল বার্জ। চার পাশে শুধুই অন্ধকার। না, তা ঠিক নয়। বিস্তীর্ণ মোহনায় জলের উপরে আকাশের আলোও যে ভেসে থাকে, তা বুঝতে পারছিলাম। কুয়াশায় আছন্ন হয়ে থাকায় মনে হচ্ছিল যেন জলের ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে ভেসে চলেছি। মাঝেমাঝে কুয়াশা ফুঁড়ে দেখা দিচ্ছিল বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়ার দশাসই টাওয়ার। ওই অত রাতেও অত কিছুর মধ্যেও যে কী করে একটা লোক বার্জের ভেতরে চানাগরম বিক্রি করছিল কে জানে!
প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে জল-স্থল আর বাতাস কাঁপিয়ে, আবার তীব্র সাইরেন বাজিয়ে কচুবেড়িয়ার চার নম্বর জেটিতে ভিড়ল বার্জ। নেমে আসতে সময় লাগল আরও কিছু ক্ষণ। জেটি পেরিয়েই শুরু হয়ে গেল বাঁশের ব্যারিকেড। চলছে তো চলছেই। আলোর ব্যবস্থা ভালই, তবে অন্ধকারের নিজস্ব ব্যবস্থাও তো কম নয়। যদিও ঠান্ডা ততটা বেগ দিতে পারছে না। ব্যারিকেডের এক দিক গিয়েছে কচুবেড়িয়া আর বাসস্ট্যান্ডের দিকে, উল্টো দিক আসছে জেটির দিকে। যাওয়া আসার সময়ে দু’দিকের মানুষ দেখছে একে অপরকে। মকর সংক্রান্তিতে তিথি-নক্ষত্র মেনে স্নান করবে লক্ষ লক্ষ মানুষ। তবে তার আগেও অনেকে স্নান সেরে ফিরতি পথে। হাঁটতে হাঁটতে কানে আসছিল নানা সংলাপ।
‘তুমি আমার ঠ্যাঙের ওপর দাঁড়ালে ক্যানে?’
‘আমার তো এই পরত্থমবার আসা। আর আসবনি বাবা। বড্ড কষ্ট।’
‘আরে হামরা পণ্ডিত কাঁহা ভাগে, উসকা তো পতা ভি নেহি মিল রহা।’
কান পাতার দরকার নেই। এমন আরও অনেক শোনা যাবে, চেষ্টা না করলেও। আমার ঠিক সামনেই হেঁটে চলেছে ছ’সাত বছরের একটি ছোট্ট মেয়ে। ঘাগরার ওপরে সোয়েটার। মাঝে মাঝে মুখ ঘুরিয়ে হাসছে দেখে নাম জানতে চাইলাম। নাম তার অঞ্জু। যাঁর হাত ধরে হাঁটছে, তিনি ওর দাদু। শ্রীরাম যাদব। এসেছে উত্তরপ্রদেশের দেওরালা থেকে। ছেলেও চলেছে সামনে, তবে নাতনি তার বাবার হাত ধরবে না। মাঝেমাঝেই ব্যারিকেডের ক্রসিংয়ের বাঁশের গেট নেমে এসে পথ বন্ধ করে দিচ্ছে। একটু পরেই হারিয়ে ফেললাম মেয়েটাকে। হয়তো দাদুর কাঁধে চড়ে বসেছে আর চলতে না পেরে!
গিজগিজে ভিড়টা দেড় কিলোমিটার যাওয়ার পরে গিয়ে পড়ল বাসস্ট্যান্ডে। সেখানেও ধাক্কাধাক্কি। প্রচুর পুলিশও সামলাতে পারছে না। একের পর এক বাস এসে দাঁড়াচ্ছে অবশ্য। বেশি লড়াইয়ের মধ্যে না গিয়ে, ভাবছিলাম খানিক ফাঁকা হলে চেষ্টা করতে হবে। যদিও তা হওয়ার কথা নয়। কারণ জোয়ার রয়েছে বলে একের পর এক বার্জ ও লঞ্চ আসছে কাকদ্বীপ থেকে। উগরে দিচ্ছে মানুষ। কিছু ক্ষণ পরে হঠাৎ একটা বাসে উঠে পড়া গেল। কেন কে জানে, সেটা বেশ ফাঁকা। যাক, ওঠা গেল এই ঢের। এখনও তো আরও তিরিশ কিলোমিটার পথ বাকি!হু হু করে বাস ছুটছে। বাইরে অন্ধকার বলে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কখনও কখনও দোকানপাট বা সরকারি ভবনের আলো আচমকা। তেমনই আলোয় একবার দেখতে পেলাম একটা বাড়ির গেটের মাথায় লেখা নারায়ণী আবাদ উচিত বালক সংঘ। বাসে কন্ডাক্টর ছাড়া কেউ কোনও কথা বলছে না তেমন। এক দাদাজি ঘুমে ঢুলে পড়ায় তাঁর মাথা আমার কোমরে ধাক্কা দিচ্ছিল বারবার। ‘গির য়ায়েঙ্গে আপ’ বলায় মুখ তুলে এমন সরল হাসি হাসলেন, যে বড্ড মায়া হল। হয়তো দু’রাত জেগে জেগেই আসতে হয়েছে এঁকে। আমিও তো ক্লান্ত। বসার জায়গা পেলে হয়তো আমার মাথাও অন্য কারও কোমরে খোঁচা দিত!
বেশি ক্ষণ এই ভাবে থাকতে হল না যদিও। পৌঁছে গেলাম গঙ্গাসাগরে। সবাই সচকিত। হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়তে শুরু করল। আমিও নামলাম। চার দিকে আলো। তাঁবু। হোগলা পাতার ঘর তীর্থযাত্রীদের জন্য। মনে হচ্ছিল এই যে এলাম, কত ঝামেলা পুরিয়ে এলাম, কষ্টও তো কম হল না। কিন্তু একই সঙ্গে ভাবছিলাম, এখনই যদি এই হয় তা হলে আগে মানুষজন আসত কী করে এইখানে? তখন তো এই জায়গা রীতি মতো দুর্গম। সেটাই কি গঙ্গাসাগরের স্থান মাহাত্ম্য?
সুন্দরবন সমুদ্রের কাছে বিস্তীর্ণ নিম্নভূমি অঞ্চল। সমুদ্রে জোয়ারের সময়ে কিছু কিছু এলাকা ডুবে যায়, ভাটার সময়ে জেগে ওঠে। এই জন্য এই অঞ্চলটিকে এক সময় ‘অষ্টাদশ ভাঁটিদেশ’ বা ‘আঠারো ভাঁটি’ বলা হত। মনে করা যেতে পারে, বঙ্গোপসাগরের এই এলাকায় আঠেরোটি প্রদেশ ছিল। হিন্দু-বৌদ্ধ যুগে এরই নাম ছিল সমতট।
দেখুন গঙ্গাসাগরের ঝলক।
সামগ্রিক ভাবে ২৪ পরগণা জেলা থেকে ১৯৮৬ সালে যখন দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার আবির্ভাব ঘটল, তখন তার নিজস্ব সত্তা নিয়েও উঠে এল অনেক কথা। জেলাটি আদতে পলিতে তৈরি সমভূমি। দক্ষিণ বঙ্গের এই বিচিত্র অঞ্চলটির কথা যে পৌরাণিক কাহিনিতে আছে, সে তো ইতিমধ্যেই জ্ঞাত। মহাভারতে রয়েছে যুদ্ধিষ্ঠিরও তীর্থভ্রমণে বেরিয়ে বঙ্গদেশের বিখ্যাত তীর্থ সাগরসঙ্গমে এসেছিলেন।
এই অঞ্চলে যে বহু ছোটো-বড় দ্বীপ রয়েছে সে কথা এখন আর আলাদা করে বলার দরকার পড়ে না। গঙ্গাসাগরে আসার জন্য যে কচুবেড়িয়ার পৌঁছতে হল তা-ও এমনই এক দ্বীপ। এ ছাড়াও আছে ঘোড়ামারা, কাশতলা, মুড়িগঙ্গা, রুদ্রনগর ও আরও অনেক। বাসে আসতে আসতে যে নারায়ণী আবাদ দেখেছিলাম, সেটিও আসলে একটি দ্বীপ। আর গঙ্গাসাগরে নেমে যে রামকৃষ্ণ মিশনে মাথা গোঁজার ঠাঁই হল, তারও ঠিকানা মনসাদ্বীপ।
আশ্রমের গেট ঠেলে ঢুকে অস্থায়ী অভ্যর্থনায় যাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তিনি অনুপকুমার জানা। গম্ভীর মানুষ। তবে আমার জন্য একটি জায়গার ব্যবস্থা করে দিলেন হাসি মুখেই। সাগরমেলার এই সময়েই আশ্রমে যাত্রীদের ভিড়। অন্য সময় ফাঁকাই থাকে। তখন দেখভাল করার জন্য থাকেন শ্রীহরিবাবু। এখন ভিড় সামলাতে, আশ্রমের অতিথিদের যত্নআত্তি করতে যে তরুণদল ছোটাছুটি করছেন তাদের মধ্যে চোখে পড়ে সুমন মণ্ডল ও সুদীপ মণ্ডলকে। আছেন গৌতম ও পুলকও।
রাতেই শুনেছিলাম মেলার নানা রকম মাইকে নানা রকম গান বাজছে। সবই ভক্তিগীতি। কোথাও রাম, কোথাও কৃষ্ণ। সরকারি ঘোষণাও কানে আসছে। কোথাও কেউ অসুস্থ, তো কোথাও কেউ হারিয়ে গিয়েছে বলে। মূল মাঠ, যেখান কপিল মুণির আশ্রম, সেখানে সারা রাত ধরে আক্ষরিক অর্থেই মেলা বসে রয়েছে। মাটিতে শাখা, পলা, নানা রঙের সিঁদুর, কাঁসা-পিতলের ঘটি, গঙ্গা মাইকি ছবি, হিং, শিলাজিৎ থেকে শুরু করে রুদ্রাক্ষ অবধি। এক পাশে সারি সারি মারোয়াড়ি ধাবা, পাঞ্জাবী ধাবা। লাটকে লাট রুটি সেঁকা হচ্ছে। নামেই ও রকম। আসলে সবই বাঙালি রাঁধুইকরের হোটেল। এখানে যেহেতু অবাঙালি তীর্থযাত্রীই নব্বই ভাগ, তাই এমন ব্যবস্থা। এরই মাঝে অনেকে মাটিতে কাপড়, চাদর, খড়, প্লাস্টিক বিছিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে সটান শুয়ে খোলা আকাশের নীচে। মেলা এখন আলোকনগরী। জনস্রোত অবিরাম। এই স্রোতে ঢেউ উঠবে যখন, তা রওনা দেবে সাগরসঙ্গমের দিকে।
কোথায় যেন শাঁখ বেজে উঠল। ভগীরথের শঙ্খনিনাদ তো এ নয় নিশ্চয়। অজস্র শাঁখের দোকানের মধ্যে কোনও এক দোকানে, কোনও ক্রেতা বাজিয়ে দেখে নিচ্ছেন কেনার সময়ে। গঙ্গা তো এসে পৌঁছে গিয়েছে বহু কাল আগেই। এ বার মানবসাগর মিলবে গঙ্গাসাগরে। মকর সংক্রান্তির স্নানের আকাঙ্ক্ষায়।
অরিন্দম বসুর এখনও পর্যন্ত আটটি উপন্যাস, দেড় শতাধিক গল্প ও একটি ভ্রমণ কাহিনি প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত গ্রন্থ বারোটি। উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি’র পুরস্কার, ‘নমিতা চট্টোপাধ্যায় সাহিত্য পুরস্কার’। গল্পের জন্য পেয়েছেন ‘গল্পসরণি’ ও ‘গল্পমেলা’ পুরস্কার, নবীন সাহিত্যিক হিসেবে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’-এর পুরস্কার।
আরও পড়ুন:
https://www.four.suk.1wp.in/feature-gangasagar-travel-arindam-basu-1/