
রূপাঞ্জন গোস্বামী
বিকিনি একটি আল্ট্রা-মড পোশাক। আমরা তো প্রায় সকলেই এমনটাই ভাবি! পঞ্চাশ ষাটের দশকে উঠে আসা নারী স্বাধীনতা ও যৌন বিপ্লবের সঙ্গেও বিকিনিকে জড়িয়ে দিয়েছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু সত্যিটা হল, সময়ের মাপকাঠিতে যে আধুনিকতা মাপা হয়, বিকিনির উৎস তার থেকে বহু, বহু দূরে।
বিখ্যাত ফ্যাশন পত্রিকাগুলির কভার থেকে শুরু করে হলিউডি ছবিগুলির দৃশ্য— বিকিনি পরা লাস্যময়ী সুন্দরীদের দেখে রক্ত উথালপাথাল হয় না এমন পুরুষ বিশ্বে বিরল। ব্রাজ়িলকে বিশ্ব চেনে ফুটবল আর ব্রাজ়িলের সৈকতে বিকিনি পরা তামাটে সুন্দরীদের জন্য। আপনি স্বীকার করুন বা নাই করুন, বিকিনি পরা নারীদের দেখার জন্যই অনেক বাঙালি গোয়ায় ঘুরতে যান। তাই বিকিনিকে রক্তে নেশা লাগানো পোশাক বললে অত্যুক্তি হবে না।
বিকিনির আবিষ্কারক ফরাসি ইঞ্জিনিয়ার লুই রিওয়ার্ড। ১৯৪৬ সালেই মায়ের লজাঁরি বুটিক চালাতে চালাতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউনিফর্ম তৈরির জন্য কেনা, কিন্তু অব্যবহৃত কাপড় দিয়ে টু-পিস সুইমস্যুট তৈরি করেন। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ ‘বিকিনি অ্যাটলে’ অনুষ্ঠিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক পরীক্ষা অপারেশন ক্রসরোডসের নামানুসারে তিনি তাঁর সদ্য আবিষ্কৃত পোশাকের নাম রাখেন বিকিনি। বিকিনিকে বানিজ্যিক ভাবে ১৯৪৬ সালে প্রথম বাজারে নিয়ে আসেন ফরাসি ফ্যাশন ডিজ়াইনার জ্যাকুইস হেইম। যার নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘অ্যাটম’। হয়তো ১৯৪৫ সালের জাপানে পারমাণবিক বিস্ফোরণে অনুপ্রাণিত হয়েই চেয়েছিলেন, তাঁর তৈরি বিকিনি আণবিক বিস্ফোরণের মতোই কাঁপিয়ে দেবে বিশ্বকে।
হ্যাঁ, কাঁপিয়েই দিয়েছিল। ভাইরাল শব্দটা তখন এখনকার মতো অর্থ নিয়ে ব্যবহার হতো না। কিন্তু তখন ভাইরালই হয়েছিল এই পোশাক। এক বছরের মধ্যে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গিয়েছিলো বিকিনি। তার পরে দশকের পর দশক ধরে বিবর্তিত হয়েছে বিকিনি। বিশ্বের তাবড় তাবড় ফ্যাশন ডিজ়াইনারের হাতে পড়ে অনেক নতুনত্ব ও রকমফের এসেছে তাতে। এখন বিকিনির কতো নাম! বানডিউকিনি বা স্ট্র্যাপলেস বিকিনি, মাল্টিস্ট্রিং বিকিনি, স্ট্রিং বিকিনি, মাইক্রোকিনি-টাংকিনি, স্কারটিনি-হাইওয়েস্টেড বিকিনি, ফ্রিঞ্জ বিকিনি, ফ্লাউন্স বিকিনি ইত্যাদি।
কিন্তু আপনি কি জানেন, বিকিনি আসলে সেকেলে বা মান্ধাতার আমলের একটি পোশাক? ৫৬০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দেও বিকিনির চল ছিল। তার প্রমাণও রীতিমতো সংরক্ষিত আছে গ্রিসের মিউজ়িয়ামে । বিকিনি থাকার সব চেয়ে প্রাচীন প্রমাণটি পাওয়া যায় তাম্র যুগে। সে সময়ের দক্ষিণ আনাতোলিয়ার এক অংশে কাতাল হোইউক নামক এক সুপ্রাচীন দেবীর পিছনে দু’পাশে দু’টি চিতা উপবিষ্ট ছিল। যাদের পরনের পোশাক এখনকার বিকিনির সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। প্রত্নতত্ত্ববিদরা পম্পেইয়ে রোমান দেবী ভেনাসের বিকিনি পরিহিত থাকার প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন। ভেনাসের একটি মূর্তিতে এই প্রমাণ পাওয়া যায়।
১৯৫০ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা সিসিলির পিয়াজ্জা আর্মেনিয়া অঞ্চলে, একটি সুপ্রাচীন রোমান দুর্গ পরিস্কার করতে গিয়ে একটি কুঠুরির দেওয়ালে ১৪০০ বছর আগেকার ম্যুরাল পান। ম্যুরালটি দেখে চমকে যান প্রত্নতত্ত্ববিদরা । বিকিনি পরা প্রাচীন রোমান নারীদের ছবিসারা ম্যুরালটি জুড়ে। করোনেশন অফ উইনার নামক ম্যুরালটিতে দশ জন বিকিনি পরা রোমান নারীর ছবি আছে। যারা বিভিন্ন শারীরিক কসরৎরত। হাতে ভার নিয়ে লংজাম্প, ডিসকাস থ্রো, হ্যান্ডবলের মতো কোনও খেলা। এই চারশো খিস্টাব্দের রোমান ভিলা বা রোমানা ডেল ক্যাসেলকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। কারণ এর ভেতরে যে ম্যুরালগুলি পাওয়া গেছে তা এখনও পর্যন্ত আবিস্কার হওয়া সেরা ম্যুরাল বলে স্বীকৃত হয়েছে।
তাই এর পর থেকে কোনও পোশাক বোঝাতে ‘সেকেলে‘ বা ‘মান্ধাতার আমলের‘ মতো শব্দগুলিকে আর ব্যবহার করবেন কি না, ভেবে দেখুন।