
দ্য ওয়াল ম্যাগাজিন ব্যুরো: রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী দেবীর সংসারে মোট পাঁচটি সন্তান। মাধুরীলতা, রেণুকা, মীরা, রথীন্দ্রনাথ ও শমীন্দ্রনাথ। মাত্র ১৩ বছর বয়সে মারা যান ছোটো ছেলে শমীন্দ্রনাথ। মাধুরীলতা আর রেণুকাও মারা যান রবীন্দ্রনাথের জীবিতাবস্থায়। একমাত্র ছোটো মেয়ে মীরাই দীর্ঘজীবী ছিলেন। কিন্তু তাঁর দীর্ঘ জীবন ছিল দুঃসহ অভিশাপের মতো। বাবা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ নিজেও ছিলেন চরম দুঃখী (Father Rabindranath)। স্বামী-বিচ্ছিন্ন মীরার (অতসী) দুঃখ ও যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে বাবা হয়েও একবার তাঁর মৃত্যু কামনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বড় ছেলে রথীকে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন: “ওর জীবনের প্রথম দণ্ড তো আমিই ওকে দিয়েছি— ভালো করে না ভেবে বুঝে আমিই ওর বিয়ে দিয়েছি। …বিয়ের রাত্রে মীরা যখন নাবার ঘরে ঢুকছিল তখন একটা গোখরো সাপ ফস্ করে ফণা ধরে উঠেছিল— আজ আমার মনে হয় সে সাপ যদি ওকে কাটত তাহলে ও পরিত্রাণ পেত।”
৪১ বছর বয়সে বিপত্নীক হন রবীন্দ্রনাথ। স্ত্রীর মৃত্যুর পরপরই মেজ মেয়ে রেণুকা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। রেণুকার স্বামী সত্যেন্দ্রনাথকে তিনি নিজের পয়সায় বিলেতে পাঠিয়েছিলেন ডাক্তারি পড়তে। বহু চিকিৎসার পরেও মৃত্যুপথযাত্রী রেণুকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।

কবির সবচেয়ে আদরের মেয়ে মাধুরীলতা বা বেলা। খুব জাঁকজমক করে বেলার বিয়ে দিয়েছিলেন কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর ছেলে শরৎচন্দ্রের সঙ্গে। বড় জামাই, বিয়ের পর তাঁকেও নিজের টাকায় বিলেতে পাঠান ব্যারিস্টারি পড়তে। সেখান থেকে ফিরে এসে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে চার বছর প্রায় ঘর-জামাই হয়ে বাস করেন শরৎচন্দ্র। অর্থপিশাচ ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ এ নিয়ে বিবাদ শুরু করলে রেগেমেগে সে বাড়ি ছেড়ে স্ত্রীকে নিয়ে শ্রীরামপুরের পৈতৃক নিবাসে চলে যান। এই ঘটনার পর থেকেই শ্বশুর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের সম্পর্ক বিষিয়ে ওঠে। শ্রীরামপুরে গিয়ে মাধুরীলতা অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় প্রায় রোজ মেয়েকে দেখতে যেতেন রবীন্দ্রনাথ। বিষণ্ণ বাবার হাত ধরে বসে থাকত মৃত্যুপথযাত্রী বেলা (Father Rabindranath)। অন্যদিকে টেবিলের ওপর পা রেখে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে কবিকে অপমানজনক মন্তব্য করতেন উদ্ধত ও বর্বর শরৎচন্দ্র। দিনের পর দিন সেই অপমান নীরবে সহ্য করেছেন রবীন্দ্রনাথ। একদিন মাঝপথে খবর এল বেলা মারা গেছে। তিনি আর ওপরে উঠলেন না। নিঃশব্দে বাড়ি ফিরে এলেন। গোপনে গিলে নিলেন শোক। কেউ বুঝতে পারল না, তিনি কী হারিয়েছেন।

ছোটো মেয়ে মীরার বিয়ে হয়েছিল মাত্র ১৩ বছর বয়সে। জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তখন ১৭ বছর ৭ মাসের নবীন কিশোর। বিয়ে হয়েছিল শান্তিনিকেতনে। বিয়ের শর্তই ছিল জামাইকে প্রচুর যৌতুক দিতে হবে আর বিয়ের পর আমেরিকায় পাঠাতে হবে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী এই তরুণকে সেদিন রবীন্দ্রনাথ নিজেই ছোটো মেয়ের উপযুক্ত জামাই হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। তারপর সারা জীবন অনুতাপের আগুনে দগ্ধে মরেছেন (Father Rabindranath)।
নগেন্দ্রনাথ ছিলেন চরম স্বেচ্ছাচারী। বর্বরতা ছিল তাঁর শিরায় মজ্জায়। এই স্বামীকে কোনওদিন ভালবাসতে পারেননি মীরা। বাবা হিসেবে মেয়ের এই দুঃসহ জীবন দেখে গোপন অপরাধবোধে ভুগতেন কবি (Father Rabindranath)। ভাবতেন, তাঁর চাপিয়ে দেওয়া বিয়ের জন্যই মেয়েটার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে।

ঠাকুরবাড়ির রেওয়াজ ছিল পাত্র বিয়ের দিন উপবীত ধারণ করবে। কিন্তু সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য নগেন্দ্রনাথ নাকি উদ্ধতভাবে সেই উপবীত ছুঁড়ে ফেলে দেন। বিদেশে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথের কাছে বারবার তিনি চিঠি লিখতেন। দাবি একটাই, টাকা… আরও টাকা। উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখতেন, “আমার জমিদারি থেকে আমি মাত্র পাঁচশত টাকা গ্রহণ করি। সেই টাকা তো আমি পুরোটাই তোমাকে দিয়ে দেই। এখন আমি ধারের উপরে আছি।”
কৃষি বিজ্ঞানে স্নাতক হয়ে আমেরিকা থেকে ১৯১০ সালে দেশে ফেরেন নগেন্দ্রনাথ। তখন তাঁর কোনও নির্দিষ্ট কাজকর্ম নেই, আয় নেই, অথচ বেহিসেবী জীবনযাত্রা। এ নিয়ে কবির সঙ্গে মতান্তর ও মনান্তর শুরু হয় আর তার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম নেমে আসে মীরার উপরে।
উদ্ধত ও অত্যাচারী স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একদিন মীরা ফিরে আসেন বাবার আশ্রয়ে। কিছুতেই তিনি ফিরে যাবেন না স্বামীর কাছে। রবীন্দ্রনাথও পরম মমতায় আশ্রয় দেন মেয়েকে (Father Rabindranath)। মীরা ও নগেন্দ্রের আইনসম্মত বিচ্ছেদ ঘটে ১৯২৯ সালে। আদরের ছোট মেয়ের বসবাসের জন্য পরে শান্তিনিকেতনে ‘মালঞ্চ’ নামের একটি বাড়ি তৈরি করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

একটি চিঠিতে সেই সময় ছোটো জামাই নগেন্দ্রনাথকে তিনি লিখছেন: “তোমার অধৈর্য, অসহিষ্ণুতা, তোমার আত্মসংবরণে অসাধ্যতা, তোমার দুর্দান্ত ক্রোধ, এবং আঘাত করবার হিংস্র ইচ্ছা, সাংসারিক দিক থেকে আমাকে অনেক সময়ে কঠিন পীড়া দিয়েছে।” (চিঠি, ১১ অগ্রহায়ণ, ১৩২৬)।
অন্য একটি চিঠিতে কবি লিখেছেন, “মীরা যে প্রশান্ত গাম্ভীর্যের সঙ্গে নিঃশব্দে আপন দুঃখবহন করে, তাতে ওর মুখের দিকে তাকালে আমার চোখে জল আসে। ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওকে কোনও জীবনযাত্রা বহন করতে যদি প্রস্তুত হতে হয়, তবে সে চিন্তা আমার জন্য দুর্বিষহ।” (চিঠি, ২০ ফাল্গুন, ১৩২৬)
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘দেনা পাওনা’, ‘হৈমন্তী’, ‘স্ত্রীর পত্র’ এবং আরও কিছু গল্পে পণপ্রথা ও বধূনিগ্রহের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অথচ ব্যক্তিগত জীবনে নিজে আর পাঁচটা কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতোই কাঁড়ি কাঁড়ি বরপণ দিয়ে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন (Father Rabindranath)। নিজের টাকায় জামাইদের ইউরোপে আর আমেরিকায় পাঠিয়েছেন। মুখ বুজে তাঁদের অপমান, ঔদ্ধত্য, বর্বরতা সহ্য করেছেন। বাবা হিসেবে তাঁর এই অসহায়তা আমাদের অবাক করে।