
Empowered Women film: পর্দায় নায়িকা, জীবনে যোদ্ধা! বাংলা বায়োস্কোপের ১১ বিজয়িনী
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
সিনেমায় যেসব মেয়ে আসে (Empowered Women film), তারা সবাই খুব সস্তা– এ প্রবাদ আজও শোনা যায় সমাজের নানা স্তরে। কিন্তু আদতে প্রতিভা আর অধ্যবসায়ের কতটা জোর থাকলে যে এই ‘সস্তা’ পথে মাথা উঁচু করে খ্যাত হওয়া যায়, তা অনেকেই জানেন না। আবার এই সব খ্যাতির আড়ালেও যে ঠিক কতটা লড়াই থাকে কত জনের, তা বেশিরভাগই জানেন না (life)।
জানেন না, নিছক শখে নয়, পেটের জ্বালায় বা রিফিউজি হওয়ার যন্ত্রণায় বাধ্য হয়ে কত জন এসেছেন এই রুপোলি জগতে। আমরা জানি, একসময়ে মেয়েদের ভূমিকাতে ছেলেরাই অভিনয় করতেন। এখন সেই যুগ পার করে, বহু শিক্ষিতা নারীও সফলতম অভিনেত্রী (Actress) হয়েছেন গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডে। কিন্তু এই যাত্রাপথ কি একদিনের? এই যাত্রাপথ কি আদৌ মসৃণ? দুটো প্রশ্নেরই উত্তর, এক কথায় না।
তাই এবছরের আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসে আমরা বেছে নিলাম, সেযুগ-এযুগ মিলিয়ে ১১ জন নারীকে, যাঁরা ছবিতে আসার আগে ও পরে বহু লড়াই করে এই জায়গাটায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, অনেক মিথ ভেঙে নারীর সম্মান প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন (Empowered Women film)।
কাননবালার জীবনটা ছিল চিত্রনাট্যের মতো (Empowered Women film)
নিরাশ্রয়া, সম্বলহীনা, বিধবা মায়ের হাত ধরে এক আত্মীয়ের বাড়ি আশ্রয় নিয়েছিল বালিকা কানন। রান্না আর বাড়ির কাজ করতে হতো মা মেয়েকে। শর্ত ছিল, বিনা বেতনে সমস্ত কাজ করে দিলে তাদের দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন জুটবে। একদিন কাননের মায়ের হাত থেকে কাচের কাপ পড়ে ভেঙে যাওয়ায় আত্মীয়রা চরম দুর্ব্যবহার করল তাঁর সঙ্গে।
বালিকা কানন বলেছিল, “মা এই বাড়িতে আর এক মুহূর্ত নয়। না খেয়ে মরব তবু এখানে থাকব না।” মা-মেয়ে চলে গেছিল এক বস্তিতে। সেখানেই তুলসীদাস বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক ব্যক্তির হাত ধরে বায়োস্কোপে আসে কানন। যেতে-আসতে ট্রামে চড়তে পারবে, সেই আনন্দেই প্রথমে রাজি হয়ে যায় সে। চরম দারিদ্র্যের মুখে রোজগারের হাতছানি তো ছিলই (Empowered Women film)।
কাননের প্রথম ছবি নির্বাক যুগে ‘জয়দেব’। প্রথম সবাক ছবি ‘জোরবরাত’। প্রথম আয় ছিল পাঁচ টাকা। তাতেই কানন ভেবেছিলেন, এত টাকায় যেন সারা কলকাতা শহর কিনে নিতে পারবেন। মায়ের হাতে দিয়েছিলেন টাকা। পরে জেনেছিলেন, আসলে পারিশ্রমিক ছিল পায় পঁচিশ টাকা। মধ্যবর্তী লোক বাকিটা নিয়ে নিয়েছে।
‘শ্রীগৌরাঙ্গ’তে বিষ্ণুপ্রিয়া চরিত্র করে প্রথম সাফল্য পেলেন কাননবালা।
‘মুক্তি’ রের্কড হিট করল। বদলে গেল জীবনের ছবিও। অত্যাচারিতা পরিচারিকার মেয়ে থেকে সমাজের শীর্ষস্থানীয়াদের অন্যতমা, টালিগঞ্জ সম্রাজ্ঞী, সমাজের কল্যাণকর্মে এগিয়ে আসা, অভিনেত্রী-মহিলা-শিল্পী সংঘের প্রতিষ্ঠাত্রী হয়ে উঠলেন দীপ্তিময়ী কানন দেবী। পরে তৈরি করেছেন নিজের প্রোডাকশন হাউস ‘শ্রীমতী পিকচার্স’। (Empowered Women film)
ধূলিকনা থেকে খ্যাতির গগনে এই উত্তরণ এক রকম চিত্রনাট্যই নয় কি? অথচ এই কানন দেবী সংসারজীবনে ছিলেন পরম মমতাময়ী ও সাধারণ। নিজের কাজ নিজেই করতেন বরাবর। প্রায়ই অচেনা ছেলেপুলেদের ঠাকুরঘরে ডেকে গোপালের ভোগ পায়েস নিজে হাতে খাওয়াতেন। যে বালিকাকে একদিন দু’মুঠো ভাত দেয়নি সমাজ, সেই বালিকাই বড় হয়ে বহু দরিদ্র মানুষের পাশে দাড়িয়েছেন অন্নপূর্ণা রূপে। প্রথম গ্ল্যামার গার্ল বলা হতো কাননকে। কিন্তু স্রেফ গ্ল্যামারেই ভেসে যাননি তিনি। নিজেকে সম্পূর্ণা রূপে তৈরি করে সমাজের অনন্যা হয়েছেন। বহু অভিনেত্রীর গডমাদার হয়েছেন (Empowered Women film)।
নায়িকা থেকে পরিচালিকা তিনিই প্রথম, মঞ্জু দে (Empowered Women film)
মঞ্জু দে সেসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করা নায়িকা। তিনি মোটর রেসিংয়ে প্রথমা, ক্রিকেট খেলাতেও পারদর্শী। তখন আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনারা ছাড়া পেয়েছেন ব্রিটিশ কারাগার থেকে। তাঁদের সংবর্ধনা দেওয়া হয় দেশপ্রিয় পার্কে। ভলান্টিয়ার্স দলে ছিলেন মঞ্জু দে (Empowered Women film)। গার্ড অফ অনার দিয়েছিলেন যে মেয়েরা, তাঁদের লিড করেন মঞ্জু। এই প্যারেডে দেখেই পরিচালক সুশীল মজুমদার ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে ডেকে নিয়েছিলেন মঞ্জু দে-কে।
তাঁর সেদিনের প্যারেডের একটা অংশ রেকর্ডও করে রেখেছিলেন সুশীল। পরে ‘সিপাহী কে সপনা’ ছবিতে সুশীলবাবু এই দৃশ্যটি ব্যবহার করেন। মঞ্জুর প্রথম ফিল্মে অভিনয় হিসেবে থেকে যায় এই হিন্দি ছবিটিই। পরে তাঁর বিয়ে হয় দেবব্রত দে-র সঙ্গে। শ্বশুর ক্ষেমেন্দ্র চন্দ্র দের ইচ্ছাতেই মঞ্জু পুরোদমে ফিল্মে কাজ করেত শুরু করেন। হেমেন গুপ্তর ‘বিয়াল্লিশ’ ছবিতে প্রথম শ্যুট। তবে তার আগেই রিলিজ করে তাঁর অভিনীত এক বাংলা ছবি ‘জিঘাংসা’।
এসবের মধ্যেই ফিল্ম লাইনে মঞ্জু প্রেমে পড়লেন তপন সিনহার। তপন সিনহার প্রথম দিকের প্রায় সব ছবিই মঞ্জু দে-র টাকায় তৈরি হয়। তপন সিনহার উপহার, টনসিল, কাবুলিওয়ালা, লৌহকপাট– সব ছবিতেই ছিল মঞ্জুর হাতের স্পর্শ। কিন্তু অনেক বড় পরিচালক হিসেবে খ্যাতি পেয়ে গিয়ে, একসময়ে মঞ্জুর প্রয়োজন হয়তো ফুরিয়ে যায় তপন সিনহার কাছে।
এ ধাক্কা সহ্য করতে পারেননি মঞ্জু (Empowered Women film)। তাঁর নিজের সংসারও ভাঙছিল। এ সময়ে তিনি মন দিলেন ছবি পরিচালনায়। এবং ভারতর্ষের সবাক চলচ্চিত্রের মহিলা পরিচালিকা হয়ে উঠলেন এই মঞ্জু দে। নিজের পরিচালনায় বানালেন প্রথম ছবি, ‘স্বর্গ হতে বিদায়’। এরপর ‘অভিশপ্ত চম্বল’। দস্যুরানি পুতলীবাইয়ের ভূমিকায় নিজেই অবতীর্ণ হলেন। ‘সজারুর কাঁটা’ শেষ পরিচালিত ছবি।
অনেকে বলেন, বিরাট মাপের প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন মঞ্জু দে। সঠিক ভাবে তাঁর প্রতিভার ব্যবহার হয়নি। শেষ জীবনে প্রেমে আঘাত পেয়ে এক সাধুবাবার পাল্লায় পড়েছিলেন তিনি। তাঁকেই দান-ধ্যান করে দিয়েছিলেন ওঁর যা ছিল। নির্বান্ধব অবস্থায় চলেও গেলেন মাত্র ৬৩ বছর বয়সে। নায়িকা থেকে পরিচালিকা তিনিই প্রথম। সেই পথেই পরে হেঁটেছেন অপর্ণা সেন, চূর্ণী গাঙ্গুলিদের মতো প্রতিভাবানরা (Empowered Women film)।
সুচিত্রা সেন (Suchitra Sen), নারীর সম্মান প্রতিষ্ঠা করেন নায়িকা (Actress) হিসেবে
তাঁর মুখ এতটাই সুন্দর ছিল, যে ক্যামেরা ঘোরানোই কঠিন হতো। কিন্তু বাংলা ছবিতে সুচিত্রা সেনের অবদান শুধুই তাঁর রূপ বা তাঁর ভুবনভোলানো হাসি বা হরিণী চাহনি নয়। তাঁর আসল ইউএসপি হল, তাঁর আভিজাত্য। কাননবালার অভিনয় জীবনের নীল নকশায় সুচিত্রার যাত্রাপথ আঁকা হয়। নায়িকাদের জন্য পার্সোনাল মেক আপ রুম সুচিত্রাই চালু করেন।
নারী সর্বংসহা নয়, ম্যানেজ করাই তার কাজ নয়। এ কথা জোর গলায় ঘোষণা করে নারী শিল্পীদের প্রতি অবজ্ঞা দূর করেছেন তাঁর অনমনীয় ব্যক্তিতের দাপটে। এককথায় বলতে গেলে পুরুষশাসিত ফিল্ম জগতে নায়িকার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। শোনা যায়, তিনি সকলকে বলে দিলতেন, সেটে যেন তাঁর নাম ধরে নয়, তাঁকে ম্যাডাম বা মিসেস সেন বলে ডাকা হয়। সমীহ করে সকলে ডাকতও তাই (Empowered Women film)।
এই সমীহর গরিমাতেই বোধহয় তিনি ছিঁড়ে ফেলেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের দেবী চৌধুরানীর কন্ট্রাক্ট। এই সমীহের খাতিরেই তাঁকে দিয়ে ছবি করানোর প্রস্তাব নিয়ে একরাশ লাল গোলাপ নিয়ে তাঁর বাড়িতে হাজির হয়ে তাঁর পায়ের কাছে বসে সিনেমায় অভিনয় করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন রাজ কাপুর।
সুপ্রিয়া (Supriya Devi) নাকি রক্ষিতা! তবু তাঁর রেসিপি সবার শেখা চাই (Empowered Women film)
তাঁর মুখেই সেই বিখ্যাত ডায়লগ “দাদা আমি বাঁচতে চাই”। আসলে ভূমিষ্ঠ হওর দিন থেকেই তাঁর বাঁচার লড়াই শুরু। তাঁদের আর্থিক অনটনের সংসারে বছর বছর কন্যাসন্তান যেন সকলের কাছেই অনাদৃত। সূতিকাগৃহে অষ্টম কন্যাসন্তান তিনি। তিনি ভূমিষ্ঠ হবার সঙ্গে সঙ্গে সারা সংসার বলে ওঠে “আবার মাইয়া”।
নিদারুণ হতাশায় যে শিশুকন্যাকে তাঁর মা পা দিয়ে ঠেলে দিয়েছিল। শোনা যায়, সূতিকাগৃহে রাখা আগুনের মালসায় পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছিলেন একরত্তি মেয়েটি। সেদিন থেকেই লড়াই শুরু। বাড়ির দেওয়া নাম কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্মা থেকে দু’মাস পায়ে হেঁটে কলকাতা এসেছিলেন কৃষ্ণা। অনটন, দেশভাগ ইত্যাদি কারণে পড়াশোনা হল না। সিনেমায় নামা হল বাধ্য হয়ে। পরে তাঁর নাম সুপ্রিয়া দেন, তাঁর পিতৃতুল্য অভিনেতা পাহাড়ী সান্যাল।
তিনি সমাজ-সংসারে উত্তমকুমারের এক্সট্রা ওম্যান হয়ে থেকে গেছেন। অথচ নিজের পুরুষটিকে কলঙ্কমুক্ত করে রেখেছেন জীবনের শেষদিন অবধি। প্রথম স্বামীর আবার বিয়ে দিয়েছেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। তাঁকে নিয়ে সংবাদ মাধ্যম চিরকাল লিখেছে, তিনি রূপ ও যৌবনে ভরপুর। আদতেই ষাট পেরিয়েও আগুনযৌবনা ছিলেন সুপ্রিয়া। তখনও বাথটাবে শুয়ে বাংলা ছবিতে সাহস দেখিয়ে ‘খবর’ হয়েছেন। পরে জরা থাবা বসালেও, নিজেকে আড়াল করেননি তিনি। সব বয়সের রূপেই যে একটা সৌন্দর্য্য আছে, তা প্রমাণ করে গেছেন।
আবার সেকেন্ড ওম্যান বলে সমাজের হাসিঠাট্টার শিকার হয়েও, নব্বই দশকে কি তার পরেও ‘ঘরেঘরে সব বউমাদের’ রান্না শিখিয়ে গেছেন ভালোবেসে। দর্শকরা তাঁকে নষ্টা বললেও, তাঁদের তিনি শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন বরাবর। শোনা যায়, সংবাদ-মিডিয়া যখন তাঁকে উত্তম-সঙ্গিনী লিখে বিঁধছেন, সুপ্রিয়া তাঁদেরও রান্না করে পাত পেড়ে খাইয়েছেন। মানুষকে নিজে হাতে রেঁধে-বেড়ে খাইয়ে মন জয় করে নিয়েছেন অনেকের (Empowered Women film)।
তবে ‘মেঘে ঢাকা তারা’র নীতা হবার কথা ছিল গীতা দে-র (Empowered Women film)
১৯৩৭ সালে মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি ‘আহুতি’ ছবিতে অভিনয় করেন। আরও বহু শিশু চরিত্র করেন তিনি। পরে বিয়ে, সংসার হলেও সে সব টেকে না। বড়লোক শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াতে হয়। অভিনয় শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এসে পড়েন নাট্যসম্রাট শিশিরকুমার ভাদুড়ির কাছে। গীতা দের অভিনয় চিনতে দেখতে হবে ‘ডাইনি’ ছবি। তিনিই কেন্দ্রীয় চরিত্র। তবে ডাইনি গীতাকে কেউ মনে রাখেনি। মায়ের রোল কিংবা দজ্জাল শাশুড়ি মামিমার রোলেই তিনি বিখ্যাত।
অথচ তাঁর নায়িকা হওয়ার কথা ছিল ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিতে। কিন্তু ডিস্ট্রিবিউটর সংস্থা চাইলেন অন্য জনকে। ঋত্বিক বললেন, “গীতা মায়ের রোল করতে করতে পারবি বাঙাল ভাষায়?” মাত্র আঠাশ বছর বয়সে নায়িকার রোল ছেড়ে মায়ের রোলে নেমে পড়লেন গীতা। তার পর থেকে মায়ের রোলেই আইকনিক হয়ে গেলেন। সত্যজিৎ রায়ের ‘সমাপ্তি’ কি অঞ্জন চৌধুরী প্রভাত রায় বিজয় বসু সবার ছবিতেই গীতা মাস্ট।
তবে আধুনিকা চরিত্রে গীতা দে-কে আমরা পেলাম যাত্রিকের ‘কাচের স্বর্গ’ এবং অরবিন্দ মুখার্জ্জীর ‘মৌচাক’-এ। যদিও অভাব তাঁর পিছু ছাড়েনি। দু’শো ছবি ও প্রচুর নাটক, প্রচুর সিরিয়ালে কাজ করলেও নিজে টাকা জমাতে পারেননি। ষাট হাজার টাকা সর্বসাকুল্যে জমিয়েছিলেন তিনি। উত্তর কলকাতায় তেতলার ঘরে থাকতেন একাই। এসিও ছিল না। গীতা চলেও গেলেন নীরবে। সবার উপর তিনি ছিলেন ইন্ডাস্ট্রির গীতা মা। গীতা মা বলে সবাই ডাকত, কিন্তু সন্তানের কর্তব্য কজন করল?
নীরব মহাবিপ্লব ঘটিয়েছেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় (Sabitri Chatterjee)
প্রথম জীবনে দেশভাগের যন্ত্রনা, রোজগারের দায়িত্ব পালন করা এবং পরবর্তীতে নিজের সংসারের স্বপ্নভঙ্গ– কোনও কিছুতেই দমে যেতে জানেন না সাবিত্রী। সে যুগে তিনি করে দেখিয়েছিলেন, বাবার বাড়ি বা স্বামীর বাড়ি ছাড়াও মেয়েদের নিজেদের বাড়ি হতে পারে। সাতমহলা বাড়ি ছিল তাঁর। ঘর আলো করে একাই বেঁচেছেন রানির হালে (Empowered Women film)।
আড়ালে, লুকিয়ে, কাউকে ঠকিয়ে নিজের ভালবাসার মানুষকে পেতে চাননি তিনি। চাননি কোনও অনুগ্রহ। অথচ প্রথম জীবনে তাঁর কাছে বারবারই এসেছিল ভালবাসা। কিন্তু সে ভালবাসাকে বড় করে দেখার সুযোগ পাননি সাবিত্রী। কারণ অনেক বোনের দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। সংসারের একমাত্র রোজগেরে মেয়ে ছিলেন তিনিই। সাবিত্রীর জীবন যেন সেই ‘বালুচরী’ ছবির বড়দির মতোই সত্যি (Empowered Women film)।
কিন্তু ভালবাসার মানুষ নাই বা হল, ভালবাসার বন্ধুরা তো চারপাশ আলো করে আছেন! তাতেই তাঁর ঘর সাজানো, আলো জ্বালানো সার্থক। কেবল সেই আলোর নীচে কেউ তাঁকে দেখবে বলে অন্তহীন অপেক্ষা করেছেন তিনি।
শারদপ্রাতে মাধবীরাতের বউঠাকুরানি ‘চারুলতা’ (Empowered Women Film)
তাঁর বাবা চলে গিয়েছিলেন মাকে ছেড়ে। তাঁদের দুই বোনকে একা বড় করছেন স্বাধীনচেতা মা। তখন চলছে ছেচল্লিশের দাঙ্গা। রক্তাক্ত শহর। সে ভয়ংকর দিনগুলো কাছ থেকে দেখেছিল বালিকা মাধুরী। পরে মাধবী মুখোপাধ্যায় হয়ে উঠেও সেই দিন গুলো ভুলতে পারেন না তিনি। তাঁর মা সংসার চালানোর জন্য বেছে নিয়েছিলেন অভিনয় জীবন।
অভাবের সংসারে মাধুরীকেও নামতে হল শিশুচরিত্রে। দুর্গা পুজোয় যখন সব বাচ্চা ঠাকুর দেখতে বেরোত, নাটকের শো থাকায় রাত জাগতে হতো মাধুরীকে। তাঁর নাম মাধুরী থেকে মাধবীতে বদলে দিলেন মৃণাল সেন, তাঁর ‘বাইশে শ্রাবণ’ ছবিতে।
পরে সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক-তপন-বিজয়-ঋতুপর্ণ-সহ সব বড় পরিচালকের ছবির নায়িকা হন তিনি। তিনি নিজে কানন দেবীকে গুরুমা মানতেন। তাই কানন দেবীর মতোই মাধবীও বহু মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁকে নিয়ে গসিপ কম হয়নি, কিন্তু তিনি নিজ ব্যক্তিত্ব অটুট রেখেছেন। মাধবী যা রোজগার করতেন তাঁর এক ভাগ সরিয়ে রাখতেন প্রতি মাসে বই কেনার জন্য। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ না হওয়ায় নিজেই বই পড়ে নিজেকের সুশিক্ষিত করেছিলেন।
মাধবী চিরকাল আত্মমর্যাদা নিয়ে চলেছেন আজও নিজের মতো করে বেঁচে আছেন নিজের রোজগারে, নিজের ফ্ল্যাটে। একাই। তাঁর দুই মেয়েই কৃতী। হয়তো বা চারুর মতো করেই কিংবা মহানগরের আরতি কিংবা ‘স্ত্রীর পত্র’ র মৃণালের মতো মাধবীও পুরুষের চরণতলাশ্রয়ছিন্ন নিজ গরিমায় উজ্জ্বল এক ভগবতী (Empowered Women film)।
উত্তম-পরবর্তী যুগে ইন্ডাস্ট্রির হাল ধরেছিলেন মহুয়া (Mahua RoyChowdhury)
মহানায়কের প্রয়াণের পরে অন্ধকার টলিউডে সুচিত্রা সেন পরবর্তী জমানায় মহুয়াই ছিলেন একমাত্র হিট মেশিন শিল্পী, যার নামে দর্শকরা হলমুখী হতো। সোনালী রায় নামে শিশু বয়স থেকেই জলসায় নাচ করতেন তিনি। সুচিত্রা সেনের মেকআপ ম্যান হাসান জামান সোনালীর বাবাকে জানান তরুণ মজুমদার নতুন ছবিতে নায়িকা খুঁজছেন বলে। ১৯৭২ সালে মুক্তি পেয়েছিল শ্রীমান পৃথ্বীরাজ। সোনালী তখন মহুয়া নামের ১৪ বছরের মেয়ে। এর পরে আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
একটা সময়ে তো মহুয়ার নামে ছবি সুপারহিট হত। আশি সালে ‘দাদার কীর্তি’র সাফল্য পরে মহুয়ার খ্যাতি আকাশচুম্বী হয়ে গেল। তাপস পাল-মহুয়া রায়চৌধুরী জুটি নবীন বসন্তের স্পর্শ দিল টালিগঞ্জ পাড়ায়। রঞ্জিত মল্লিক, দীপঙ্কর দে‚ তাপস পাল‚ চিরঞ্জিত‚ সন্তু মুখার্জি‚ শমিত ভঞ্জ‚ প্রসেনজিৎ– কার বিপরীতে না নায়িকা হয়েছেন তিনি (Empowered Women film)!
তবে বিপুল জনপ্রিয় নায়িকার নামে প্রশংসা আর স্ক্যান্ডেল দুই-ই রটত। পাশের বাড়ির মেয়ের ভাবমূর্তির সঙ্গে জড়তাহীন বলিষ্ঠ অভিনয়। জনপ্রিয় নায়িকা হওয়ার পথে এটাই ছিল মহুয়ার তুরুপের তাস। তপন সিনহার ‘অদমি অউর আওরাত’ হিন্দি ছবিতে প্রায় নির্বাক অভিনয় করে মহুয়া রাষ্ট্রীয় সম্মান পান (Empowered Women film)।
কিন্তু এত বড় স্টার হয়ে সেটা ধরে রাখা ভাগ্যে ছিল না তাঁর। অগ্নিদগ্ধা হয়ে মারা গেলেন মহুয়া। মহুয়াই একমাত্র অভিনেত্রী যিনি মারা যাওয়ার পরে তাঁর সই করা চুক্তিতে কয়েকশো ছবি পড়ে রইল। তিনি আজও রহস্যাবৃতা। যেন ভগবান চেয়েছিলেন, নায়িকার যৌবনটুকুই দেখুক সবাই।
কালো গায়ের রং নিয়েও ফিল্ম লাইনে উজ্জ্বল হলেন শ্রীলা (Empowered Women Film)
কালো মেয়ে গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডে? ভাবা যেত না। কিন্তু অভিনয় ক্ষমতা আর কণ্ঠস্বরের গুণে শ্রীলা মজুমদার এগিয়ে এলেন। সেটা ছিল সাতের দশকের শেষ দিক। শ্রীলা তখন ‘আত্মজা’ নামের একটা আলোড়ন ফেলে দেওয়া নাটকে অভিনয় করছেন। রেডিও থেকে শ্রীলার কন্ঠ শুনে ঐ নাটকেরই স্টেজ শো হবে জেনে মৃণাল সেন পৌঁছে যান নাটক দেখতে।
মৃণাল সেন সেই সময়ে এক ছিপছিপে, কালো, সুন্দর চোখের তরুণী মেয়ে খুঁজছিলেন তাঁর ছবির জন্যে। ‘একদিন প্রতিদিন’ ছবিতে এভাবেই মমতা শংকরের ছোটো বোনের চরিত্রে সিলেক্ট হয়ে গেলেন কৃষ্ণকলি শ্রীলা। ‘একদিন প্রতিদিন’ যেন ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র এক্সটেনশন (Empowered Women film)।
এর পরে পরপর ভালো ছবি ‘আকালের সন্ধানে’ স্মিতা পাতিলের সঙ্গে। খারিজ, চোখ, মান্ডি, গণ্ডি, পরশুরাম, আরোহণ, নাগমতী, খন্ডহর — অসাধারণ সব আর্ট ছবি করেন শ্রীলা। পাশাপাশি অঞ্জন চৌধুরীর ছবিতে অত্যাচারিতা গৃহবধূ থেকে এখনও শঙ্কর মুদি কিংবা পার্সেলে দেখা গেছে তাঁকে। ঋতুপর্ণ ঘোষও ‘চোখের বালি’ তে বিনোদিনীর কন্ঠ শ্রীলা মজুমদার ছাড়া ডাবিং ভাবতে পারেননি। গ্ল্যামারকুইন বিশ্বসুন্দরী ঐশ্বর্যা রাই পূর্ণতা পেতেন না কৃষ্ণকলি শ্রীলার কন্ঠ ছাড়া (Empowered Women film)।
মুসলিম গোঁড়ামি, হিজাব উড়িয়ে বসন্তের হাওয়া আনলেন জয়া আহসান (Jaya Ahsan)
বাংলাদেশ থেকে যত নায়িকা কলকাতায় ছবি করেছেন, জয়া আহসান সবচেয়ে বেশি ভাল ছবি করায় ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছেন। ববিতা, চম্পা থেকে অঞ্জু ঘোষ অনেকেই এসেছেন, কিন্তু তাঁদের বাংলাদেশী বলেই মনে করত দর্শক। একমাত্র জয়া ব্যতিক্রম। যাকে এখানে কেউ আলাদা করে বাংলাদেশি ভাবে না। অভিনেত্রী ভাবে।
জয়ার বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ফ্রন্ট লাইনে দাঁড়িয়ে বন্দুক ধরে যুদ্ধ করেছিলেন। তিনি ভারত ও বাংলাদেশকে এক দেশ ভাবতেন, সবাইকে বাঙালি ভাবতেন। সেই আদর্শ সঞ্চারিত হয়েছে জয়ার ভিতর। কলকাতাকে তাই নিজের শহর ভেবেই ভালবাসেন জয়া (Empowered Women film)।
ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে আজও মুক্তি পায়নি বাংলাদেশ। আজও হিজাব বা বোরখা দিয়ে মেয়েদের সম্মান বিচার হয় সেখানে। কিন্তু জয়া একার জোরে ঐ সমাজে এক সচেতনতার বার্তা দিয়ে চলেছেন। হাজার কটাক্ষও জুটছে। কিন্তু এসব গায়ে না মেখে জয়া এক উন্নত যুগের সন্ধানে ব্রতী। নিজের প্রোডাকশন হাউসে করেছেন ‘দেবী’র মতো ছবি। বারবার পেয়েছেন বাংলাদেশের জাতীয় পুরস্কার। জয়াই একমাত্র অভিনেত্রী, যিনি বাংলাদেশ থেকে কান চলচ্চিত্র উৎসবে যান।
একসময় ‘রাজকাহিনি’ তে জয়ার দৃশ্য নিয়ে ঝড় বয়ে গেছিল এপার বামলায়। বিতর্কে অবশ্য কান দেননি তিনি। এখন কলকাতা ও বাংলাদেশের অন্যতম প্রথমা নায়িকা তিনি। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় থেকে যীশু সেনগুপ্ত, আবির চট্টোপাধ্যায়– সবার প্রথম পছন্দ জয়াই। তবে জয়ার বড় আফশোস, ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে কাজ করতে না পারা।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে গৃহহিংসার শিকার ঋতাভরী (Women Empowered Film)
ঋতাভরী তখন চার বছরের, তখন তাঁর পিতা নামী পরিচালক হয়েও বৌ পেটাতেন। তাঁর স্ত্রী পরিচালিকা শতরূপা সান্যালের উপর অত্যাচার করে যেতেন মদ্যপ অবস্থায়। শতরূপা একসময় ‘অণু’র মতো ধর্ষিতা মেয়ের গল্পের ছবি বানিয়েছেন। কিন্তু নিজের জীবনেই গৃহহিংসার ভুক্তভোগী ছিলেন তিনি। তাই স্বামীর ঘর ছেড়ে দুই কন্যাকে নিয়ে শতরূপা নিজের লড়াই লড়েছেন। জিতেওছেন। এটা সহজ ছিল না মোটেই (Empowered Women film)।
স্বাভাবিক ভাবেই সন্তান ঋতাভরীর শৈশবটা ছিল ভয়ানক কালরাত্রি। মদের নেশায় নিজের সন্তানদেরও হেনস্থা করেছে বাবা। তাই সেই শৈশবে মা-বাবা দুইয়ের ভূমিকা পালন করেছেন মা শতরূপা। আজ সেই মেয়েরা, চিত্রাঙ্গদা আর ঋতাভরী বাবার স্নেহ ছাড়াই নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। ঋতাভরীকে আমরা প্রথম চিনি রবি ওঝার ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ সিরিয়াল দিয়ে। ললিতার চরিত্র সকলের মন জয় করে নেয় (Empowered Women film)।
কিন্তু ঐ হাসিখুশি মেয়েটার হাসিতে অনেক দুঃখ যন্ত্রণা লুকিয়েছিল সেদিনই। আজ সে ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’র মতো ছবি করছে। যে ছবিতেও এমন বার্তা, যা আগে কেউ দেয়নি। মহিলা পুরোহিতদের অধিকার নিয়ে গলা তুলেছেন তিনি।