
দ্য ওয়াল ম্যাগাজিন ব্যুরো: “এক চিড়িয়া অনেক চিড়িয়া/ বাদলো কো ছুঁতি সিয়ানে চিড়িয়া”— আজকের জেন ওয়াই বা জেন জেড-এর ছেলেমেয়েরা এই লিরিকের সঙ্গে ঠিক কতটা পরিচিত জানি না, কিন্তু সত্তর বা আশির দশকে সাদাকালো টিভির জমানায় বেড়ে ওঠা প্রজন্মের কাছে এই গান আজও তীব্র নস্টালজিয়া। ‘এক, অনেক অউর একতা’ নামে ১৯৭৪ সালে তৈরি একটা অ্যানিমেশন ফিল্মের অংশ এই গানটা নিয়ে নতুন করে হইচই শুরু হয় এক মাস কয়েক আগে, এক ওয়েবসিরিজের সৌজন্যে। ব্রোকার হর্ষদ মেহেতার জীবন আর ভারতীয় স্টক মার্কেট কেলেঙ্কারি নিয়ে গতবছর নভেম্বর মাস নাগাদ প্রকাশ পায় নতুন ওয়েবসিরিজ ‘স্ক্যাম ১৯৯২’। বিতর্কিত বিষয়, চাবুক অভিনয়— সব মিলিয়ে গোড়া থেকেই নেটদুনিয়ায় হইচই ফেলে দিয়েছে ‘স্ক্যাম ১৯৯২’। এই ওয়েবসিরিজেরই একটি দৃশ্যে প্রোটাগনিস্ট হর্ষদ মেহেতার ভূমিকায় অভিনেতা প্রতীক গান্ধী ‘ঐক্য বা একতার শক্তি’র উদাহরণ দিতে গিয়ে টেনে এনেছেন সত্তরের দশকের বিখ্যাত এই গান ‘এক চিড়িয়া অনেক চিড়িয়া’-র প্রসঙ্গ। (Ek Chidiya, Anek Chidiya)

প্রায় অর্ধশতাব্দী আগের একটা ছোট্ট অ্যানিমেশন ছবি, অথচ আজও কী প্রাসঙ্গিক তার বয়ান। সাত মিনিটের ছোট্ট এই ভিডিওটির চিত্রনাট্য ও পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বিখ্যাত ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র নির্মাতা বিজয়া মুলে এবং প্রযোজনা করেছিলেন ন্যাশানাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পাওয়া অ্যানিমেটর ভীমসেন খুরানা। পণ্ডিত বিনয় চন্দ্রের কথায়, বসন্ত দেশাইয়ের সুরে ‘এক চিড়িয়া’ গানটি গেয়েছিলেন ছয় বছরের একটা ছোট্ট মেয়ে। সেই মেয়ে, সাধনা সরগম, আজ হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম সফল এবং ব্যস্ত গায়িকা। সেসময় সেরা এডুকেশনাল ফিল্ম ক্যাটাগরিতে জাতীয় পুরস্কার এবং জাপানে সেরা শিশু চলচ্চিত্রের পুরস্কার পায় এই ছবি।

সেটা ১৯৭৫ সাল। এক অভিনব আইডিয়া নিয়ে দূরদর্শনের পাশে এসে দাঁড়ালেন ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার জনক বিক্রম সারাভাই। দূরদর্শনের সিগন্যালকে দেশের সব প্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল স্যাটেলাইট বা ইনস্যাট প্রেরণের পরামর্শ দেন তিনি। এর ঠিক পরের বছর, মানে ১৯৭৬ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো থেকে আলাদা করা হয় দূরদর্শনকে। এই সময়কাল ভারতীয় টেলিভিশনের এক চরম সন্ধিলগ্ন। ১৯৭৪-এ ‘এক অনেক অউর একতা’ নামের এই অ্যানিমেশন ভিডিওটি তৈরির পিছনেও বিশেষ ভূমিকা ছিল ডক্টর বিক্রম সারাভাইয়ের। ২০১২ সালে ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে নির্মাতা বিজয়া মুলে নিজেই জানিয়েছিলেন এ কথা। শুধু তাই নয়, জনপ্রিয় এই গানটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার নামও। (Ek Chidiya, Anek Chidiya)

স্যাটেলাইট ইন্সট্রাকশনাল টেলিভিশন এক্সপেরিমেন্ট (SITE) এর মাধ্যমে গ্রামীণ ভারতে শিক্ষামূলক কর্মসূচি নিয়ে আসার কাজে সেসময় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সারাভাই। এই কাজে নাসার অ্যাপ্লিকেশন টেকনোলজি স্যাটেলাইট (ATS) ব্যবহার করার অনুমতি চেয়ে চিঠি লেখেন তিনি। সাড়ামেলে নাসার তরফেও। বিখ্যাত ছবিনির্মাতা এবং সুলেখিকা হিসাবে SITE-এর সেই সমন্বয়কারী কমিটির অংশ ছিলেন বিজয়া মুলে নিজেও। সেই প্রজেক্টে দেশের কৃষি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় উন্নয়নমূলক একাধিক কর্মসূচির পাশাপাশি জনচেতনা বিকাশে ডকুমেন্টারি বা শর্টফিল্ম তৈরিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। সরকারি চ্যানেল হিসাবে এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দূরদর্শন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সময় কম দৈর্ঘ্যের কিছু ছবি তৈরির সুযোগ পান বিজয়া মূলে। সাক্ষরতা নিয়ে তিনি ইউনিসেফের সঙ্গে যৌথভাবে দুটো ছবিও করেন সেসময়। এর কিছুদিন পরেই সেন্টার ফর এডুকেশনাল টেকনোলজি’র প্রধানের দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। সুযোগ আসে শিশুদের মানসিক বিকাশ, তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার। এই সূত্রেই তাঁর মাথায় আসে ‘এক অনেক অউর একতা’ ছবির ভাবনা।

সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে এ দেশের এনিমেশন প্রযুক্তি খুব উন্নত ছিল বলা যায় না। তারপরেও শিশুদের মন ছুঁয়ে গেছিল একদল পাখি, একটা দুষ্টু ব্যাধ আর পাখিদের বন্ধু ইঁদুরের গল্প নিয়ে লেখা গান ‘এক চিড়িয়া অনেক চিড়িয়া’। একতাই যে আমাদের শক্তি, একসঙ্গে চেষ্টা করলে কঠিন কাজও কত অবলীলায় সহজ হয়ে যায়- গল্প আর গানের ভাষায় শিশুদের মনে সেই সত্যি কথাটাই যেন গেঁথে দিতে চেয়েছিল নির্মাতারা। ভীমসেন খুরানার অননুকরণীয় অ্যানিমেশন টেকনিকও সেই কৃতিত্বের অনেকখানি দাবিদার।
নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের এই দেশের যেদিকেই তাকাই, অতীত থেকে বর্তমান, ইতিহাস থেকে জনজীবন – সর্বত্রই মিশে আছে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ধারণা। সেই বার্তাটিকেই শিশুদের সামনে সহজভাবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন বিজয়া মুলে। তিনি এমন একটা স্ক্রিপ্ট লিখতে চেয়েছিলেন, যেটা বাচ্চারা বুঝতেও পারবে আবার উপভোগও করতে পারবে। (Ek Chidiya, Anek Chidiya)

এক চিড়িয়া অনেক চিড়িয়া গানটার জনপ্রিয়তা নিয়ে নতুন করে বলার কিছুই নেই। ইউটিউবের কোটি কোটি ভিউ আর শেয়ার দেখলেই বোঝা যায় এই তীব্রগতি ইন্টারনেটের যুগেও ভাঁটা পড়েনি সেই জনপ্রিয়তায়। আমাদের অনেকেরই ছোটবেলার স্মৃতির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে এই গান। চারপাশের পৃথিবীটা এত জটিল ছিল না তখন। আরেকটু বেশি আলো, হাওয়া বৃষ্টি ছিল। আমাদের হারিয়ে যাওয়া সেই ছেলেবেলার গল্প বলে এই গান। সেইসব সারল্যেভরা সহজ রঙিন দিনগুলোর স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। সহজ কথা, সহজ সুর, আর সারল্যেভরা আবেদন- এটাই যেন এই গানের লুকোনো ইউএসপি। (Ek Chidiya, Anek Chidiya)
ছবি, গল্প, আর গান বরাবরই জনসংযোগের বড় হাতিয়ার। বার্তামূলক জনসংযোগের ধারণা তখন জনপ্রিয় হচ্ছিল জাতীয় গণমাধ্যমগুলোতেও। দুরদর্শনকে সেসময় বিনোদনের জগতের একচ্ছত্র অধিপতিই বলা যায়। দেশের নানা প্রান্তের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করার ক্ষেত্রেও খুব শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল টিভি। অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সেসময়কার বিজ্ঞাপনগুলিও তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করত মানুষ।
ব্যাধ আর পাখিদের এই গল্প নতুন নয়। অনেক পাঠক্রমে, ইস্কুলের বইতেও জায়গা পেত এই গল্প। চেনা গল্পকে টিভির পর্দায় জীবন্ত দেখার আনন্দ তো ছিলই তার পাশাপাশি গান-গল্পের মোড়কে একজোট হওয়ার বার্তাটিও বাচ্চাদের সরল মনে ছাপ ফেলে গিয়েছিল। মানে, যে উদ্দেশ্যে এই ভিডিওটা তৈরি করা, তা সার্থক হয়েছিল। সত্যি কথা বলতে, সৃজনশীলতা কীভাবে শিক্ষার একটি অংশ হতে পারে আজও তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে আছে এই ছবি।