শেষ আপডেট: 8th December 2022 09:37
পাঞ্জাবের এক প্রত্যন্ত গ্রামের হেডমাস্টারের ছেলে স্বপ্ন দেখেছিল দিলীপ কুমার, রাজ কাপুর, দেব আনন্দের মতো বলিউডের বায়োস্কোপের হিরো হয়ে পর্দা কাঁপাবে এবং নিজের কেরামতিতে বোম্বাই নগরে ফ্ল্যাট আর ফিয়াট গাড়ির মালিক হবে। সত্যি সে তাই হতে পেরেছিল এবং হিন্দি চলচ্চিত্রের লেজেন্ডও হয়েছিল। ধর্মেন্দ্র দেওল (Dharmendra Deol)।
'ফুল অউর পাত্থর', 'শোলে', 'মেরা গাঁওন মেরা দেশ', 'প্রতিজ্ঞা', 'চুপকে চুপকে, 'সীতা অউর গীতা, 'অনুপমা', 'ইয়াদো কি বরাত', 'ধরম-বীর'-এর মতো অজস্র সুপারহিট ছবির হিরো যিনি। প্রযোজনা করেছেন 'সত্যকাম', 'বেতাব', 'ঘায়েল'-এর মতো ছবি।
বলিউডের অনেক নক্ষত্রের মাঝে ধর্মেন্দ্র এমন একজন সুপারস্টার, যিনি কখনও তাঁর শুরুর দিনগুলো তাঁর মাতৃভূমিকে ভুলে যাননি। তিনি এখন একাই প্রাসাদসম বাঙলো-সহ ফার্ম হাউসে শেষ জীবন কাটাচ্ছেন। গবাদি পশু আর পাখিদের সঙ্গেই কাটান সময়। কখনও নিজেই মালিদের সঙ্গে সেচের কাজে, বাগানের কাজে নেমে পড়েন এই পঁচাশি পেরোনো বয়সেও। আবার কখনও আপনমনে কবিতা লেখেন বাগানের রোদে পিঠ এলিয়ে। সানি দেওলের পুত্র এখন ছবিতে নামছেন, তাই ঠার্কুদা ধর্মেন্দ্র নাতিকে টিপসও দেন।
অভিনেতা ও রাজনীতিবিদ শত্রুঘ্ন সিনহা, ধর্মেন্দ্রর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। তিনি ধর্মেন্দ্র সম্পর্কে বলেছেন "ধর্মেন্দ্র আমার সবথেকে কাছের বন্ধু এই ইন্ডাস্ট্রির। যে একজন সাচ্চা পাঞ্জাবি। যে সোজাসাপ্টা কথা বলতেই ভালবাসে। সংস্কারবাদী অথচ মজা করে জীবন কাটানোতেই যে অভ্যস্ত। তাই আজও 'ডার্লিং অফ পাঞ্জাব' হলেন ধর্মেন্দ্র।"
ধর্মেন্দ্র তাঁর শিকড়ের কাছে কীভাবে ফিরে গেছিলেন স্টারডম ঝেড়ে ফেলে, সে কাহিনি অনেকেরই অজানা।
পাঞ্জাবের লালটন, কালান। রাত ন'টার পর যেখানে সব নিস্তব্ধ হয়ে যায়, সবাই ঘরে ঢুকে যায়। ২০০২ সালে এখানেই রাত সাড়ে নটায় এক কৃষক পরিবারের কুটিরের সামনে হাজির হন স্বয়ং ধর্মেন্দ্র। মুম্বাই থেকে পাঞ্জাব উড়ে যান তিনি শিকড়ের টানে। দিনের বেলায় তাঁর পক্ষে যাওয়া অসম্ভব! লোক চিনে ফেলবে তাই বেছে নেন রাত্রি।
রাত সাড়ে নটায় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। একজন মহিলা এসে দরজা খোলেন। তিনি অন্ধকারে চিনতে পারেননি, ভাবতেও পারেননি ধর্মেন্দ্র দাঁড়িয়ে। ধর্মেন্দ্র মহিলাকে জিজ্ঞেস করেন "এটা কি রাম সিংয়ের বাড়ি?' যিনি আজকাল একজন পিটিশন লেখক?"
মহিলা লন্ঠনের আলো ধর্মেন্দ্রর মুখে ধরে চিনতে পেরে চমকে ওঠেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান তিনি। এমন সময় ধর্মেন্দ্র বলেন "আমাকে সুপারস্টার ভেবে চমকে যাবেন না, আমি ও আমাদের পরিবার বাল্যবয়সে আপনাদের বাড়িতেই ভাড়া থাকতাম।" মহিলা ধর্মেন্দ্রর হাত দুটো ধরে চেপে ধরেন ও সজল নয়নে বলেন 'ভিতরে আসুন।'
রাম সিংয়ের বৌমা ধর্মেন্দ্রকে নিয়ে আসেন রাম সিংয়ের ঘরে। রাম সিং ভুলেও গেছিলেন সেই আগের ধর্মেন্দ্রকে, কিন্তু যখন তাঁর পর্ণ কুটিরের ভিতর দিয়ে সুপারস্টার হেঁটে আসেন, এক আলোক বলয় তৈরি হয় যেন। অথচ ধর্মেন্দ্র তখন ঠিক যেন বালক বয়সে পৌঁছে গেছেন। ধর্মেন্দ্র বুকে জড়িয়ে ধরেন রাম সিংকে। রাম সিংয়ের বাবা ছিলেন তাঁদের বাড়িওয়ালা আর রাম সিং তাঁর ছেলেবেলার বন্ধু। দুই বন্ধুর এতদিন পরে দেখা। যেন কৃষ্ণ আর সুদামার মিলন হল দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর।
রাম সিং ও তাঁর পুত্র রণধীর সিং অবাক নয়নে শুধু দেখতে থাকেন, চার দশক পরে আসা বলিউড সুপারস্টারকে। এও সত্যি! এভাবেও ফিরে আসা যায়!
রাম সিং বলেন, "কারও পক্ষে ভাবা সম্ভব! একজন সুপারস্টার আমাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্তদের বাড়িতে এসছে!" যে গ্রামের লোকেরা রাত্রি দশটায় ঘুমের অতলে থাকে, তাঁরাই আজ সবাই জেগে গেছেন ধর্মেন্দ্র আসার খবরে। কোনও সংবাদ দিয়ে আসা নয়, কোনও প্রচার নয়, তবুও গ্রামে সাজো সাজো রব শুরু হয়ে যায়। সবাই একবারের জন্য 'শোলে'র বীরুকে দেখতে চায়।
ধর্মেন্দ্র রাম সিংয়ের বাড়ির সামনে রাখা গরুর গাড়িতে চেপে বসেন। দলেদলে লোক আসতে থাকে অত রাতে ধর্মেন্দ্রকে দেখে চক্ষু সার্থক করতে। তাঁরা কেউ গরুর দুধ কেউ আবার জিলিপি বানিয়ে নিয়ে আসেন ধর্মেন্দ্রর জন্য। কেউ আবার মাক্কি কি রোটি আর সরষো-শাক নিয়ে চলে আসেন ধর্মেন্দ্রর জন্য। সবাই রীতিমতো ঠেলাঠেলি করতে থাকেন ফিল্মস্টারের সঙ্গে একটা ছবি তোলার জন্য। তখনও মোবাইল ফোন গ্রামের লোকদের হাতে অপরিহার্য বস্তু হয়ে ওঠেনি। তাই ফটোগ্রাফার বালিন্দর ধিলনের চাহিদা সেই রাত্রে খুব বেড়ে যায়। নিমেষে তাঁর ক্যামেরার ফিল্ম রোল শেষ হয়ে যেতে থাকে। যাঁরা ছবি তুলতে পারলেন না, তাঁরা ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে হাত মিলিয়েই ছুঁয়ে দেখতে চান সুপারস্টারকে। কেউ আবার নিতে ছোটেন অটোগ্রাফ।
এমনই সময় ধর্মেন্দ্র কেঁদে ফেলেন যখন বাল্যবন্ধু রাম সিং তাঁর কাছে থাকা ধর্মেন্দ্রর বাবার ছবি ধর্মেন্দ্রকে উপহার দেন। ধর্মেন্দ্র তাঁর স্কুলের সহপাঠী সুরজিৎ সিংয়ের স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গে দেখা করতে চান, যখন জানতে পারেন বন্ধু সুরজিৎ ক'বছর আগে মারা গেছেন। কিছু আর্থিক সাহায্যও করতে চান বন্ধুকন্যাকে।
গ্রামের যুবকদের সঙ্গে অত রাতেও মজার মজার কথা বলে সবাইকে আনন্দ দিতে থাকেন সাতষট্টি বছরের ধর্মেন্দ্র। তাঁর বাল্যকালের নানা মণিমুক্ত গল্প বলতে থাকেন ধর্মেন্দ্র। শেষ অবধি সব বন্ধুর সঙ্গে ও তাঁদের পরিবারদের সঙ্গে যতটা সৌজন্য-সাক্ষাৎ করা সম্ভব, তাই করেন ধর্মেন্দ্র। আর্থিক সাহায্যও করেন গ্রামবাসীদের।
এভাবেই সেই রাত কাটিয়ে মুম্বই ফিরে আসেন ধর্মেন্দ্র।
বহু অভিনেতাই মহাতারকা হবার পর তাঁর ছেলেবেলার জায়গায় আর ফিরে যান না। গেলেও হয়তো রাজনৈতিক প্রচারে যান নিজের স্বার্থে। কিন্তু সেদিন ধর্মেন্দ্র নিজের শিকড় খুঁজে পেতেই গেছিলেন পাঞ্জাবের ওই গ্রামে।