
শংকরের (Shankar) বিখ্যাত উপন্যাস ‘চৌরঙ্গী’ (Chowringhee) পার করল ৬০ বছর। সেই উপলক্ষে দ্য ওয়ালের মুখোমুখি লেখক। এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার (Exclusive Interview) নিলেন সোমা লাহিড়ী।
এত দিন পর আপনি চৌরঙ্গী-বিতর্ক নিয়ে মুখ খুললেন। কেন?
এখন যে বয়সে, পৌঁছেছি, এখনও যদি না বলি আর কবে বলব? ওই সময়ে আমাকে অপরিসীম অপমান সহ্য করতে হয়েছে। অনেকে ব্যঙ্গ করে আমার নাম দিয়েছিলেন ‘ওয়ান বুক অথর’। আসলে আমার প্রথম উপন্যাস ‘কত অজানারে’ ধারাবাহিক ভাবে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় সেই সময়ের অনেক নামী সাহিত্যিক আমার উপর চটেছিলেন। আমার মনে হয়, তাঁরা চাননি আমি লেখালেখি করি। তাই বলেছিলেন, ব্যরিস্টারের বাবু কোনওক্রমে একটা লিখেছে। ওর দ্বারা আর হবে না।
তাতে নিশ্চয়ই আপনার জেদ আরও বেড়ে গেছিল?
সে তো বটেই। তাতে শাপে বর হয়েছিল। একথাও শুনতে হয়েছে , ‘ফুটো পয়সার মুরোদ নেই, পাঁচতারা হোটেলের গল্প লেখে কী করে?’ একজন নামজাদা লেখিকা সম্পাদককে বলেছিলেন, ‘যে ব্রেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট আর বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্টের তফাত বোঝে না, সে লিখবে ফাইভ স্টার হোটেল নিয়ে গল্প?’ কিচ্ছু ভুলিনি আমি।

চৌরঙ্গী প্রকাশিত হওয়ার পর কে সবথেকে বেশি প্রশংসা করেছিলেন?
(হাসতে হাসতে) যাঁর কাছে সবথেকে বেশি অপমানিত হয়েছি, তাঁর কাছ থেকেই।
তারপর তো আর থেমে থাকতে হয়নি। গড়গড়িয়ে চলেছে চৌরঙ্গী মেল। ৬০ বছরে ১২৫তম সংস্করণ!
মেলই বটে। ১৯৬১ সাল থেকে সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল চৌরঙ্গী। ১৯৬২ সালের জুন মাসে গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশ। মনে আছে, প্রকাশক শচীনবাবু একটা খবরের কাগজে মুড়ে নবমুদ্রিত চৌরঙ্গী আমার হাতে দিয়েছিলেন। সেটা ছিল এই জুন মাসই, আমার বিয়ের আগের দিন। নিশ্চিন্ত মনে বিয়ে করতে গেছিলাম।

কোন কোন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে বইটা?
দেশি-বিদেশি কত ভাষায় যে অনুবাদ হয়েছে আমি নিজেই জানি না। ইংরেজি ছাড়াও ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, রাশিয়ান, জাপানিজ, চাইনিজ ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। আমাদের নানান প্রদেশের ভাষাতেও অনুবাদ হয়েছে। আজও হচ্ছে।

৬০ বছর ধরে একটা বইয়ের এমন চাহিদা। এর কারণ কী?
পাঠক বলতে পারবেন। আমি আর কী বলব? তবে এটুকু বলতে পারি, আমি যখন যেটা করি নিজের সবটুকু দিয়ে করি। বাকিটা ঈশ্বরের আশীর্বাদ।

ফিল্মও তো হয়েছে চৌরঙ্গী। যখন শুনলেন ফিল্ম হবে, কী মনে হয়েছিল?
খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। ১৯৬৮ সালে ছবিটা মুক্তি পেয়েছিল। পরিচালক ছিলেন পিনাকীভূষণ মুখোপাধ্যায়। উত্তমকুমার স্যাটা বোসের চরিত্র করছেন শুনে ভাল লেগেছিল। তবে শ্যুটিং দেখতে খুব বেশি দিন যাইনি। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে বারণ করেছিলেন। বলেছিলেন, নিজের বইয়ের শ্যুটিং দেখতে যাবে না। আউটডোরে তো একদম না। কেন বলেছিলেন জানি না। তবে মেনে চলেছি।

উত্তমকুমারের স্যাটা বোস তো মিথ। আপনার সঙ্গে কথা হয়েছিল উত্তমকুমারের?
উজ্জ্বলাতে প্রিমিয়ার শোয়ে গেছিলাম। উত্তমবাবুর পাশে বসেই দেখেছি ছবিটা। সিনেমা শেষ হতেই উত্তমবাবু বেশ উদ্গ্রীব হয়ে জানতে চাইলেন, ‘কী মনে হল আপনার?’ বললাম, আমার বইয়ের পাতার থেকেও জীবন্ত আপনার স্যাটা বোস। মজা করে বলেছিলেন, ‘লিখে দিতে বলব কিন্তু। আপনি ফ্যাসাদে পড়বেন।’

আগে আপনি উত্তমকুমারকে চিনতেন?
আলাপ ছিল। তবে চৌরঙ্গীর পর থেকে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল। বলা যায়, বন্ধুত্ব হয়েছিল। উত্তমবাবুর ময়রা স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে বহুবার গেছি। সুপ্রিয়া দেবীর হাতের রান্না খেয়েছি। ওঁরাও আমাদের ফ্ল্যাটে এসেছেন। একসঙ্গে বহুবার বেড়াতে গেছি। উত্তমবাবুর মতো আমুদে, দিলদরিয়া মানুষ খুব কম দেখেছি।

চৌরঙ্গীর শাজাহান রিজেন্সি কোন হোটেল? গ্র্যান্ড না গ্রেট ইস্টার্ন? ফিল্মের শ্যুটিং তো গ্র্যান্ডে হয়েছিল।
(হাসতে হাসতে) কোনওটাই নয়। সাবেকি ওয়েলেসলি প্লেসটা খুব সুন্দর ছিল। রাজভবনের সিংহদুয়ার থেকে হাঁটা দূরত্বে একটা ঝকঝকে হোটেল ছিল। নাম স্পেনসেস। আমার বস স্বনামধন্য ব্যারিস্টার নোয়েল ফ্রেডরিক বারওয়েল সাহেব এখানেই থাকতেন। সেই সুবাদে আমাকেও এই হোটেলে নিয়মিত যাতায়াত করতে হতো। অনেক সময় দেরি হয়ে গেলে হাওড়ায় ফিরতে পারিনি। থেকে যেতে হয়েছে। তখন তো বয়সটা কম ছিল, তাই হোটেলের অনেকের সঙ্গে ভাব হয়ে গেছিল।

আপনার উপন্যাসের চরিত্ররা কি স্পেনসেস হোটেল থেকে উঠে এসেছেন? স্যাটা বোস কে?
ইস্টার্ন রেলওয়েতে কাজ করতাম। ওখানে একজন অফিসার ছিলেন সত্যসুন্দর বোস। খুব স্মার্ট ছিলেন। নিজেকে স্যাটা বোস বলতেন। তাঁর ছায়া কিছুটা আছে। আবার স্পেনসেস হোটেলেও একজন ছিলেন, খুব স্মার্ট আর অভিভাবক সুলভ অভিব্যক্তি ছিল তাঁর। চরিত্রে তাঁরও প্রভাব আছে।

রটনা আছে, মিসেস পাকড়াশি নাকি লেডি রাণুর আদলে তৈরি?
এগুলো স্ক্যান্ডাল মেন্টালিটি থেকে বলা। অযথা সেনসেশন তৈরির চেষ্টা। চৌরঙ্গী ফিল্ম হওয়ার পরে বহুবার লেডি রাণুর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। কথাও হয়েছে। উনি কিন্তু আমাকে কিচ্ছু বলেননি। স্ক্যান্ডাল ভ্যালুর ওপর সাহিত্য টিকে থাকে না।
আপনার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। কেমন লেগেছিল?
শুভেন্দুবাবু নেই, তাই কোনও মন্তব্য করব না।

সম্প্রতি সৃজিত মুখোপাধ্যায়ও চৌরঙ্গী নিয়ে সিনেমা করেছেন, শাজাহান রিজেন্সি। কেমন লেগেছে?
খারাপ নয়। আধুনিক পরিবেশন। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি, তখন উপন্যাসে স্পেনসেস হোটেলের নাম দিতে ভয় পেয়েছিলাম। যদি কেস টেস করে। (হাসতে হাসতে) তাই একেবারে দেশি নাম দিয়েছিলাম, শাজাহান রিজেন্সি।
আপনার এত উপন্যাস নিয়ে জনপ্রিয় সিনেমা হয়েছে। সত্যজিৎ রায়ও ফিল্ম করেছেন, অথচ বেশ কিছু বছর ধরে আপনি আর গল্প উপন্যাস লেখেন না। কেন ?
লেখা তো মনের ব্যাপার। মন থেকে তাগিদ পাই না।

এখন ধর্মীয় নিবন্ধ, তত্ত্ব ও তথ্য নির্ভর লেখাই বেশি লেখেন, তাই না?
কিছুটা ঠিক। তবে আমি কিন্তু খুব ধার্মিক মানুষ নই। তাই ধর্মীয় নিবন্ধ নয়, আমি স্পিরিচ্যুয়াল মেটেরিয়াল নিয়ে লিখি। সেখানে বিষয় হিসেবে শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদা, স্বামী বিবেকানন্দ বা অন্য যে কেউ আসতে পারেন। তবে তত্ত্ব বা তথ্য যাই পরিবেশন করি না কেন, তাতে গল্পের মোড়ক থাকে। আলটিমেটলি পাঠক গল্প পড়তে ভালবাসেন। আসলে এমন কিছু কাজ খেটেখুটে করতে ইচ্ছে করে, যা খানিকটা ইতিহাসের মতো অথচ পড়তে ভাল লাগে। যেমন এই কোভিডের মধ্যেই একটা কাজ করলাম, শ্রীরামকৃষ্ণের খাওয়াদাওয়া।

লকডাউনে মানুষ যখন অবসাদে অস্থির তখনও তো আপনি মহামারী নিয়ে ৩০০ পাতার বই লিখে ফেললেন। এত এনার্জি পান কী করে?
হ্যাঁ, বইটার নাম, ‘দুঃসময়ের দিনলিপি’। লকডাউনের সময় থেকে তো আর অফিস যাই না। বাড়ি বসেই অফিসের কাজ করি। বেরোনোর তাড়া নেই। হাতে সময় পেলাম, তাই মহামারী নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। প্রকাশকের পছন্দ হল। বই হল। এই আর কী।
বললেন না তো, এই অষ্টআশি বছর বয়সেও এত এনার্জি পান কী করে?
না না, কী যে বলো! পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা আমার থেকে অনেক বেশি কাজ করেছেন, করছেন। আসলে আমি কাজ ছাড়া থাকতে পারি না। কাজই আমার এনার্জি বাড়ায়।

শারদীয়া পত্রিকাগুলোর জন্য লেখা শুরু করেছেন?
তা তো করতেই হয়েছে। গত দু’বছর শারদীয়া পত্রিকাগুলোয় খুব গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা লেখা লিখেছি। সেগুলো বই হিসেবেও প্রকাশিত হয়েছে। বই প্রকাশ মানে কিন্তু আরও অনেক ঝক্কি। লেখা বাড়ানো, বারবার প্রুফ দেখা, ছবি কী কী যাবে ঠিক করা, আরও নানা ধরনের টেকনিক্যাল কাজকর্ম থাকে।

আপনি তো এখনও সঞ্জীব গোয়েঙ্কার মুখ্য উপদেষ্টা, মানে আরপি সঞ্জীব গোয়েঙ্কা গ্রুপের চিফ অ্যাডভাইসার। দুটো দু’রকম কাজ সামলাতে অসুবিধে হয় না?
না। আমি তো প্রথম থেকে তাই করে এসেছি। কত ধরনের কাজ যে করেছি। আমার তেরো বছর বয়েসে বাবা চলে গেলেন। বাবা চলে যাওয়ার পরে মা বললেন, কিছু রোজগার তো করতেই হবে এখন। তারপর পড়াশোনা, লেখালেখি করতে পারলে নিশ্চয়ই করবে।

তারপর?
রুটি রুজির সন্ধানে রোজ হাওড়া থেকে কলকাতায় চলে আসতাম সকালবেলা। কাজের চেষ্টায় ঘুরে বেড়াতাম। হকার, টাইপ রাইটার ক্লিনার, প্রাইভেট টিউটর, কোর্টের মুহুরি, স্টেনোগ্রাফার, সওদাগরি অফিসের কেরানি। এইসব করতে করতেই হাইকোর্টের আদালতের কাজে পা রেখেছিলাম। ব্যারিস্টার বারওয়েল সাহেবের আইনি চেম্বারে নতুন জীবন শুরু হয়েছিল। কাজ করতে করতেই লেখালেখি চালিয়ে গেছি। চিরটাকাল। এখনও চালিয়ে যাচ্ছি।

আপনার সব লেখাতেই শেষ পর্যন্ত আলোর সন্ধান থাকে। ট্র্যাজিক স্টোরিতেও। কেন?
শেষেই তো সমাপ্তি নয়। তাই তো চৌরঙ্গীর শেষে ‘শাজাহানের ক্লান্তিহীন লাল আলো তখনও জ্বলছে আর নিভছে। আমরা এগিয়ে চললাম।’ এগিয়ে চলার নাম জীবন।





(ছবি: দে’জ পাবলিশিং ও আরপি সঞ্জীব গোয়েঙ্কা গ্রুপের সৌজন্যে)
নার্গিসকে ভালবেসে আগুনে ঝাঁপ দেন সুনীল দত্ত, রূপকথার প্রেমকেও যেন হার মানান তাঁরা