Latest News

চিন বনাম তাইওয়ান, দীর্ঘ এই সংঘাতের কারণ কী? দ্বীপরাষ্ট্রের পাশে কেন আমেরিকা?

রাজীব সাহা

ইলহা ফরমোসা!
কী সুন্দর দ্বীপ! (China Taiwan Conflict)

আজ থেকে পাঁচ-ছ’শো বছর আগে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বড় বড় পালতোলা জাহাজ নানা পণ্যের সম্ভার নিয়ে যেত চিনে। তখনই প্রশান্ত মহাসাগরের ওপরে অদ্ভূত সুন্দর একটা দ্বীপ নজরে পড়ত তাদের। নাবিকরা মুগ্ধ বিস্ময়ে বলে উঠত, ‘ইলহা ফরমোসা’! কী সুন্দর দ্বীপ। সপ্তদশ শতকে ডাচরা ঘাঁটি বানায় সেই দ্বীপে। তখন তার নাম হয় ফরমোসা।

গত চারশো বছরে বদলে গিয়েছে দ্বীপের নাম। ফরমোসা এখন তাইওয়ান (Taiwan) নামে পরিচিত। গত মঙ্গলবার থেকে ওই ভূখণ্ড রয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রে। ক্রমশ টেনশন বাড়ছে (China Taiwan Conflict)। চিনের (China) হুমকি উপেক্ষা করে তাইওয়ানে গিয়েছেন আমেরিকার হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি (Nancy Pelosi)। তারপর থেকেই ঘনঘন তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে চক্কর কাটছে চিনা যুদ্ধবিমান। চিনারা যুদ্ধজাহাজও রেডি রেখেছে। বেজিং থেকে খোলাখুলি বলা হয়েছে, বড্ড বাড়াবাড়ি করছে আমেরিকা। আর সহ্য করা যায় না। এবার ‘সামরিক পদক্ষেপ’ নেওয়া হবে।

আমেরিকাও অনড়। চিন গন্ডগোল পাকাবে আশঙ্কা করে তারাও তাইওয়ানের কাছে মোতায়েন করেছে যুদ্ধজাহাজ আর এয়ারক্রাফট কেরিয়ার।

জলদস্যু, ভাগ্যান্বেষী ও ডাচ বণিকের বসতি

ইতিহাস বলছে, এমন টেনশন (China Taiwan Conflict) নতুন নয়। এর আগেও তাইওয়ান কয়েকবার পালাবদল হয়েছে। তার জন্য যুদ্ধবিগ্রহও কম হয়নি। মাঝে একবার স্পেনের বণিকরা ওখানে ঘাঁটি বানাতে গিয়েছিল। ডাচরা তাদের মেরে তাড়িয়ে দেয়।

সপ্তদশ শতকের শেষে চিনের মিং বংশের সম্রাটরা ওই দ্বীপের দখল নেন। চিনা সৈনিকদের সামনে ডাচরা পাততাড়ি গুটোতে বাধ্য হয়।

তাইওয়ানের আদিম জনজাতি

তাইওয়ানে কয়েক লক্ষ বছর যাবৎ একটি জনজাতি বাস করত। তারা আদিম জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ছিল। এছাড়া সেখানে ঘাঁটি বানিয়েছিল জলদস্যুরা। তারা ছিল অত্যন্ত দুর্দান্ত স্বভাবের লোক। বেশিরভাগ সময় দ্বীপে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকত। সমুদ্র দিয়ে কোনও বাণিজ্যতরী গেলে ঝাঁপিয়ে পড়ত তার ওপরে। জলদস্যুদের জাহাজে যে পতাকা উড়ত, তার রং ছিল কালো। তাতে আঁকা থাকত হাড় আর খুলি। দূর থেকে ওই পতাকা দেখলে নিরীহ নাবিকদের বুকের রক্ত শুকিয়ে যেত।

China Taiwan Conflict
সুন্দরী তাইওয়ানে একসময় ছিল জলদস্যুদের আড্ডা।

চিনা ভাগ্যান্বেষীর দল তাইওয়ানে

একসময় ওই দ্বীপে গিয়েছিল জনাকতক চিনা ভাগ্যান্বেষী। তারা ভাবত, তাইওয়ানের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক হবে। তখনও পর্যন্ত দ্বীপটার কোনও নাম ছিল না। ডাচরা সেখানে বয়ে নিয়ে যায় আধুনিক সভ্যতার আলো। তারা দ্বীপের জঙ্গল পরিষ্কার করে। তখন থেকে আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ শুরু হয়।

সপ্তদশ শতকে ফরমোসার উন্নতি দেখে চিনদেশ থেকে শ্রমিকরা গিয়ে সেখানে ভিড় করতে লাগল। তাদের দিয়ে ডাচরা ধান আর আখের চাষ করাত। পরে চিনাদের আমলেও তাইওয়ানের অর্থনৈতিক অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। ১৮৯৪-’৯৫ সালে চিন ও জাপানের মধ্যে বিরাট যুদ্ধ হয়েছিল। ১৮৯৫ সালে তাইওয়ানের মালিক হয় জাপান।

China Taiwan Conflict
চিয়াং কাইশেক

তাইওয়ান ও সুভাষচন্দ্র বসু

১৯৪৫ সালে, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত জায়গাটা জাপানের দখলে ছিল। কথিত আছে, ’৪৫ সালের ১৮ অগাস্ট তাইওয়ানের তাইহোকু থেকে উড়ে গিয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। মাঝআকাশে তাঁর বিমান ভেঙে পড়ে। সত্যি কী ঘটেছিল, সেই রহস্যের উন্মোচন এখনও হয়নি। কিন্তু নেতাজির অন্তর্ধান রহস্যের সঙ্গে অবধারিতভাবে জুড়ে গিয়েছে তাইওয়ানের নাম।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জাপান আত্মসমর্পণ করে। তাইওয়ান যাতে ফিরে পাওয়া যায় সেজন্য আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টোন চার্চিলের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন চিনের শাসক চিয়াং কাইশেক। বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিজয়ী আমেরিকা ও ব্রিটেন স্থির করে, তাইওয়ানকে ফের চিনা প্রজাতন্ত্রের হাতে তুলে দেওয়া হবে।

চিয়াং-এর পলায়ন

ইতিমধ্যে চিনের মূল ভূখণ্ডে চলছিল ভীষণ গৃহযুদ্ধ। মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে ক্রমেই বেজিংয়ের দিকে এগিয়ে আসছিল কমিউনিস্টদের লাল ফৌজ। চিয়াং কাইশেক তাদের ঠেকানোর বহু চেষ্টা করেছিলেন।

China Taiwan Conflict
চিয়াং ও গান্ধীজি।

আন্তর্জাতিক মহলও তাঁকে সাহায্য করেছিল। একবার চিয়াং কমিউনিস্টদের চারদিক থেকে ঘিরে মারার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সবই বৃথা চেষ্টা। লাল ফৌজকে থামানো তাঁর সাধ্য ছিল না। ১৯৪৯ সালের শেষ দিকে লালফৌজ হইহই করে ঢুকে পড়ল বেজিং-এ। ১ অক্টোবর মাও সে তুং বিপ্লবের বিজয় ঘোষণা করলেন। তখন থেকে চিনের নাম হল পিপলস রিপাবলিক অব চায়না।

পরাজিত হয়ে চিয়াং আশ্রয় নিলেন তাইওয়ানে। তিনি ওই দ্বীপে রাজত্ব করতে লাগলেন। দ্বীপের নাম হল রিপাবলিক অব চায়না।

চিন-তাইওয়ান বিবাদ (China Taiwan Conflict) শুরু

মাওয়ের নেতৃত্বে চিনের মূল ভূখণ্ডের নাম হল ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চিন’ আর চিয়াং-এর রাজত্বের নাম হল ‘প্রজাতন্ত্রী চিন’। তখন থেকেই চিন আর তাইওয়ানের মধ্যে বিরোধ শুরু। কমিউনিস্ট সরকারের দাবি, তাইওয়ান চিনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাইওয়ান বলে, আমরা স্বাধীন দেশ। এই নিয়ে টেনশন চলছে ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে। গত কয়েকদিনে তা রীতিমতো বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গিয়েছে।

China Taiwan Conflict
তাইওয়ান প্রণালীতে চিনের যুদ্ধজাহাজ।

স্তালিনের পরামর্শ

শোনা যায়, ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার তদানীন্তন শাসক জোসেফ স্তালিন নাকি চেয়েছিলেন, চিন শীঘ্র তাইওয়ান দখল করে নিক। তিনি মাওকে সেরকমই পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু মাও রাজি হননি। তাঁর বক্তব্য ছিল, দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ করার পর গণফৌজ এখন ক্লান্ত। এর পরে তাইওয়ান দখল করতে গেলে ফের অনেক রক্তক্ষয় হবে। তার বদলে এখন চিনের অর্থনীতিকে নতুন করে গড়ে তোলা যাক। সেই আমলে আন্তর্জাতিক মহলে চিনকে বলত ‘সিক ম্যান অব দি ইস্ট’। অর্থাৎ প্রাচ্যের রুগ্ন মানুষ। চিনাদের হতদরিদ্র অবস্থা দেখে সাহেবরা ওই নাম দিয়েছিল। মাও ভেবেছিলেন, বিপ্লবের পরে দ্রুত চিনের আর্থিক দুর্দশা ঘোচাবেন।

তাইওয়ানের পাশে আমেরিকা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমেরিকা ও সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে শুরু হয় ঠান্ডা যুদ্ধ। সারা বিশ্ব দু’টি শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। কোনও কোনও দেশ সোভিয়েতের পক্ষ নেয়, কোনও দেশ আমেরিকার। সেই নিয়ে খুচখাচ সংঘর্ষ চলতে থাকে। কমিউনিস্ট দেশ হিসাবে চিন একসময় ছিল রাশিয়ার বিশ্বস্ত মিত্র। আবার কমিউনিস্ট বিরোধী দেশ হিসাবে আমেরিকার স্বাভাবিক মিত্র ছিল তাইওয়ান।

তারপরে কেটে গিয়েছে ছয় দশকের বেশি। চিনাদের আগ্রাসী মনোভাব বদলায়নি। আমেরিকার নীতিও একই আছে। তারা তাইওয়ানের রক্ষক। সম্প্রতি তাইওয়ান নিয়ে চিন একটু বাড়াবাড়ি শুরু করেছিল। এই প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার রাতে তাইপেই-এর অদূরে সোংসান বিমান বন্দরে নেমেছে ন্যান্সি পেলোসির বিমান। গত ২৫ বছরে মার্কিন প্রশাসনের এত উচ্চপদস্থ কোনও কর্ত্রী ওই দেশে যাননি। তাঁর বিমান তাইওয়ানের মাটি স্পর্শ করার কিছুক্ষণের মধ্যে বিবৃতি দিয়েছে চিন। তাদের মতে, তাইওয়ান প্রণালীতে শান্তি ও সুস্থিতি নষ্ট করছে আমেরিকা।

অন্যদিকে মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকার পেলোসি বলেছেন, তাইওয়ানের ২ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষের উদ্দেশে আমরা বলতে চাই, তাঁরা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। সারা বিশ্বকে এখন একনায়কতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যে কোনও একটিকে বেছে নিতে হবে। আমরা তাইওয়ানের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি সংহতি জানাচ্ছি।

এর আগে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকারে পেলোসি বলেছেন, ‘চিনের কমিউনিস্ট পার্টি তাইওয়ানকে হুমকি দিচ্ছে। এই অবস্থায় আমরা চুপ করে থাকতে পারি না’। পরে পেলোসি বলেন, ‘চিন হংকং-এ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ব্যাপক দমনপীড়ন চালিয়েছে। উইঘুর ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জনজাতির অনেকে চিনাদের হাতে নিহত হয়েছেন। একে গণহত্যা ছাড়া কিছুই বলা যায় না।’

হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জন কিরবি এক বিবৃতিতে বলেন, ‘চিনের হুমকিতে আমরা ভয় পাব না। পেলোসির তাইওয়ান সফরের ফলে নতুন করে কোনও সংকট সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়।’ হোয়াইট হাউসের আশঙ্কা, চিনারা তাইওয়ানের অর্থনীতির ক্ষতি করতে পারে। কিরবি স্পষ্ট বলেন, চিন তাইওয়ান সম্পর্কে কী মনোভাব নেয়, তার ওপরে আগামী দিনে বেজিং-এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নির্ভর করবে।

হোয়াইট হাউসের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, ইউক্রেনের পরে আগামী দিনে তাইওয়ান একটি ফ্ল্যাশ পয়েন্ট হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে।

জাপানের ঘোষণা

১৯৫২ সালে জাপান রাষ্ট্রপুঞ্জে ঘোষণা করে, তারা আর কখনও তাইওয়ান দখল করতে যাবে না। এজন্য আমেরিকাই মধ্যস্থতা করেছিল। ১৯৫৪ সালে তাইওয়ানের সঙ্গে আমেরিকার প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আমেরিকা ঘোষণা করে, তাইওয়ান কোনও বিপদে পড়লে তারা রক্ষা করবে। এক্ষেত্রে পরোক্ষে যে চিনকেই হুমকি দেওয়া হয়েছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর পরেও ১৯৫৮ সালে তাইওয়ানের কিনমেনে একটি দুর্গে গোলাবর্ষণ করে চিনা ফৌজ। দুর্গ থেকে পাল্টা জবাব দেওয়া হয়। দু’পক্ষের গোলার লড়াই চলে ৪০ দিন ধরে।

চিনে টালমাটাল

ছ’য়ের দশকে দুই দেশের মধ্যে শান্তি বজায় ছিল। তখন চিনারা তাইওয়ানের দিকে হাত বাড়ায়নি। সেই সময় চিনের মধ্যে খুব বড় গোলমাল চলছিল। দেশের অভ্যন্তরে অশান্তির জন্য তাইওয়ানের দিকে নজর দেওয়া চিনাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

১৯৫৮ সালে মাও চিনের কৃষি ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করলেন। তা থেকেই ঘটে গেল বিপর্যয়।

মাও চেয়েছিলেন, কৃষকদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিগুলো নিয়ে একসঙ্গে বানাবেন যৌথ খামার। তাতে ফসল উৎপাদন অনেক বেশি হবে। এই কর্মসূচির নাম ছিল ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’। মাও ভেবেছিলেন, তাঁর দেশ ‘বৃহৎ লাফ’ দিয়ে সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাবে। কিন্তু চাষিরা কি সহজে জমি দিতে চায়। এই নিয়ে শুরু হল ঝামেলা। তাছাড়া নিজেদের জমিতে তারা যে শ্রম দিত, যত্ন নিয়ে চাষ করত, যৌথ খামারে তা করেনি। তাই ফসল উৎপাদন কমতে লাগল। চিনদেশ জুড়ে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। বহু লোক মারা পড়ল।

সুযোগ বুঝে কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে সক্রিয় হল মাও বিরোধীরা। তারা প্রচার করতে লাগল, মাওয়ের নীতির জন্য চিন সর্বনাশের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। মাওয়ের শত্রুদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লিউ শাও চি, তেং শিয়াও পিং প্রমুখ।

China Taiwan Conflict
মাও সে তুং বিপ্লবের বিজয় ঘোষণা করছেন।

রাশিয়ার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি

ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক মহলেও চিন একা হয়ে পড়ছিল। স্তালিনের আমলে সোভিয়েত রাশিয়া ছিল তাদের বড় বন্ধু। স্তালিনের পরে সোভিয়েত রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা হলেন নিকিতা ক্রুশ্চভ। তাঁর সঙ্গে চিনাদের বনিবনা হত না। তিনি বলতেন, স্তালিন রাশিয়ার অনেক ক্ষতি করেছেন। তিনি শেষের দিকে একনায়ক হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু চিনারা স্তালিনকে ভিলেন বলে মানতে রাজি ছিল না। তাছাড়া ক্রুশ্চভ বলতেন, এখনকার দিনে আর বিপ্লব করার দরকার নেই। চিনারা সেকথাও মানেনি। বিরক্ত হয়ে ক্রুশ্চভ চিনকে সবরকম সাহায্য দেওয়া বন্ধ করলেন।

সোভিয়েত থেকে যে বিশেষজ্ঞরা চিনকে সাহায্য করতে গিয়েছিলেন, তাঁরাও দেশে ফিরে এলেন। চিন পড়ল মহা ফাঁপরে।

তাইয়ানের দ্রুত উন্নতি

চিনের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তাইওয়ানের যাত্রাপথ ছিল মসৃণ। ছয় ও সাতের দশকে তাইওয়ানে দ্রুত শিল্পায়ন হয়। দেশের নানা অঞ্চলে রেলপথ, সড়কপথ, ব্রিজ, বন্দর ইত্যাদি পরিকাঠামোও গড়ে ওঠে। তার পিছনে আমেরিকার অবদান ছিল অনস্বীকার্য। তখন জাপানের পরে তাইওয়ান ছিল এশিয়ার সবচেয়ে দ্রুত বিকাশশীল অর্থনীতি। সেই আমলে অবশ্য দেশে গণতন্ত্রের অভাব ছিল। চিয়াং কার্যত ছিলেন একনায়ক। তাঁর দল কুয়োমিনটাং পার্টি একাই দেশ চালাত। কোনও বিরোধী দল ছিল না।

China Taiwan Conflict
তাইওয়ানের সেনা। যুদ্ধ বাধলে চিনকে ঠেকাতে পারবে কি?

কিসিংগারের বেজিং যাত্রা

কিসিংগার এখন কোথায়, এই প্রশ্নটা ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে অনেককে ভাবিয়ে তুলেছিল। আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিংগার তখন পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। পাকিস্তানের সেনাশাসক ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বৈঠকের পরে কিসিংগারের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই বিশ্বজুড়ে জল্পনা ছড়িয়ে পড়েছিল, কিসিংগার এখন কোথায়?

পরে জানা যায়, পাকিস্তান থেকে কিসিংগার গোপনে গিয়েছিলেন চিনে। একথা শুনে প্রথমে সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল। কী ব্যাপার? পুঁজিবাদের দেশ আমেরিকার দূত কমিউনিস্ট চিনে কেন? পরে বোঝা গেল, তার কারণ আছে। অত্যন্ত গুরুতর কারণ।

ততদিনে চিনের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক খুব খারাপ হয়ে উঠেছে। প্রায় যুদ্ধ লাগার উপক্রম। এমনও আশঙ্কা ছড়িয়েছে যে, রাশিয়ানরা পরমাণু বোমা ব্যবহার করতে পারে চিনের ওপরে। তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য চিন আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইছিল।

চিনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ছিলেন মস্ত বড় কূটনীতিক। পেশাদার ডিপ্লোম্যাটদের মতো তিনি মনে করতেন, কূটনীতির সঙ্গে মতাদর্শের সম্পর্ক নেই। যে দেশের সঙ্গে হাত মেলালে সবচেয়ে বেশি লাভ হবে, তার সঙ্গেই বন্ধুত্ব করা উচিত। তিনি প্রথমে গোপনে যোগাযোগ করেছিলেন কিসিংগারের সঙ্গে। তারপর কিসিংগার গোপনে বেজিং-এ যান। তার পরের বছরে, অর্থাৎ ১৯৭২ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন গিয়েছিলেন চিনে। মাওয়ের সঙ্গে ছবিও তুলেছিলেন। আসলে সোভিয়েতকে বিপাকে ফেলার জন্য চিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা আমেরিকারও প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

এবার তাইওয়ানের কী হবে?

১৯৭১ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জে একটি বিশেষ প্রস্তাবে বলা হল, এখন থেকে চিনা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবে পিপলস রিপাবলিক অব চায়না। অর্থাৎ রাষ্ট্রপুঞ্জ চিনের কমিউনিস্ট সরকারকে স্বীকৃতি দিল। কিন্তু আমেরিকা তা বলে তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক একেবারে ত্যাগ করল না। তারা জানত, চিন ফের তাদের শত্রু হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই তারা তাইওয়ানের হাত ছাড়েনি। নিয়মিত গোপনে অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে সাহায্য করে গিয়েছে।

ইতিমধ্যে পরিবর্তনের পথে এগোচ্ছিল ওই দ্বীপরাষ্ট্র। ১৯৭৫ সালে চিয়াং-এর মৃত্যু হয়। কুওমিনটাং পার্টির সর্বাধিনায়ক হন তাঁর ছেলে চিয়াং চিং কুও। ১৯৮৬ সালে দেশে প্রথম বিরোধী দল তৈরি হয়। তার নাম ছিল ডেমোক্র্যাটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি। চিয়াং চিং কুও প্রথমদিকে বিরোধীদের দমন করার চেষ্টায় ছিলেন। পরে আমেরিকানরা তাঁর ওপরে গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য চাপ দিতে থাকে। ১৯৮৮ সালে চিয়াং-এর ছেলে মারা যান। ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। দেশে কুওমিনটাং পার্টির একাধিপত্যের অবসান ঘটে।

ফের চিনের সঙ্গে শত্রুতা

১৯৭৬ সালে মাওয়ের মৃত্যু হয়। ক্রমে চিনে পার্টি ও প্রশাসনে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন দেং জিয়াও পিং। তাঁর আমলে চিনের রাষ্ট্রীয় নীতি বদলে যায়। সরকার ঘোষণা করে বড়লোক হওয়া দোষের নয়। সমাজতন্ত্রের প্রথাগত পথ থেকে সরে এসে ব্যক্তি মালিকানা ও ব্যক্তি উদ্যোগে উৎসাহ দেওয়া হতে থাকে। ক্রমে চিন হয়ে ওঠে প্রভূত ধনী ও শক্তিশালী। আমেরিকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে তারা। সেই সঙ্গে তাইওয়ানের ওপরে ফের তারা দাবি জানাতে থাকে।

বর্তমানে ভ্যাটিকান বাদে মাত্র ১৩টি রাষ্ট্র তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আর কেউ যাতে তাইওয়ান সরকারকে স্বীকৃতি না দেয়, সেজন্য চিনারা সক্রিয়। কেউ তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দিতে পারে সন্দেহ হলেই তারা সেই দেশের উপরে চাপ সৃষ্টি করে। ন্যান্সি পেলোসির সফরকে কেন্দ্র করে চিন তো রীতিমতো যুদ্ধের হুমকি দিয়েছে।

এই অবস্থায় ভারত কী করবে?

তাইওয়ান নিয়ে আপাতত দিল্লি নিরপেক্ষ অবস্থান নিচ্ছে। কিন্তু কতদিন মুখ বুজে থাকা সম্ভব হবে তাও বোঝা যাচ্ছে না। প্রতিবেশী দেশ চিন আর বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকা যদি সত্যিই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, ভারতের ওপরেও তার প্রভাব পড়বে। সেই অবস্থায় আমাদের দেশ কতদিন চুপ করে থাকবে?

ইতিহাস বলে, চিয়াং কাইশেক ছিলেন ভারতের বিশেষ বন্ধু। জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, অর্থাৎ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কয়েকমাস আগে তিনি এসেছিলেন এদেশে। সঙ্গে ছিলেন মাদাম চিয়াং। বিড়লা হাউসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন মহাত্মা গান্ধী। জওহরলাল ও অন্যান্য প্রথম সারির কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। যুদ্ধের পরে যাতে ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়, সেজন্য তিনি চার্চিল ও রুজভেল্টের কাছে অনুরোধ করেছিলেন।

তিনি যদি চিনের শাসক থাকতেন, তাহলে ১৯৬২ সালের যুদ্ধ হয়তো হত না। লাদাখে চিন সীমান্তে এখন যেমন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, প্রাণহানি হচ্ছে, তাও হয়তো হত না। এশিয়ার দু’টি সুপ্রাচীন দেশ, ভারত ও চিন শান্তিতে বসবাস করত। তাইওয়ান নিয়ে নীতি নির্ধারণের আগে ভারতকে এই কথাটা খেয়াল রাখতে হবে।

ছবির মতো দেশ, আর তার রক্তাক্ত ইতিহাস— ভুলে যাননি তো?

You might also like