নিজের আসন্ন বই 'নাইফ'-এর প্রচারে সলমন রুশদি।
শেষ আপডেট: 15th April 2024 18:27
দ্য ওয়াল ব্যুরো: সেই সকালটার কথা ভাবলেই আজও আতঙ্কে শিউরে ওঠেন তিনি। পরিচয়ে তিনি সাহিত্যিক। সৃজনকল্পনার রঙে বইয়ের পাতায় তিনি জারিয়ে তোলেন বাস্তব। যে বাস্তবে মিশে থাকে কল্পনার ঠাসবুনোট, ইতিহাসের পদচারণা, জাদুবাস্তবতার আখ্যান। অথচ নিউ ইয়র্কের শ্যাটোকোয়া ইনস্টিটিউশনে গত ২০২২ সালের ১২ আগস্টের পর থেকে তাঁর ভাবনায় ঘোরাফেরা করে, তিনি ভাগ্যবান! ওই সকালের পরে এখনও তো তিনি বেঁচে আছেন!
জীবিত থাকা যেখানে সৌভাগ্য, সেখানে ভাবনার গতি নাকি বাঁক নেয় বৈকি। অকপটে যা স্বীকার করেন সলমন রুশদি। বিশ-একুশ শতকের সাহিত্যের ইতিহাসের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র রুশদি সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন সেইসব দিনের অভিজ্ঞতা। সেসব শুনলেও যে কারোর অস্বস্তি হ'তে পারে। সেদিনের সেই অনুষ্ঠানে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন রুশদি। বক্তৃতা দিতে উঠবেন মঞ্চে, এমন সময় ভিড়ের মাঝ থেকে দৌড়ে আসে ২৪ বছরের তরুণ আততায়ী হাদি মাতার। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভয়ানকভাবে সাহিত্যিককে কোপাতে শুরু করে সে। মাত্র ২৭ সেকেন্ডের মধ্যেই বারোটির কাছাকাছি ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হ'ন রুশদি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাঁর চোখ ও তলপেট। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত নিউ ইয়র্ক পুলিশের এক বাহিনী তৎপরতার সঙ্গে গ্রেফতার করে আততায়ী হাদিকে।
'সেদিনের সেই অনুষ্ঠানে আসলে যেতে চাইনি, জানেন', নিজের আসন্ন বই 'নাইফঃ মেডিটেশনস আফটার অ্যান অ্যাটেম্পটেড মার্ডার'-এর প্রচার উপলক্ষ্যে ওই সাক্ষাৎকারে বলছিলেন ৭৬ বছরের রুশদি, 'আমার বারবারই মনে হ'ত, কোথাও বক্তৃতা দিতে গেলে একদিন নির্ঘাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ আমায় আক্রমণ করবে! এমনকি ওই অনুষ্ঠানের দিনদুয়েক আগেই দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সেদিন তাই যেতে মন সায় দিচ্ছিল না। পরে ভাবলাম, একটা স্বপ্নকে এত গুরুত্ব দিয়ে কী হবে? তাছাড়া, ভাল টাকাও দিয়েছিল ওরা। সবাই টিকিট কিনেছিল। তাই মনে হল, চলেই যাই।'
একটা চোখে পুরোপুরি দৃষ্টি হারিয়েছেন রুশদি। বলছেন, চোখটা নাকি খুলে বেরিয়ে এসেছিল! এখনও এক চোখের দৃষ্টি না থাকা যন্ত্রণা দেয় তাঁকে। নিউ ইয়র্কের হাসপাতালের ডাক্তাররা প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় যমের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনেন রুশদিকে। 'নাইফ'-এর প্রথম পাতাতেই তাই রয়েছে, 'বইটি সেইসব মানুষকে, যারা আমার জীবন বাঁচিয়েছে।' এখনও এক হাতে পুরোপুরি সাড় নেই তাঁর। রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা ওই মুহূর্তের কথা মনে আছে রুশদির। সরসভাবে বললেন, 'ওই পরিস্থিতিতেও আমি ভাবছিলাম, আমার র্যালফ লরেন স্যুট, ক্রেডিট কার্ড আর বাড়ির চাবির কথা! এমন ধাক্কা খেয়েছিলাম যে সব পকেট থেকে ছড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কী জানেন তো, মাথার ভেতরে কেউ একজন বলছিল, আমি এ' যাত্রা মরব না। আমার ওগুলো লাগবে।'
এও এক জীবনবোধ! বোধ হয় জীবন আর মৃত্যুর মাঝে টানা সরু একটা রেখার ওপর দাঁড়িয়ে এরকম বোধ তৈরি হতে পারে। 'মিডনাইটস চিলড্রেন', রুশদির প্রথম উপন্যাস! জনপ্রিয়তার সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল, বুকার পুরস্কারের ইতিহাসে প্রথম 'বুকার অফ বুকার' সম্মান জিতে নেয়। তৃতীয় উপন্যাস 'শেম'-এর পাতায় উঁকি দেয় জাদুবাস্তবতা। ধরা দিয়েছিলেন সেই সময়কার পাকিস্তানের দুই যুযুধান নেতা, জুলফিকার আলি ভুট্টো ও জিয়া উল-হক। কিন্তু ১৯৮৮ সালে তাঁর চতুর্থ উপন্যাস 'দ্য স্যাটানিক ভার্সেস' প্রকাশিত হ'তেই পালটে যায় রুশদির দুনিয়া। ইসলাম ধর্ম ও নবী হজরত মুহম্মদের বিরুদ্ধে 'অবমাননাকর' মন্তব্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। বিভিন্ন দেশে শুরু হয় বিক্ষোভ, হিংসা, আক্রমণ! একাধিক দেশে বইটির ওপর জারি হয় নিষেধাজ্ঞা। ভারতেও নিষিদ্ধ হয় সেটি। কিন্তু ঘটনা সম্পূর্ণ অন্য মোড় নেয় ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। শিয়া ইসলামের অন্যতম সম্মাননীয় ধর্মগুরু ও ইরানের সুপ্রিম নেতা আয়াতোল্লাহ রুহোল্লাহ খোমেইনি রুশদির বিরুদ্ধে সরাসরি ফতোয়া জারি করেন। তৎকালীন মার্গারেট থ্যাচারের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ সরকার নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় সরিয়ে দেয় রুশদিকে।
তারপর থেকেই রুশদির জীবনে মৃত্যুর সঙ্গে খেলা চলেছে। কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বর, তাঁর কলম থেমে থাকেনি। ২০১২ সালে প্রকাশিত তাঁর স্মৃতিকথা 'জোসেফ আন্টন' সেসব স্মৃতির দলিল হয়ে থেকেছে।