শেষ আপডেট: 4th March 2025 18:54
দ্য ওয়াল ব্যুরো: নদীকেন্দ্রিক বাংলার প্রান্তিক মানুষদের কাছে নদী সাক্ষাৎ মায়ের মতো। ভয়াল বন্যার আতঙ্ককে ভুলিয়ে রেখে নদী জোগায় সোনার ফসল। সে এমনই এক জীবনধারণের মাধ্যম যেখানে বিপদকে অগ্রাহ্য করতে হয় প্রতিনিয়ত। সাংসারিক জোয়ালের তাড়নায় ভয় ও ক্লান্তির বিড়ম্বনা ভুলে ভাটিয়ালি ও সারি গানের সুরে একদল প্রান্তিক মানুষ এগিয়ে চলে শক্ত হাতে হাল ধরে। নদীর বুকে তাদের সঁপে দিয়ে ঘরণীরাও সাহসে ভর করে দিন কাটায়।
এটা মানতেই হবে, নদীর তীরে বাস সব সময় সর্বনাশ-প্রবণ। আবার, নদীপাড়ের উর্বরতা আর নদীগর্ভের গহীনতার উপর যাদের জীবন নির্ভর, তাদের অস্তিত্বরক্ষার সংগ্রাম, মুহূর্তের হাসিকান্না, আবেগের কাহিনি দুই বাংলা—পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। সেই সঙ্গে সর্বজনীন আবেদন সৃষ্টি করেছে মননশীল পাঠকের দরবারে। নদীমাতৃক দুই বাংলার মানুষের একটা বড় অংশ নদীর বুকে ভেসে বেড়ায়। কেউ মাছ ধরে, কেউ মাঝি বা দাঁড়ির কাজ করে, কেউ বা উর্বর নদীচরে কৃষিকাজে জীবিকা নির্বাহ করে।
আবার, দুই বাংলার নদীগুলির চরিত্র সর্বাংশে এক না হওয়ায় সামাজিক চরিত্রেও ভিন্নতা আছে। হাঁসুলির বাঁকের ছোট নদী, ভাগীরথী গঙ্গা, মহানন্দা, পদ্মা, তিতাস ও মেঘনা কিংবা কীর্তনখোলা সমস্ত নদীর চরিত্রও মানুষের মতোই ভিন্ন। পেশায় শিক্ষিকা সুমনা পাত্র তাঁর নতুন গ্রন্থে মানুষ-নদীর সম্পর্কের এ এক সুন্দর চিত্র এঁকেছেন।
লেখিকা তাঁর ‘বাংলা উপন্যাস: নদীজীবনের বহুমুখী পাঠ’ বইয়ে কেবলমাত্র আঞ্চলিক উপন্যাসের একটি বিশেষ ধারা হিসেবে নয়, বৃত্তিজীবী শ্রেণির জীবনকথা হিসেবেই দুই বাংলার নদীকেন্দ্রিক বাংলা উপন্যাসের আলোচনা করেছেন। সেই প্রেক্ষিতেই নদীনির্ভর বৃত্তিধারী মানুষদের জীবন-জীবিকা, তাদের সামাজিক অবস্থান, তাদের পারিবারিক জীবন, তাদের সাংগীতিক জগৎ, সর্বোপরি তাদের পারস্পরিক ভাব-বিনিময়ের মাধ্যম যে বৈচিত্রময় ভাষা, তার কথাও স্ববিস্তারে তুলে ধরেছেন লেখিকা। বিষয়ের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ, প্রয়োজনে তুলনামূলক বিচারে এই শ্রেণির উপন্যাসের মূল চরিত্র ও বাস্তবতাকে তুলে ধরে বাংলা ভাষা-সাহিত্যকে নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করার কাজটা নীরবে করে গিয়েছেন।
তাই তো গ্রন্থটির ভূমিকা লিখতে গিয়ে, প্রখ্যাত ভাষাবিদ, লেখক-সাহিত্যিক-কবি-সমালোচক পবিত্র সরকার বলছেন, “ড. সুমনা পাত্র দুই বাংলার নির্বাচিত নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস নিয়ে গবেষণা করেছেন, বাংলার ভূসাংস্কৃতিক চরিত্রের পক্ষে এ গবেষণা অনিবার্য ছিল। এই একই বিষয়ে আরও গবেষণা নিশ্চয়ই হয়েছে, হবার সুযোগও আছে। কিন্তু এ গ্রন্থটির পরিসর দুই বাংলা হওয়াতে এতে একটি তুলনার উপাদানও এসেছে।... অবলম্বিত উপন্যাসগুলিতে নদীচরিত্রের এই ভিন্নতার কথা যেমন আছে, তেমনই বড় নদী আর ছোট নদীর নিজস্ব আর তীরবর্তী জীবন-প্রতিবেশের ভিন্নতার কথাও আছে। সুমনার আলোচনায় সেগুলি প্রদর্শিত হয়েছে।” পবিত্র সরকারের এমন মন্তব্য শুধু লেখিকার নয়, সামগ্রিক ভাবে বইটির ভার ও মান কয়েকগুণ বৃদ্ধি করেছে।
আর একটা কথা বলতেই হবে, নদীকেন্দ্রিক জীবন শুধু নদী যাদের জীবিকা, সেই মাঝি-মাল্লা-মৎস্যজীবী বা পরিবহণকারীদের জীবন নয়, নদীতীরস্থ মানুষেরও জীবন। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, ‘নদীর ধারে বাস, ভাবনা বারো মাস’ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় যা ব্যবহার করেছেন। ফলে নদীতে বন্যা হয়, মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে; আবার নদী শুকিয়ে যায়, শস্যভূমি জল পায় না, মানুষের অনাহার জাগে। ফলে নদীর প্রভাব মানুষের জীবনে বহুব্যাপ্ত। গ্রন্থটিতে আলোচনায় সেই পরিসর এসেছে। সেই সঙ্গে শুধু বিষয় নয়, লেখিকা উপন্যাসগুলির ভাষাশৈলীও আলোচনায় এনেছেন, যা ওইসব সমাজ-প্রতিবেশের মানুষের সংলাপের প্রত্যক্ষতা আমাদের গোচরে এনেছে। আরও তৃপ্তির বিষয় এই যে, লেখিকা শুধু বিখ্যাত লেখকদের বহুপরিচিত উপন্যাসগুলিকে গ্রহণ করেননি, কয়েকজন স্বল্পপরিচিত লেখকের স্বল্পপ্রচারিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসকেও আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
একই সঙ্গে বলা যায়, নদী-মানুষ সম্পর্ক নিয়ে এমন আলোচনা শুধু বাংলা সাহিত্যকে ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করবে তাই নয়, আগামী দিনে এ সংক্রান্ত গবেষণার পথকে আরও বিস্তৃত করবে। ভবিষ্যৎ গবেষকদের হাত শক্ত করবে। যেহেতু, বইটিতে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের নদী-মানুষের জীবন-কাহিনি উঠে এসেছে, সে জন্য উভয় দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তথ্যবহুল থাকবে।
পরিশেষে বলতে হয়, বইটির আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ এবং মুদ্রণ পাঠকদের দৃষ্টিসুখ অবশ্যই দেবে।