শেষ আপডেট: 10th February 2025 17:34
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ‘কবি’ লেখেন যে তারাশঙ্কর, তাঁর হাতেই রচিত হয় ‘নাগিনীকন্যার কাহিনি’। ‘হাঁসুলিবাঁকের ইতিকথা’ ও ‘সন্দীপন পাঠশালা’ একই লেখকের রচনাবলিতে ঠাঁই পায়। একে নিছকই একজন বহুপ্রজ লেখকের প্রতিভা-বিকিরণ বলে এড়িয়ে যাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে সত্যকে আধেক চোখে দেখা হয় মাত্র। বাকি অর্ধেকে মিশে থাকে যে সত্য, তার মর্মার্থ এই: রাঢ় বাংলার যে পটভূমিকে নিজের উপাখ্যানে ধরতে চেয়েছিলেন তারাশঙ্কর, কিংবা শুধু তারাশঙ্করই বা বলি কেন, এই তালিকায় জুড়ে যেতেই পারেন সৈয়স মুস্তাফা সিরাজ থেকে হাসান আজিজুল হকের নামও—সেই পটভূমি সর্বার্থে বহুমুখী। তার একদিকে রুক্ষতা অন্যদিকে সজলতা। একদিকে জান্তবতা অন্যদিকে পেলবতা। একদিকে তা সামন্ততন্ত্রের অবশেষকে লালন করতে চেয়েছে, নস্যাৎ করেছে আধুনিক যা কিছু। অন্যদিকে প্রবাদ, ধর্মবিশ্বাস, সংস্কার, লোকশ্রুতি, লোকগানের পরম্পরাগত ঐতিহ্যকে রেখেছে অক্ষুণ্ণ, অটুট।
এই বহুমাত্রিক পটভূমিকে কাজে লাগিয়েই জীবনের প্রথম উপন্যাসটি লিখে ফেলেছেন শুভ রায়। নাম: ‘ভুসোকালির নকশা’। শুভ পেশায় গ্রাফিক ডিজাইনার। তাঁর বেড়ে ওঠা শান্তিনিকেতনে। এবং প্রথমতম আখ্যানের শিরোনাম হিসেবে তিনি মোক্ষমভাবেই বেছে নিয়েছেন একটি শব্দ: ‘নকশা’।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নকশাধর্মী রচনার একটি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রয়েছে। কালীপ্রসন্নের ‘হুতোম’ থেকে শুরু করে প্যারীচাঁদের ‘আলাল’। চুণিলাল মিত্রের ‘কলিকাতার নুকোচুরি’ থেকে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কলিকাতা কমলালয়’। রচনাগত ভিন্নতা থাকলেও একটি বিষয়ে মিল নজর টানে। সেটা হচ্ছে: নিজেদের নকশায় সামাজিক মন্তব্যকে (Social Commentary) কোনও লেখকই প্রচ্ছন্ন রাখেননি। ধরা যাক, ভবানীচরণ বিঁধেছেন উনিশ শতকের বিলাসসর্বস্ব, ভ্রষ্ট, চরিত্রহীন কোনও ‘বনেদি বাবু’-কে। কিন্তু সেই তীক্ষ্ণধার সমালোচনায় একই সঙ্গে বিদ্ধ হয়েছে কলকাতার সমাজব্যবস্থা। আলো পড়েছে সমাকালীন লোকাচারে। সামনে এসেছে শহুরে ঘরগেরস্থালির টুকরো টুকরো খণ্ডচিত্র, মেয়েদের অবরোধের কথা, আর্থিক শোষণের সত্যও। অর্থাৎ, মাইক্রো লেভেলে স্পটলাইটে রয়েছেন একজন ব্যক্তিচরিত্র কিন্তু ম্যাক্রো লেভেলে সংশ্লিষ্ট হয়েছে আনুষঙ্গিক সামাজিক বিষয়।
‘ভুসোকালির নকশা'ও বাংলা নক্সাসাহিত্যের এই সুমহান ঐতিহ্যকে আত্তীকরণ করে রচিত। দশটি অধ্যায় এবং বহু টুকরো টুকরো উপ-পর্বে লেখা হয়েছে এই উপন্যাস। পটভূমি শিমুলহাটি গ্রাম। সময়কাল চল্লিশের দশক। তিনটি রহস্যময় মৃত্যু পরপর ঘটে যায় বীরভূমের এই ছোট গ্রামে। অমাবস্যার রাতের হত্যাকাণ্ড আন্দোলিত করে গ্রামের মানুষদের। মাঘী পূর্ণিমার অমাবস্যা সমাগত। এবার কার পালা?
এই ভয়, আতঙ্ক যখন তাড়া করছে সকলকে, তখনই শিমুলহাটিতে এক আগন্তুকের আগমন হয়। বিচিত্রদর্শন, শহুরে। খাটো ধুতি পরনে, গায়ে ‘মরা সাহেবের কোট’। অদ্ভুত প্রশ্ন করেন, চলনে-বলনে ধরে রাখেন ধোঁয়াশা। জিজ্ঞাসা দ্বিগুণিত হয় গ্রামের মানুষদের মনে: কে এই ব্যক্তি? মার্কিন গুপ্তচর? নাকি ইংরেজদের পোষ্য? সমবেত তির্যক চাহনি কোট পরিহিত ব্যক্তিটির চারপাশ ঘেঁষে ঘুরপাক খায়। কিন্তু সমস্ত ধরনের অস্বস্তি ঝেরে ফেলে সে অপরাধের জটিল জট খুলে ফেলে। তারপর যেমন আচমকা এসেছিল, তেমনই আশ্চর্যজনকভাবে উধাও হয়ে যায়।
রহস্য-রোমাঞ্চের অন্তর্লীন টান বজায় রেখে আখ্যান সাজিয়েছেন শুভ। গ্রাফিক ডিজাইন পেশা হওয়ার সুবাদে যে চিত্রকল্পগুলি এঁকেছেন, তার প্রতিটি স্ট্রোকে ধরা পড়েছে সূক্ষ্মতা। ‘দুদিন ধরে ক্রমশ ঠাণ্ডা বাড়তে বাড়তে হঠাৎ যেন শীতের ধার ইস্পাতের মতো। ক্ষুদে ক্ষুদে জীব, পোকামাকড়, সরীসৃপের দল নিমেষে সেঁধিয়ে গেছে পৃথিবীর যত অদেখা ছিদ্রে, ফাটলে। হঠাৎ যেন জীবন বিরতি নিয়েছে। শুধু প্রাণের অতলে, অন্ধকারে, কেউ শ্বাস নিয়ে চলে সারা শীত।’—এই বর্ণনার নৈপুণ্য ‘প্রাগৈতিহাসিক’, ‘সরীসৃপে'র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা মনে করায়। পাশাপাশি বোলপুরের ভূমিপুত্র তিনি। তাই লালমাটির দেশজ সুর, উপভাষার আরণ্যক ঘ্রাণকে রচনার ভাববস্তু ও সংলাপ রচনায় সুবাসিত হয়েছে।
গোয়েন্দা গল্পের ‘থ্রিল’ তো বাইরের কুহক। ‘ভুসোকালির নকশা’ তার অন্তরে ধরে রেখেছে রাঢ়বঙ্গের মনস্তত্ত্ব ও লোকাচারের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। নাগরিক ও গ্রামীণ দুই ভিন্ন সংস্কৃতি বলয়কে দর্পণে ধরতে চেয়েছেন লেখক। যেখানে বিম্বিত হয়েছে সময়। পূরণ হয়েছে নকশাসাহিত্যের সমস্ত শর্ত।